শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আইপিআরএস প্রযুক্তিতে মাছ চাষে সফল আকবর

শাইখ সিরাজ

আইপিআরএস প্রযুক্তিতে মাছ চাষে সফল আকবর

পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে খাদ্য উৎপাদনের তাগিদ। মানুষ মনোযোগী হয়েছে কৃষির বিকাশে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটি হিসাব বলছে, পৃথিবীতে কৃষিকাজ হয় মোট আয়তনের ৩৮ ভাগে। আগে এ অংশটি ছিল নিতান্তই কম। দিন দিন বাড়ছে আবাদি এলাকা। বাড়ছে আবাসন ও অবকাঠামো। কমছে বনভূমি, জলায়তনসহ প্রাকৃতিক ভূমি। কিন্তু আবাদি এলাকাও আর কতটুকু বাড়ানো সম্ভব! ফলে গবেষকরা দৃষ্টি দিয়েছেন স্বল্প ভূমিতে বেশি উৎপাদনে। পাশাপাশি প্রকৃতির অপরিহার্য সব উপাদানকে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না করে কীভাবে উৎপাদনের গতি বাড়ানো যায়, সে ব্যাপারেও উদ্যোগী হচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। কৃষিতে এমন তৎপরতা বিশ্বব্যাপী। আমরা হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে সেই উদ্যোগগুলো নিয়মিত তুলে ধরছি। শুধু ফসল উৎপাদনেই নয়, মৎস্য খাতেও এ প্রবণতা শুরু হয়েছে জোরেশোরে।

মাছ উৎপাদনে পৃথিবীর প্রথম সারির পাঁচ দেশের একটি বাংলাদেশ। গত শতকের আশির দশকে মাছ চাষের যে বিপ্লব সূচিত হয়েছিল হাকিম আলীর হাত ধরে সেই রুপালি বিপ্লব সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে তরুণ উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে। হেক্টরের পর হেক্টর জমিতে পুকুর কেটে মাছ চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। একজনের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন অনেকেই।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ সময়ে গত কয়েক বছর ধরেই মাছ চাষে লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রযুক্তির অনুশীলন। প্রযুক্তি ব্যবহারে অল্প জায়গায় বেশি ঘনত্বের মাছ চাষ। দেশ-বিদেশের ঘরের ভিতর মাছ চাষের প্রযুক্তি Recirculating aquaculture system ev RAS, বায়োফ্লক যেমন টেলিভিশনে বা পত্রিকার লেখায় তুলে ধরেছি, তুলে ধরেছি বটমক্লিন রেসওয়ে সিস্টেম, ইনপন্ড রেসওয়ে সিস্টেম বা আইপিআরএসে মাছ চাষের বিষয়াদিও। প্রতিদিনই প্রযুক্তি এগিয়ে যাচ্ছে আরও দ্রুত গতিতে।

আমাদের মৎস্যশিল্পে বিগত সময়ের প্রধান সমস্যাগুলো যা মাছ চাষিদের কাছ থেকে বারবার উঠে এসেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অ্যামোনিয়া বা মাছের বর্জ্য মাছ চাষের প্রধান অন্তরায়। পুকুরের পানিতে মাছের বর্জ্য ও খাদ্যের অবশিষ্টাংশ মিশে পানি ও মাটি দূষিত করে ফেলে। ফলে কয়েক বছরের মাথায় মাছের উৎপাদন কমে যায়। মাছ চাষের অঞ্চলগুলোর অধিবাসীরা এ সমস্যার কথা বলে আসছেন দীর্ঘদিন ধরেই। কোনোভাবে যদি পানি থেকে অ্যামোনিয়া বর্জ্য সরিয়ে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া যায় তবে অধিক ঘনত্বেও মাছ চাষ সম্ভব। রেসওয়ে বটমক্লিন পদ্ধতি হচ্ছে পানিতে প্রবাহ তৈরি করে জলাশয়ের বর্জ্যটিকে তলানিতে নিয়ে গিয়ে অপসারণ করা।

পাঠক আপনাদের মনে থাকতে পারে বছর দেড়েক আগে আমি চাঁপাইনবাবগঞ্জের আকবর হোসেনের ইনপন্ড রেসওয়ে সিস্টেমের বিষয়টি নিয়ে লিখেছিলাম। ইনপন্ড রেসওয়ে সিস্টেম বা আইপিআরএসে প্রযুক্তির ব্যবহারে কম জায়গায় অধিক মাছ চাষ করা যায়। ২০১৭ সালের নভেম্বরে আমি আকবর হোসেনের মাছের খামার ঘুরে এসে তা নিয়ে লিখেছিলাম। বিস্মিত হয়েছিলাম বরেন্দ্রের পাল্টে যাওয়া কৃষি উদ্যোগ দেখে। সে সময় আকবর হোসেন বলেছিলেন, তিনি টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখেই উদ্বুদ্ধ হন কৃষি অনুশীলনে। অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য ঘুরেছেন দেশে-বিদেশের খামারে। সাফল্যের চূড়ায় উঠতে যা যা প্রয়োজন তার সবটাই ঢেলে ২০ হেক্টর জায়গার ওপর ৩৬টি পুকুর নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন মাছের বিশাল খামার। শুধু মাছই নয়, খামারে রোপণ করেছিলেন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গাছগাছালি। পুকুরের পাড়ে মাল্টা গাছ রোপণ করেছেন ৪০০টি। ভিয়েতনামের নারিকেল চারা লাগিয়েছেন ৫০০টি। আছে ৬০০ ড্রাগন ফলের গাছ আর বিভিন্ন জাতের সারি বাঁধা পেঁপে গাছ। খামারটির এক পাশে প্রচুর কলাগাছ লাগিয়েছেন তিনি। খামারের সঙ্গে পাশেই রয়েছে আকবর হোসেনের নিজস্ব ফিডমিল। ফিডমিলের পাশে সুন্দর এক কবুতরের খামার। ২০১৭ সালেই তার কৃষি খামার দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। কারণ, মাছ চাষের ক্ষেত্রে অনেক নতুন অনুশীলন শুরু করেছিলেন তিনি। সব পুকুরে মাছের পর্যাপ্ত অক্সিজেন জোগান দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেছিলেন অ্যারেটার। মাছের খাদ্য দেওয়ার বেলায় ম্যানুয়াল পদ্ধতি নয়, রয়েছে অটোফিডার। ফলে খাবারের অপচয় যেমন রোধ হয় তেমনি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবার দেওয়াটাও নিশ্চিত হচ্ছে। এরপর ২০২১ সালে আকবর হোসেনের খামারে গিয়ে নতুনভাবে বিস্মিত হলাম। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছেন আকবর হোসেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বুলনপুরে বিশাল খামারটিতে যুক্ত করেছেন ইনপন্ড রেসওয়ে সিস্টেম বা আইপিআরএস। আমার জানামতে, তখন পর্যন্ত আইপিআরএস পদ্ধতিতে মাছের খামার দেশে এটাই প্রথম ছিল। পাঠক, বলে রাখতে চাই, আইপিআরএস মূলত আমেরিকান প্রযুক্তি। চীন সেই প্রযুক্তিটিকে কাজে লাগিয়ে গত কয়েক বছরে মাছ চাষে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। এ পদ্ধতিতে মাছ চাষের বিশেষত্ব হলো- কম জলাশয়ে মানসম্মত অধিক পরিমাণ মাছ উৎপাদন করা যায়। খামারটিতে আগে পুকুর ছিল ৩৬টি। এখন ৪২টি। বিশাল খামারের ৬০ বিঘার একটি পুকুরে তৈরি করা হয়েছে কংক্রিটের ১৩টি চ্যানেল। সেখানে পাইপলাইনে সংযুক্ত রেসওয়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে চ্যানেলগুলোয় কৃত্রিম স্রোত তৈরি করা হচ্ছে। এতে প্রবহমান পানিতে সব সময়ই তৈরি হচ্ছে অক্সিজেন। চ্যানেলের মাছগুলো পাচ্ছে নদীর স্রোত ও পরিবেশ। ফলে স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ বেশি মাছ বসবাস করতে পারছে। একেকটি চ্যানেলে রয়েছে একেক ধরনের মাছ। আকবর হোসেন জানালেন, প্রযুক্তির সাহায্যে খাবার সরবরাহ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচর্যা হওয়ায় মাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে এবং নেই রোগবালাইয়ের প্রকোপ। মাছ চাষের প্রতিটি স্তর এতটাই স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ যে, মাছের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। মাছ দেখতে যেমন নদীর মাছের মতো জীবন্ত, স্বাদে-গন্ধেও অতুলনীয়। আইপিআরএস প্রযুক্তিতে ১৩টি চ্যানেলে মোট বিনিয়োগ ৫ কোটি টাকার বেশি। একেকটি চ্যানেলের দৈর্ঘ্য ২২ মিটার, প্রস্থ ৫ মিটার আর গভীরতায় আড়াই মিটার। অর্থাৎ ১ শতাংশের একেকটি চ্যানেল। আকবর হোসেন বলছিলেন, এক চ্যানেল থেকে তিনি যে মাছ চাষ করতে পারেন, সাধারণ পুকুরে মাছ চাষ করতে হলে তার ৫ বিঘার পুকুর প্রয়োজন হতো। বছরে দুবার মাছ উৎপাদন করছেন।

এখানে ১ শতাংশ করে ১৩টি চ্যানেলে মোট ১৩ শতাংশে বেশি ঘনত্বে মাছ উৎপাদন হলেও এ প্রযুক্তি সচল রাখতে পুরো ৬০ বিঘার পুকুরটিকেই ব্যবহার করা হচ্ছে। চ্যানেলগুলোতে বেশি ঘনত্বে আর চ্যানেলের বাইরে প্রচলিত পদ্ধতিতেই মাছ চাষ চলছে। পদ্মা থেকে সংগৃহীত রুই মাছের চাষ করছেন ১২টি চ্যানেলে। আর একটি চ্যানেলে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করছেন বিএফআরআই উদ্ভাবিত সুবর্ণ রুই। আকবর বলছিলেন, প্রযুক্তি ব্যবহার করায় মাছের মৃত্যুহার কমেছে অনেক গুণ। পাশাপাশি নদীর মাছের স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে চাষের মাছেও। সবচেয়ে বড় কথা প্রযুক্তি ব্যবহার করায় মাছ চাষে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। বরং মাছের বর্জ্য সম্পদে রূপান্তর করছেন তিনি। সেই বর্জ্য মেশিনের সাহায্যে তুলে নিয়ে ফল ও সবজি চাষে সার হিসেবে ব্যবহার করছেন। এতে পানি যেমন পরিষ্কার থাকছে, সবজি ও ফলের সার খরচও লাগছে না।

প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে দিন দিন উৎপাদন বাড়ছেই। আকবর হোসেন এরই মধ্যে বিনিয়োগের অনেকটাই তুলে এনেছেন। বলছেন মানসম্মত পোনা পাওয়া গেলে আইপিআরএসে উৎপাদিত মাছে লাভ বেশি। খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি আমাদের এখন ভাবতে হচ্ছে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়েও। সে প্রশ্নে প্রযুক্তির কৃষির বিকল্প নেই। আমরা দেখেছি গত কয়েক দশকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফসলি জমি কেটে পুকুর বানিয়ে মাছ চাষের একটা প্রবণতা। এতে আমরা মাছ চাষে এগিয়েছি, কিন্তু কৃষি ফসল উৎপাদনের জমি হারিয়ে ফেলছি। সে ক্ষেত্রে যদি আইপিআরএস প্রযুক্তিতে খামার গড়ে তোলা হয় তাহলে কম জায়গাতেই বেশি মাছ পাওয়া যাবে। এতে ফসলি জমি নষ্ট করে হাজার হাজার পুকুর তৈরির দরকার পড়বে না। মৎস্য খাতকে আরও লাভজনক করতে সরকারের উচিত হবে মাছ রপ্তানিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। বিদেশে মানসম্পন্ন মাছের বাজার ধরতে পুরোপুরি প্রস্তুত আকবর হোসেনের মতো মাছ চাষিরা। এখন প্রয়োজন তাদের আরও বহুদূর এগিয়ে যাওয়ার পথটি আলোকিত করার। এ দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব  

[email protected]

সর্বশেষ খবর