বুধবার, ৪ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিনয় ও সরলতা

মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিনয় ও সরলতা

ইসলামে বিনয় ও সরলতা অবলম্বন হচ্ছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিনয়ের অর্থ হলো আল্লাহর অন্য বান্দাদের তুলনায় নিজেকে ছোটজ্ঞান করা এবং অন্যদের বড় মনে করা। বিনয় আল্লাহর কাছে খুবই পছন্দনীয়, এটি উচ্চ মর্যাদা লাভের একটি বিশেষ সোপান। বিনয় অবলম্বনকারী সম্পর্কে রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, কেউ যদি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য বিনয় অবলম্বন করে, তবে আল্লাহতায়ালা তার মর্যাদাকে বাড়িয়ে দেন। মুসলিম শরিফ। বস্তুত আল্লাহর খাঁটি বন্ধু হতে হলে বিনয়ী হওয়া আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে কোরআন মাজিদে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, রহমানের বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে বিনয়ের সঙ্গে চলাফেরা করে, (সুরা ফুরকান আয়াত ৬৩)। সামাজিক আচার-আচরণ, ক্রয়-বিক্রয়, বিচার সালিশ ও লেনদেনসহ সর্বপ্রকার ক্ষেত্রেই বিনয় ও কোমলতা প্রদর্শন করা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, মহান আল্লাহতায়ালা নিজেই বিনয় অবলম্বনকারী, তিনি বিনয়কে পছন্দ করেন এবং তিনি নম্রতা অবলম্বনকারীকে এত বেশি দান করেন, যা কঠোর চিত্ত ব্যক্তিকে দান করেন না, মুসলিম শরিফ। প্রকৃতপক্ষে সরলতা মুমিনের জিন্দেগির ভূষণ। পক্ষান্তরে কুটিলতা হচ্ছে পাপিষ্ঠ হওয়ার নিদর্শন। এ প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, প্রকৃত ইমানদার ব্যক্তি সরল ও ভদ্র হয়ে থাকে। আর পাপী ব্যক্তি প্রতারক নীচু ধরনের হয়ে থাকে, তিরমিজি আবু দাউদ। নম্র ব্যক্তির দিকে আল্লাহতায়ালার রহমত নেমে আসে। আর কঠোর চিত্ত ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। নম্র ব্যক্তির দিকে মানুষ আকৃষ্ট হয় আর কঠোর ব্যক্তি থেকে মানুষ দূরে সরে যায়। আল্লাহতায়ালা মানুষকে উঁচু-নিচু করে সৃষ্টি করেছেন কাউকে ধনী কাউকে গরিব, কাউকে সুন্দর কাউকে অসুন্দর, কাউকে সুস্থ কাউকে অসুস্থ, কেউ রাজা কেউ প্রজা, কেউ স্বাধীন কেউ গোলাম, কেউ শিক্ষিত কেউ অশিক্ষিত, কেউ পুরুষ কেউ নারী। এগুলো আল্লাহপাকের সৃষ্টির রহস্য ও সৌন্দর্যতা। সুতরাং রূপে-গুণে অহংকারী হয়ে অন্যকে আঘাত দেওয়া, কষ্ট দেওয়া আল্লাহতায়ালার কাছে বড় পছন্দনীয়। কেননা যিনি এসব গুণ দিয়েছেন, তিনি যে কোনো মুহূর্তে তার থেকে সব কেড়ে নিয়ে যেতে পারেন। মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, তুমি অহংকার করে জমিনে চল না। কেননা তুমি অহংকার করে পদাঘাতে জমিনকে ফেড়ে ফেলতে পারবে না এবং উচ্চতায় পাহাড়কে ডিঙাতেও পারবে না। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে এমনভাবে বসতেন যে নতুন কোনো আগন্তুক তাকে দেখে চিনতে পারত না বরং জিজ্ঞেস করত, তোমাদের মধ্যে কে মুহাম্মদ (সা.)? নবীজি সবার থেকে আলাদা হয়ে পরিচিত হওয়াকে পছন্দ করতেন না। যুদ্ধসহ যে কোনো কঠিন কষ্টকর কাজে সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে নবীজি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজে অংশগ্রহণ করতেন। বিপদ-আপদে সুখে-দুঃখে সাহাবায়ে কেরামকে ফেলে যেতেন না বরং তাদের সঙ্গেই মিশে থাকতেন। এর ফলে নবীজি সবার মধ্যে প্রিয় থেকে প্রিয়তম হয়ে গিয়েছিলেন। খাদ্য কষ্টের সময় নবীজি সব অর্ধহারি অনাহারি সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গেই একাত্মতা ঘোষণা করতেন। এবং কোনো প্রকার খাদ্যের ব্যবস্থা হওয়ার পর সবাইকে খাইয়ে তারপরই নিজে খেতেন। নবীজি বলতেন, প্রতিটি গোত্রের নেতা ওই গোত্রের খাদেম। আরবের বেদুইনরা নবীজিকে না চেনার কারণে তাঁর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করলেও নবীজি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তাদের জন্য ভালোবাসার চাদর বিছিয়ে দিতেন। ফলে সেই বেদুইন নবীজির ভালোবাসায় আবেগে আপ্লুত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করত। প্রিয় নবীর দরবারে কোনো আগন্তুক এসে নবীজিকে ভয় পেয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলে, নবীজি বলতেন তুমি নির্ভয়ে কথা বল, আমি কোনো রাজা-বাদশা নই। আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ। প্রিয় নবী (সা.) নিজের কাজ নিজেই করতেন। নিজের জামা সেলাই করতেন। নিজের জুতা সেলাই করতেন। বাজার করতেন পরিবারের প্রয়োজনে সবকিছু তিনি নিজ হাতেই করতেন। প্রিয় নবীর স্ত্রীগণ বলেন, তিনি ঘরের মধ্যে নিজের প্রয়োজনীয় সব কাজ নিজেই করে নিতেন। এ ছাড়াও স্ত্রীদের কাজে তিনি সহায়তা করতেন। এমনকি রান্নাবান্নার কাজেও স্ত্রীদের তিনি সাহায্য করতেন। যার ফলে ঘরের মধ্যে স্ত্রীদের কাছে তিনি সবার প্রিয় এবং মধ্যমণি ছিলেন। ঘরের মধ্যে স্ত্রীদের কাজের ভুলগুলোতে তিনি কখনোই রাগ করতেন না। বরং তিনি অত্যন্ত নমনীয়তার সঙ্গে তা শুধরে দিতেন। নবীজি ইরশাদ করেন তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার স্ত্রীদের কাছে উত্তম। প্রিয় নবী তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে অত্যন্ত নমনীয় ও বিনয়ের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতেন। হাদিয়া উপঢৌকন দিতেন। বিশেষ করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে অত্যন্ত নম্র ভদ্র ও নমনীয় আচরণ করতেন। ঘরের কাজের লোকদের সঙ্গে সর্বদা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। তাদের ক্ষমতার বাইরে কোনো কাজের বোঝা চাপিয়ে দিতেন না। নবীজি ইন্তেকালের সময় বলেছেন, তোমরা কাজের লোকদের প্রতি সদয়বান হও। তিনি সর্বদা তাদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন ও সৌজন্যমূলক আচরণ করতেন। নবীজি ইরশাদ করেন যে ব্যক্তি অন্যের সঙ্গে সুন্দর ও বিনয়ের সঙ্গে আচরণ করবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা কঠিন হাশরের বিচারের দিনে তার সঙ্গেও সুন্দর ও নমনীয় আচরণ করবেন। আল্লাহতায়ালা আমাদের উপরিউক্ত বিষয়গুলোতে আমল করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : খতিব, কাওলার বাজার জামে মসজিদ দক্ষিণখান, ঢাকা

সর্বশেষ খবর