বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আত্মীয়তার সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ইসলামে

আবদুর রশিদ

ইসলামে আত্মীয়তার সম্পর্ককে অসামান্য মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আসমানি কিতাবসমূহের তথ্যমতে, মানব জাতির সবাই প্রথম মানব ও মানবী হজরত আদম ও হাওয়া (আ.)-এর উত্তরসূরি। এ অর্থে এক মানুষ অন্য মানুষের আত্মীয়। সার্বিক বিবেচনায় আত্মার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মীয় বলা হয়। এটি রক্তের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেমন হতে পারে, তেমন বৈবাহিক সম্পর্কের কারণেও হতে পারে। ইসলামে আত্মীয়তা বিশেষত রক্তের সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আল-কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মানব জাতি! তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একটি প্রাণ থেকে। আর সে একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া। তারপর তাদের দুজনার থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। সেই আল্লাহকে ভয় কর, যার দোহাই দিয়ে তোমরা পরস্পরের কাছ থেকে নিজেদের হক আদায় করে থাক এবং আত্মীয়তা ও নিকট সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে বিরত থেক। নিশ্চিতভাবে জেনে রেখো, আল্লাহ তোমাদের সব কর্মকাণ্ড সূক্ষ্মভাবে প্রত্যক্ষ করছেন’ (সুরা নিসা-১)। আল কোরআনের আরও কিছু আয়াতে আত্মীয়তার বিষয়টি আলোকপাত করা হয়েছে। ‘আল্লাহ ন্যায়নীতি, পরোপকার ও আত্মীয়স্বজনদের দান করার হুকুম দেন এবং অশ্লীলতা, দুষ্কৃতি ও অত্যাচার-বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা লাভ করতে পার’ (সুরা নাহল-৯০)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘কাজেই (হে মুমিনগণ!) তোমরা আত্মীয়দের তাদের অধিকার দাও এবং মিসকিন ও মুসাফিরকে (দাও তাদের অধিকার)। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে তাদের জন্য এটা উত্তম এবং তারাই সফলকাম হবে’ (সুরা রুম-৩৮)। হাদিসেও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের রিজিক প্রশস্ত ও নিজের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি হওয়া পছন্দ করে সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে’ (বুখারি, মুসলিম)। তিনি আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ইমান রাখে সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ইমান রাখে সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের জীবনে বিশ্বাসী সে যেন ভালো কথা বলে, অন্যথায় চুপ থাকে’ (বুখারি, মুসলিম)। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখলে জাহান্নাম থেকে দূরে থাকা যাবে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট সাহাবি আবু আইউব খালেদ (রা.) বলেছেন, ‘এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসুল! আমাকে এমন একটি কাজ সম্পর্কে অবহিত করুন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে ও জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহর ইবাদত করতে থাক, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুর শরিক কর না। নামাজ কায়েম কর, জাকাত আদায় কর ও আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখ’ (বুখারি, মুসলিম)। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না’ (বুখারি, মুসলিম)।

আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে সবচেয়ে নিকটতম হলো পিতামাতা। কাফির-মুশরিক পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের সুসম্পর্ক বজায় রাখা বৈধ। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তবে পৃথিবীতে তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে বসবাস করবে’ (লোকমান ৩১/১৫)।

আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে আমার মা মুশরিক অবস্থায় আমার কাছে এলেন। আমি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ফতোয়া জিজ্ঞেস করলাম, আমার মা আমার কাছে এসেছেন, তিনি আমার প্রতি খুবই আগ্রহী, এমতাবস্থায় আমি কি তার সঙ্গে সদাচরণ করব? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে সদাচরণ কর’।

বংশীয় দিক দিয়ে নিকটাত্মীয় হচ্ছেন পিতা-মাতা। তবে এর মধ্যে মায়ের স্তর ঊর্ধ্বে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আমরা তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। জননী সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই কাছে’ (লোকমান ৩১/১৪)। হাদিছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক লোক রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রসুল (সা.)! আমার কাছে কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিক হকদার? তিনি বললেন, ‘তোমার মা’। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, ‘তোমার মা’। সে বলল, অতঃপর কে? তিনি বললেন, ‘তোমার পিতা’।

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের ওপর হারাম করেছেন মায়ের অবাধ্যতা বা নাফরমানি, কন্যা সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা, কারও প্রাপ্য না দেওয়া এবং অন্যায়ভাবে কিছু নেওয়া। আর অপছন্দ করেছেন অনর্থক বাক্যব্যয়, অধিক প্রশ্ন করা এবং মাল বিনষ্ট করা’।

আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখা অন্যায়ের শামিল। সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রবণতাও ইসলামের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘ওই ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনকারী নয়, যে আত্মীয় তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেও ছিন্ন করে। বরং আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনকারী ওই ব্যক্তি, যার সঙ্গে তার আত্মীয় সম্পর্ক ছিন্ন করার পরও সে পুনরায় তা স্থাপন করে’ (বুখারি)। আল্লাহ আমাদের সবাইকে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার তৌফিক দান করুন।

লেখক : ইসলাম বিষয়ক গবেষক

সর্বশেষ খবর