বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাজনীতি কি তবে দিশাহারা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

রাজনীতি কি তবে দিশাহারা

দেশের ডলার সংকটের ভয়াবহতা ও বৈধভাবে সরকার নির্ধারিত মূল্যে ডলার ক্রয় করতে না পারার দুঃখবোধ নিয়েই মাঝ রাতে ঢাকা ছাড়তে হলো। প্লেনে বসেই আশায় বুক বাঁধলাম পাশের সিটে বসা মেয়েটির কথা শুনে। সদ্য এইচএসসি পাস করা হিজাব পরা পঞ্চগড়ের নিষ্পাপ চেহারার এই মেয়েটিকে দেখলে সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী বলে যে কারও মনে হতে পারে। মেয়েটি জীবনে প্রথম প্লেনে ভ্রমণ করছে এবং চীনের গুয়াংজু হয়ে প্লেন বদল করে আরও তিন ঘণ্টায় দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল যাবে। তারপর আবারও প্লেন বদল করে চার ঘণ্টা উড়ে পৌঁছবে নিজ কলেজে, যেখানে চার বছরে নিজস্ব খরচে শেষ করবে ‘হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট’ এর ওপর স্নাতক পর্যায়ের লেখাপড়া। কথা প্রসঙ্গে জানলাম, সে আদৌ ভীত নয়। কারণ পঞ্চগড়ের আরও ছেলেমেয়ে এর আগে একই কলেজে পড়তে গেছে এবং তারাই মেয়েটিকে বিমানবন্দর থেকে আগে থেকে ঠিক করে রাখা কলেজের হোস্টেলে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশের সবচেয়ে উত্তরে সীমান্ত ঘেরা একটি মফস্বল শহরের নিষ্পাপ চেহারার একটি শান্ত মেয়ের এমন স্বপ্নযাত্রা, সেই শহরের কিছু মানুষের হিজাবি মেয়েদের একা বিদেশে পাঠানোর মনমানসিকতা এবং আর্থিক সামর্থ্য সত্যিই আশাজাগানিয়া।

যথাসময়ে গুয়াংজুতে নামল প্লেন। দেড় ঘণ্টা পর ছাড়বে পরের প্লেন। গন্তব্য অস্ট্রেলিয়ার সিডনি। বিমানবন্দরের অপেক্ষাগারে স্টার বাকস্, ম্যাকডোনাল্ড, কেএফসির মতো পশ্চিমা উচ্চমার্গীয় খাবারের দোকানের ছড়াছড়ি। এর আগে চীনের ভ্রমণের সময়ও এমন এমন চেইন সপগুলো নজরে পড়েছিল, যেখানকার দামি খাবারগুলো কেনার ক্ষমতা সাধারণ চীনাদের নেই। মনে পড়ল আধুনিক চীনের জনক মাও সে তুংয়ের কথা। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি এবং বড় হয়ে পড়েছি, মাও সে তুং শ্রেণিহীন সমাজের কথা বলেছেন। মানসপটে ভেসে ওঠে সবার পরনে জলপাই রঙের পোশাক ও দুই হাতে সাইকেলের দুটি হ্যান্ডেল ধরা সুশৃঙ্খল একটি বিশাল আকারের জনশক্তির কথা। ভাবছিলাম মাওকে কি চোখে দেখেন চীনে কেএফসি কিংবা ম্যাকডোনাল্ড যুগের বর্তমান প্রজন্ম? গুয়াংজু চীনের অন্যতম বাণিজ্য ও শিল্পাঞ্চল। অর্থনীতির আকার বড় হলে অবকাঠামোর আকার কত বড় করা প্রয়োজন, তার উদাহরণ এই গুয়াংজু বিমানবন্দর। দেড় শতাধিক বিমানে ওঠানামা করা যাত্রী ও মালামাল ব্যবস্থাপনার সুন্দর আয়োজন রয়েছে বিমানবন্দরে। রানওয়েতে চলমান ও যাত্রী ওঠানামা স্থানে দণ্ডায়মান প্লেনের বহর দেখে বাংলাদেশের মহাখালী, যাত্রাবাড়ী কিংবা গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের কথা মনে পড়ে। সেখানে যেমন বাস দাঁড়িয়ে থাকে, তেমনি প্লেন দাঁড়িয়ে থাকে গুয়াংজু বিমানবন্দরে। পরম মমতায় গুয়াংজু বিমানবন্দরের কর্মীরা তুলে দিলেন পরের বিমানে। আবারও প্রায় ২৫০ জন যাত্রী নিয়ে সাড়ে নয় ঘণ্টার জন্য অস্ট্রেলিয়ার সিডনির পথে উড়াল দিল চায়না সাউদার্নের ফ্লাইট নং সি জেড ৩০১ এয়ার বাস। এবার নজরে পড়ল নেপালের যাত্রীর আধিক্য। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘদিন চাকরি করেছি। কিন্তু নেপালিদের এমন আধিক্য চোখে পড়েনি। পরে জেনেছি নেপালের সরকার অস্ট্রেলিয়ার সরকারের সঙ্গে বিশেষ সমঝোতা করে নেপালিদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেটের সঠিকতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং শতভাগ ক্ষেত্রে সেই সার্টিফিকেটের বিশুদ্ধতা বারবার প্রমাণিত হওয়ার কারণে নেপালিরা চাকরি ও বৈধভাবে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসের অবাধ সুযোগ পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল কয়দিন আগে একটা খবর। সংযুক্ত আরব আমিরাতে শত শত ভুয়া শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট নিয়ে চাকরিতে প্রবেশের প্রেক্ষাপটে চরম আতঙ্কে রয়েছে দুবাইসহ বিভিন্ন এলাকায় কর্মরত একশ্রেণির প্রবাসী বাংলাদেশি ও নতুন চাকরিপ্রত্যাশী বাংলাদেশি নাগরিক। এক সময় শতভাগ ভুয়া সার্টিফিকেট জমা ও সত্যায়িত করে চাকরির বাজারে প্রবেশের কারণে এখন দক্ষ শ্রমিকদেরও নতুন ভিসা প্রদান বা পুরনো ভিসা নবায়নে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। একশ্রেণির নির্দয় মানুষের নিকৃষ্ট কাজের কারণে আজ জাতিগতভাবে আমাদের লজ্জায় পড়তে হয়েছে।

প্লেনে বসেই হাতে নিলাম চীনের জনপ্রিয় একটি ইংরেজি পত্রিকা। ‘জাপানস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পলিসি’সহ আরও কিছু সূত্রের বরাতে পত্রিকার শীর্ষ খবরে লেখা হয়েছে, আমেরিকার তুলনায় চীনের গবেষকদের লেখা গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও প্রশংসিত সাময়িকীতে বেশি প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছরব্যাপী প্রকাশিত গবেষণাপত্রের ওপর জরিপ চালিয়ে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী প্রকাশিত মোট গবেষণাপত্রের ২৭.২% লিখেছেন চীনের গবেষকরা, যেখানে আমেরিকার গবেষকরা লিখেছেন ২৪.৯ শতাংশ গবেষণাপত্র। সামরিক ও বাণিজ্যিক দ্বৈরথের পাশাপাশি বিদ্যাবুদ্ধি চর্চার এমন সুস্থ প্রতিযোগিতা, যা কেবল দুটি দেশই নয়, পৃথিবীকেও রং, রস ও রূপে সমৃদ্ধ করবে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ পৃথিবীর ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ও জনসংখ্যার বিচারে অষ্টম স্থানে থাকলেও এ দেশের শিক্ষাবিদ গবেষক ও বুদ্ধিজীবীরা আজ ‘সাদা সাদা কালা কালা’ কোরাস কিংবা লাল সবুজের পালা নিয়ে ব্যস্ত। জনগণ ও দেশের জন্য তারা এতই ব্যস্ত যে, গবেষণার সময় নেই কারও হাতে। গবেষণার নামে টাকা নিয়ে মেরে দেওয়া ও অন্যের গবেষণা কাট অ্যান্ড পেস্ট করে নিজের নামে চালিয়ে দিতে বেশ হাতপাকা আমাদের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীর। এমনকি বাচ্চাদের পাঠ্যপুস্তক রচনার ক্ষেত্রেও কাটপিস করে টাকা নিতে দেখা যায় একশ্রেণির শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের। অথচ তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা বা জবাবদিহিতায় আনার কোনো খবর আর জানা যায়নি।

পুরো সাড়ে ৯ ঘণ্টার যাত্রা পথে তিনবার খাবার ও দুবার নাশতা পরিবেশনসহ মন-প্রাণ উজাড় করে যাত্রীদের সেবা দিয়েছিল বিমানের কর্মীরা। সব দেশের সব বয়সী মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য সামনের সিটের পেছনের স্ক্রিনে নানা রকম মুভি সিরিয়াল, ড্রামা, ডকুমেন্টারি, মিউজিক ও কার্টুন ও গেমস দেখার বিশাল আয়োজন ছিল চোখে পড়ার মতো। যথাসময়ে বিমান নামল সিডনি বিমানবন্দরে। ঢাকা বিমানবন্দরের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে সিডনি বিমানবন্দরের তুলনা করলে বেশ কষ্ট পেতে হবে। তবে নতুন তৃতীয় টার্মিনাল ঘুরে দাঁড়ানো বাংলাদেশের প্রতিবিম্ব হয়ে উঠবে বলেই সবার মতো আমিও প্রত্যাশা করি। সিডনি বিমানবন্দরে একটা বিষয় বেশ লক্ষ্যণীয়। অস্ট্রেলিয়া সরকার সে দেশের মাটি, উদ্ভিদ ও পরিবেশ রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই কোনো অবস্থায় অন্য দেশের মাটি, বীজ, গাছ-গাছালি, রান্না করা মাছ কিংবা গোস্ত নিয়ে ঢোকার কোনো জো নেই। এসব নিয়ে ঘোষণা না দিয়ে গোপনে প্রবেশ করার বিপরীতে যে কোনো সময় ভিসা বাতিল করা হতে পারে মর্মে সতর্কবার্তা লাগানো আছে বেশ কিছু জায়গায়। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে বারবার ঘোষণা দিয়ে মনেও করিয়ে দেওয়া হয় এ নিষেধাজ্ঞার কথা। তাই সহজে এসব নিয়ে যাওয়ার সাহস না করাই ভালো।

বিমানবন্দর থেকে বের হতেই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল একমাত্র কন্যা। শত অপ্রাপ্তির মাঝেও বাংলাদেশের মানুষে মানুষে আন্তরিকতার ঐশ্বর্য অবাক করার মতো। যদি আন্তরিকতা বিচারের কোনো মানদণ্ড থাকত, তবে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ হতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। নিজের গাড়িতে করে বিমানবন্দর থেকে বাসায় নিয়ে যেতে যেতে বড় বোনের বড় পুত্র-ভাগ্নে ফোড়ন কাটল, ‘যাক, স্যাংশন-ট্যাংশন না খেয়ে তাহলে আসতে পারলেন অস্ট্রেলিয়া’। হেসে উত্তর দিলাম ‘মামা-ভাগ্নে যেখানে, বিপদ নাই সেখানে’। ভাগ্নের পাল্টা প্রশ্ন- ‘এটা সত্যি কথা। তবে বাংলাদেশের মামা হতে এত বড় বড় দেশগুলোর এত খায়েশ কেন?’ না, ভাগ্নের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম না। পরিবেশ হালকা করার জন্য গাড়িতে বাংলা গান ছাড়ল ভাগ্নে। হেমন্তের ভরাট গলায় বেজে উঠল- “আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা- আর কতকাল আমি রবো দিশেহারা। জবাব কিছুই তার দিতে পারি নাই শুধু- পথ খুঁজে কেটে গেল, এ জীবনও সারা...। নিজের ছায়ার পিছে- ঘুরে ঘুরে মরি মিছে, একদিন চেয়ে দেখি- আমি তুমি হারা।” মনে মনে প্রশ্ন জাগল, বাংলাদেশের রাজনীতি কি তবে দিশাহারা? আবারও ‘লুকিং ফর শত্রুস’ বলে নিজের ছায়ার সঙ্গেই কি যুদ্ধ করছেন আমাদের নেতারা? পরাশক্তি তথা মামা নির্বাচনে ভুল করলে বাকিদের সঙ্গে কি ‘আমি তুমি হারা’ অবস্থায় চলে যাবে বাংলাদেশ? কী হবে সে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পরিণতি?

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর