মঙ্গলবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাবা-মায়ের কবরে ফাতেহা পাঠে অপার শান্তি

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

বাবা-মায়ের কবরে ফাতেহা পাঠে অপার শান্তি

বহুদিন পর জন্মভূমি কালিহাতী উপজেলার ছাতিহাটি গ্রামের বাড়িতে পুরো পরিবার বাবা-মায়ের কবর জিয়ারতে গিয়েছিলাম। সেখানে দাদা-দাদি, চাচা, ভাই-বোনেরও কবর আছে। অনেকদিন আমরা পুরো পরিবার এতটা একত্র হতে পারিনি। পরিবারের মাথা লতিফ সিদ্দিকী, তাঁকে উপলক্ষ করেই আমরা গিয়েছিলাম। এমনিতে আমরা ছয় ভাই, তিন বোন, দুই মা। আসলে আমরা সাত ভাই, তিন বোন। মুন্নুকে নিয়ে ছোট মা আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। মোশারফ হোসেন মুন্নুর মতো ভালোমানুষ আমি জীবনে দেখিনি। যুক্তরাষ্ট্র থাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৬ আগস্ট ১৯৭১ আমার হাতে পায়ে গুলি লাগলে মাকেসহ রহিমা, শুশু, শাহানা, আজাদ, মুরাদকে ঢাকা পাঠিয়েছিলাম সারা খালা আর ডা. শাহজাদা চৌধুরীর শ্বশুরবাড়ি নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার বাড়িতে। তাদের আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়েছিলাম। বাবুল, বেল্লাল, বাবাকে নিয়ে হাতে পায়ে গুলি লাগার পরও ১৬০ মাইল হেঁটে মেঘালয়ের তুরা জেলার বারাঙ্গাপাড়ায় গিয়েছিলাম। বাবুল নিজের পায়ে হেঁটেই গিয়েছিল। কিন্তু বেল্লাল পেরে ওঠেনি। ওকে অনেকটা পথ কাঁধে কাঁধে নিতে হয়েছে। কিন্তু যেতে পেরেছিল বলেই আজও আমরা সবাই বেঁচে আছি। সবই পরম করুণাময় আল্লাহর মেহেরবানি। মুন্নু যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে, বেল্লাল ছেলেমেয়ে নিয়ে ইংল্যান্ডে। বাকিদের মধ্যে শাহানার স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা ’৭৫-এর প্রতিরোধ যোদ্ধা আরিফ আহমেদ দুলাল অসুস্থ হয়ে পড়ায় যেতে পারেনি। আর পারেনি মুরাদ। ওর এক ছেলে এক মেয়ে কানাডায়। ছোট মেয়ে ধ্রুপদী একেবারে আমার মায়ের মতো। কথাবার্তাও অসাধারণ। সে আর তার মা নীহার, আমাকে সব সময় অসম্ভব আদরযত্ন করেছে। ওরা যেতে পারেনি। মা-বাবার মৃত্যুর সময়ও সবাই একত্রে কবরে যায়নি বা যেতে পারেনি কেউ যুক্তরাষ্ট্র, কেউ লন্ডন, কেউ কানাডা, কেউ আবার সিঙ্গাপুর এসব কারণে। মৃত্যু তো আর বলে কয়ে আসে না। আমি অভাগা মাটির মানুষ, বিদ্যাবুদ্ধি নাই, মাটি-মা ছাড়া কিছুই জানি না। তাই আমি আর কোথায় যাই? পড়ে থাকি গ্রামে গ্রামে বনে বাদাড়ে। আমার দুই চাচা আবদুল বারী সিদ্দিকী ও ওয়াদুদ সিদ্দিকী। বারী সিদ্দিকীকে মুক্তিযুদ্ধের সময় ময়মনসিংহের নতুন বাজারে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে গুলি করে নদীতে ফেলে দিয়েছিল। আল্লাহ বাঁচা-মারার মালিক। তিনি বাঁচিয়েছিলেন। ছোট চাচা ওয়াদুদ সিদ্দিকী বড় কষ্ট করে গ্রামেই ছিলেন। তাঁদের ছেলেমেয়ে-বউয়েরা সবাই গিয়েছিল। শিল্পী, লুচি ওদের ছেলেমেয়েরা গিয়েছিল। আমার এক ভাই টুটুল কিছুদিন আগে মারা গেছে। সেই টুটুলের মা ও স্ত্রী গিয়েছিল। তেমন কেউ বাদ ছিল না। সবাই গিয়েছিল। ছোটবোন শুশু যাকে আমি সন্তানের মতো আদর করি, ভালোবাসি সে এখন কানাডায়। তাই মা-বাবা, দাদা-দাদি, আত্মীয়স্বজনের কবরের পাশে হাত তুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে পারেনি। বহুদিন পর ছাতিহাটি মসজিদে চার ভাই পাশাপাশি নামাজ আদায় করেছি। হাবিবুর রহমান তালুকদার বীরপ্রতীক, আবদুল্লাহ বীরপ্রতীক ছিল, ছিল আরও শত শত মানুষ। মস্তবড় মসজিদে জায়গা হয়নি। আর গরম ছিল প্রচন্ড। গাছের ছায়া ছাড়া দাঁড়ানো ছিল প্রায় অসম্ভব। অত গাছপালা ছিল না। মানুষ ভীষণ কষ্ট করেছে। সেই আউলিয়াবাদ আলাউদ্দিন সিদ্দিকী কলেজ থেকে এদিকে ধল্লাই পর্যন্ত মানুষ আর মানুষ। অত উৎসাহী মানুষ ছাতিহাটি কখনো দেখেনি। নাগবাড়ির স্পিকার আবদুল হামিদ চৌধুরীর নাতি, সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ছেলে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী কায়সারকে আমরা খুবই ভালোবাসি। কায়সার আমাদের আত্মার আত্মীয়ের মতো। সব মানুষেরই একে অন্যের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক আছে। কিন্তু কায়সারদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার। আমাদের মুচু দাদা মুক্তিযুদ্ধের সময় নাগবাড়ি কায়সারদের বাড়ি দেখাশোনা করতেন। আচমকা একদল হানাদার নাগবাড়ি গিয়ে হঠাৎই মুচু দাদার মুখের মধ্যে রিভলবার ঢুকিয়ে গুলি করে তাকে হত্যা করেছিল। সে বড়ই মর্মন্তুদ, বেদনাদায়ক ঘটনা। তাই কায়সারকে এই পবিত্র মাহফিলে যেতে অনুরোধ করেছিলাম। ওর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মায়ের মৃত্যু নিয়ে পূর্বনির্ধারিত এক মাহফিল ছিল বিকাল ৪টায়। তার পরও কায়সার যেতে চেয়েছিল। পরে সাব্যস্ত হয় হেলিকপ্টারে যাবে। কায়সার একা। হেলিকপ্টারে সিট চারটি। একটি পাইলটের, অন্য তিনটি যাত্রীর। আমার কলিজার ধন ছোট ও বড় মেয়ে হেলিকপ্টারে যেতে আগ্রহী হওয়ায় জটিলতা কমে গিয়েছিল। ২৯ সেপ্টেম্বর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বেশকিছু যন্ত্রপাতি, রসদ যাচ্ছিল। ২৮ তারিখ রাত থেকে ক্ষণে ক্ষণে রাস্তা বন্ধ রাখা হয়েছে। যে কারণে গুলশান থেকে লতিফ ভাই, গাজীপুর থেকে আবদুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ থেকে শফিকুল ইসলাম দেলোয়ার এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফেরদৌস, ইলা ও নাফিসকে নিয়ে গুলশান থেকে টাঙ্গাইল যেতে রাস্তায় প্রায় দু-তিন ঘণ্টা আটকে ছিল। অন্যদিকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় ছিল প্রচন্ড যানজট। সব মিলিয়ে সে এক লেজেগোবরে অবস্থা। আমরা ঘারিন্দা, সুরুজ, ভুক্তা, গোপালদীঘি, সিংগাইর, বল্লা, চারান হয়ে ছাতিহাটি বাবা-মায়ের কবরে গিয়েছিলাম। আমাদের পৌঁছার চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই হেলিকপ্টারে চেপে আমার দুই মামণি ব্যারিস্টার কুঁড়ি ও কুশি সিদ্দিকী, প্রিয় ভাতিজা কায়সার চৌধুরী বাবা-মায়ের কবর থেকে দুই-আড়াই শ গজ দক্ষিণে নামে। যেখানে হেলিকপ্টার দাঁড়ায় সে এক মজার ঘটনা। এখনো পানির মাস বর্ষাকাল। আগেরকার দিনে গ্রামে গঞ্জে শত শত মাইলজুড়ে পানি থাকত। পানি আর পানি। পানির মধ্যে ভেসে থাকা দু-চারটি বাড়িঘর দেখা যেত। এখন তেমন পানি নেই। রাস্তাঘাটে সব ছেয়ে গেছে। তবু আমাদের চকে এখনো পানি আছে। কিন্তু কয়েক বছর আগে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী বেল্লালকে ৪০-৫০ শতাংশ জায়গা দিয়েছিলেন। তার মধ্যে সে বিলেতি ঢঙের বাড়ি বানাবে। মাটিও কাটাকাটি করেছে। বাজেটে কুলায়নি তাই পড়ে আছে। বড় ভাইয়ের দেওয়া বেল্লালের জায়গা থেকে পাকা সড়ক ৪০-৫০ গজ তো হবেই। সেখানে ২০-২৫ ফুট পাশে রাস্তা দিয়েছেন আমার ছোট চাচা ওয়াদুদ সিদ্দিকী। তিনি তাঁর বেটা-ভাইস্তাদের বা অন্য কাউকে এরকম বিনা কড়িতে সূচ্যগ্রমেদিনীও দেননি। কিন্তু বেল্লালকে দিয়েছেন। কম করে ৬ ডেসিমাল হবে। তা যা-ই হোক জায়গাটি কাজে লেগেছে। পানির ওপর জেগে থাকায় উত্তরমুখী হয়ে হেলিকপ্টার খুব সহজেই নেমে পড়ে। বড় মা কুঁড়িকে ওপরে থাকতেই হাত নাড়াতে দেখেছিলাম। কায়সার এবং কুঁড়ি বাঁ পাশে বসেছিল, কুশি ছিল ডান পাশে। তাই ওকে দেখিনি। কপ্টার থেকে নেমে দুই মা আমাকে জড়িয়ে ধরলে বুক ভরে গিয়েছিল। দীপ, কুঁড়ি, কুশি তিনটিই আমার কলিজার বোঁটা। ভাইয়েরা পাশাপাশি বসে নামাজ আদায় করে মসজিদের পশ্চিমে পারিবারিক কবরস্থান সামনে রেখে আমরা দুই কথা বলেছি, আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছি। স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর ছায়া হিসেবে দাঁড়াতে হবে, প্রয়োজনে তাঁর কন্যাকে হেফাজত করতে হবে এই আর কি। সঙ্গে কায়সার এবং বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর সহযোগিতা কামনা করেছি। বলার চেষ্টা করেছি, বর্তমান রাজনীতি নিয়ে কারও কারও সঙ্গে মতের ভিন্নতা থাকলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গামছার নেতা, আমাদের আদর্শ। তিনিই আমাদের রাজনীতি। পারলে আমাকে, আমার গামছাকে সহযোগিতা করতে বলেছি। লতিফ ভাইকে উদ্দেশ করে আরেকটি কথা বলেছি। বলেছি, তাঁর হাজার হাজার লাখো কর্মী-সমর্থক ছিল, এখনো আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর বক্তব্যের কেউ সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারেনি, করেওনি। তাঁর ইসলাম নিয়ে যে বক্তব্য ছিল সেটা ছিল সম্পূর্ণ একাডেমিক ডিসকাশন। ওই বক্তব্যের পর আমি মক্কার হজ সম্পর্কে বেশ কিছুদিন লেখাপড়া করেছি। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বহু কথার সঙ্গে লতিফ ভাইয়ের কথার হুবহু মিল রয়েছে। আরব আমাদের মতো সোনার দেশ ছিল না। যদিও এখন মাটির নিচে পেট্রোল পাওয়া যায়। কিন্তু আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের মাটির ওপরই সোনা দিয়েছেন। যেখানে সেখানে যা খুশি ছিটিয়ে রাখলেই সোনা ফলে। এটা সৌদিসহ আরবের মরুভূমিতে সম্ভব না। অন্যদিকে ‘জয় বাবা কেরা?’ ‘কেরা’ টাঙ্গাইলের ভাষা। ‘জয় বাবা কেরা’ এটা শুনেছেন আমার বোন। কিন্তু ‘জয় যে রাস্তার মানুষ না, বঙ্গবন্ধুর নাতি। হেলাফেলা করা চলে না’ এটা শোনেননি, তাঁকে কেউ শোনায়ওনি। ‘জয় বাবা’ বলা কি অপরাধ? ওর জন্ম ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী আমার থেকে সাত-আট বছরের বড়। আমি জয়কে কোলে নিয়েছি, পুতুলকে নিয়েছি। জয় যখন বর্ধমানে আসত ‘মামা মামা’ করত আমরা ওকে জড়িয়ে রাখতাম। আমি তো পুতুলের কাছ থেকে ইংরেজির এক পয়ার শিখেছি, Mama Mama, Are you coming or going?’ ওরা খেলাধুলা করছিল। খুব সম্ভবত তখন ওয়ানে পড়ে। ছুটে এসে হাত ধরে বলেছিল। ওর মতো যদি আমার শিক্ষক থাকত সত্যিই ইংরেজি ভাষায় আমার কোনো দুর্বলতা থাকত না। রেহানার ছোট মেয়ে অবন্তীর যখন জন্ম হয় রাত ১১টার দিকে ফোন করে বলেছিল, ‘ভাই আবার মামা হলেন। ভাগনি একটা বাড়ল।’ দুটো মা একত্র করলে তবেই মামা। মামা খুব একটা সহজ না। এসবই তো আমাকে আলোড়িত করে। তাই সব সময় ভালো থাকার চেষ্টা করি। অহর্নিশ ভাবি, কেউ যেন আমার দ্বারা প্রতারিত না হয়, ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সেজন্য সেদিন বাবা-মা, দাদা-দাদি-আত্মীয়স্বজনের কবরে গিয়ে বড় তৃপ্তি পেয়েছি, শান্তি পেয়েছি। করোনার কারণে দু-তিন বছর আমরা তেমন কোনো সাংগঠনিক কর্মকান্ড করতে পারিনি। তার পরও এত বিপুল সমাগম হয়েছিল রাস্তাঘাটে চলা যাচ্ছিল না। নিশ্চয়ই কারও না কারও হাত তোলায় আল্লাহ অবশ্য অবশ্যই খুশি হবেন, দয়া করবেন। আল্লাহর দয়া ছাড়া তেমন আর কী চাই। দেশের কর্মী হিসেবে মানুষ হিসেবে সারা জীবন আল্লাহর বান্দার সেবা করার চেষ্টা করেছি। বাকি সময়টুকু তা করতে পারলেই খুশি।

সেদিন খেয়েছিলাম বিকাল ৪টায়। প্রায় ৩০ বছর শরীরে ডায়াবেটিস বাসা বেঁধে আছে। ডাক্তাররা অনেকেই বলেন, ‘ডায়াবেটিস সব রোগের জনক-জননী। ক্যান্সারের চাইতেও খারাপ। তবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ভালো।’ বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী নেত্রকোনার জর্জ বিশ্বাসের প্রচন্ড হাঁপানি ছিল। তিনি বেশ কয়েকবার আমাকে বলেছেন, ‘বাঘা দা, হাঁপানি হয়ে আমার ভালোই হয়েছে। পান থেকে চুন খসলেই শ্বাসকষ্ট। তাই সব সময় সংযত থাকতে হয়।’ মনে হয় আমার ডায়াবেটিস হয়ে খুব একটা খারাপ হয়নি। ১৯৭৮ সালে শিলিগুড়ির হাকিমপাড়ায় থাকতে চশমা নিয়েছিলাম। চশমা নিয়ে মনে হয়েছিল আমি তো অর্ধেকেরও কম দেখতাম। মজার কথা সেই চশমার যে রিডিং ছিল, যে পাওয়ার ছিল আজও একই আছে। কোনো অদলবদল, হেরফের হয়নি। একটু যত্নে থাকা দরকার। কিন্তু সব সময় পারি কই। তাই কিছুটা কষ্ট তো হয়। বিকাল ৪টায় খাবার খেয়েছি। ঘাওগাচালার বাড়িতে মামাতো ভাই হিটলু তার পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকে। অসাধারণ খাবার ব্যবস্থা করেছিল। বেলা অত ঢলে গেলে খাবার খুব ভালো লাগে না। তবু খাবার ভালো লেগেছিল। শান্তার মা ফইলা মাছের কোপ্তা এনেছিল। সে এক অভাবনীয় উপাদান। নোবেল ও আব্বাসের বাড়ি থেকেও বেশ কয়েকটি তরকারি এসেছিল। সেখান থেকে গিয়েছিলাম সিলিমপুর মাছের খামারে। রাত সাড়ে ৮টা-৯টার দিকে বাড়ি ফিরেছিলাম। কায়সার এবং কুশি-কুঁড়ি হেলিকপ্টারে ঢাকা ফিরেছিল ৪টার আগেই। লতিফ ভাই গিয়েছিলেন রামপুরে। অনেকদিন পর তাঁকে পেয়ে রামপুরের মানুষ খুবই উৎসাহিত-উদ্বেলিত হয়েছিল। শুনলাম কোনো মাইক ছিল না। এখন তো আধুনিক জামানা। ডিসকো ড্যান্সারের লারে লাপ্পা মাইকের কারবার। ওগুলো দিয়ে সভা-সমাবেশ চলে না। আমাদের প্রচারের মাইক ছিল একটু বললেই হতো। পরে শুনেছি লতিফ ভাইয়ের সারা দিন খাওয়া হয়নি। বয়সী মানুষ অমন করা ভালো না। আকারে ইঙ্গিতে আমাকে জানালেও রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে একটা খাবার ব্যবস্থা করা মুশকিল ছিল না। রাত ৭টা-৮টার দিকে কালিহাতীর বাড়িতে খেয়ে তারা নিরাপদেই ঢাকা ফিরেছিলেন।

বড় তৃপ্তি এবং প্রশান্তি পেয়েছি বাবা-মায়ের কবরে। বাবা-মা, দাদা-দাদি, আত্মীয়স্বজনের কবরে হাজারো মানুষ ফাতেহা পাঠ করেছে। পরম দয়ালু আল্লাহর কাছে আমার কামনা, আমার বাসনা আমার পরম চাওয়া যেন তিনি বাবা-মায়ের পায়ের কাছে আমাকে মাটি নেওয়ার তৌফিক দান করেন। যেখানে জন্মেছিলাম, যেখানে আমার নাড়ি পোঁতা সেখানে চিরবিদায় নেওয়ার এ আকুতিও যে আল্লাহ পূরণ করবেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কেন জানি, অবশ্য অবশ্যই কিছুটা দুশ্চিন্তায় আছি। কারণ দেশের অবস্থা ভালো না। অনেকেই তা বুঝতে চান না। আওয়ামী লীগ নেতারা তো ননই। আর তেমন হবে না কেন? রাজনীতিতে ধীরে ধীরে নেতা হতে হয়, মানুষ হয়, ম্যাচিউর হয়। কিন্তু এখন মানুষের কাজ করে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে সাধারণ মানুষের মন জয় করে কারও ওপরে উঠতে হয় না। লেজ ধরতে পারলেই হলো। বিএনপিও এক মারাত্মক দল। নীতি নেই, আদর্শ নেই, ক্ষমতা আর ক্ষমতা। চালের দাম, তেলের দাম, নুনের দাম, কাঁচা মরিচ আবার ২০০ টাকা। কোনো কিছুর পরোয়া নেই। ক্ষমতা ক্ষমতা আর ক্ষমতা। তা-ও আবার দেশের মানুষের মন জয় করে নয়, বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়ে। একটা বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার, পৃথিবীর শক্তিধরদের অনুকম্পায় বাংলাদেশ হয়নি। আমরা তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বুকের রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করে স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে আর যা-ই হোক সারা পৃথিবীর পা ধরেও বাংলাদেশের মানুষকে জয় করা যাবে না- এটা আমি বিশ্বাস করি। তবে গায়ের জোরে রাষ্ট্রশাসন নয়, রাষ্ট্রশাসনে চাই মানুষের সমর্থন। তবে মূলত সরকারের কারণেই দেশের রাজনীতি গতিহীন হয়ে পড়েছে, মানুষ নিরুৎসাহ হয়ে গেছে। মানুষকে উৎসাহী রাখা দেশের জন্য উৎসাহিত করা এটা মূলত সরকারের কাজ। গত বছরগুলোয় সরকার কোনো নিবন্ধিত দলের সঙ্গে একবারের জন্যও দেশ নিয়ে দেশের মানুষের সুখদুঃখ আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে তেমন গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করেনি, আলোচনায় বসেনি। দেশে ৪০-৪২টি নিবন্ধিত দল। তার ২-৪-৫টি হয়তো বিএনপির সঙ্গে। তাদেরও দেশের জন্য আলোচনায় আহ্বান করা যেত। তারা না আসত সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। হওয়া উচিত ছিল। রাজনীতি থাকলে এত কিছু হওয়ার পরও বর্তমান যে হতাশা তার অনেক কিছুই থাকত না। আমি আন্তরিকভাবেই আশা করব, বোন হাসিনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশকে অন্তর দিয়ে বোঝার চেষ্টা করবেন, দেশের মানুষের চোখের ভাষা পড়তে পারবেন। বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার হিসেবে দেশকে দেশের মানুষকে অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকবেন- এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। বিদেশি চাপ ও ঝুঁকি বড় কথা নয়। বড় কথা দেশের মানুষের সমর্থন ভালোবাসা ও সহযোগিতা।

 

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর