শনিবার, ৭ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ওমানের সালালায় প্রবাসী বাংলাদেশির কৃষি আয়োজন

শাইখ সিরাজ

ওমানের সালালায় প্রবাসী বাংলাদেশির কৃষি আয়োজন

মধ্যপ্রাচ্য বলতেই আমরা জেনেছি ধু-ধু মরুভূমি, পাথুরে অনুর্বর মাটি, ধূসর চারপাশ। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই সেই অনুর্বর মরুর বুকে কৃষির সূচনা প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের হাত ধরেই। আমি একাধিকবার তুলে ধরেছি সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার এবং ওমানে বাংলাদেশিদের কৃষি কার্যক্রম। অনেকেই শ্রমিক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে কৃষিকে ঘিরে হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা। মনে পড়ে বরিশালের মঠবাড়িয়ার রাজ্জাকের কথা। যিনি মরুর বুক থেকে পাথর সরিয়ে সেখানে ছড়িয়ে দিয়েছেন ফসলের চাষ। মরুর বুকে গড়ে তুলেছেন মাঠের পর মাঠ সবজির খেত। আর চট্টগ্রামের ফরিদ তো কাতারে গাধা দিয়ে হালচাষ করে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। শ্রমিক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি এক টুকরো জমি লিজ নিয়ে ভাবলেন কৃষি কাজ করবেন। তার কথা শুনে সবাই বোকা ভাবল তাকে। মরুর পাথুরে ভূমিতে ফসল হয় নাকি! কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। আরবীয় মালিকের কাছে আবদার করতেই থাকলেন, ‘একটু জমি দেন আমি চাষাবাদ করব’। শেষে আরবীয় শেখ ভাবলেন এক টুকরা জমি দিয়ে দিই যা ইচ্ছা করুক। ফরিদ জমি পেয়ে খুশি হলেন ঠিকই, কিন্তু জমিতে গিয়ে দেখেন পাথর আর পাথর। একটা একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে জমা করলেন। হাল দেওয়ার লাঙল নেই, নেই গরু। লোহার পাইপ দিয়ে লাঙল বানিয়ে গাধা দিয়ে হালচাষ করে সেই জমিতেই ফসল ফলালেন তিনি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সফলভাবেই মরুর বুকে সবুজ ফসল ফলালেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে ওমানে গিয়ে পরিচয় হলো এমনই একদল কৃষি উদ্যোক্তার সঙ্গে, তারা বিস্তার করেছেন কৃষি বাণিজ্যের বিশাল খাত। ওমানের বারাকাহ এলাকার এক সময়ের নুড়ি-পাথর আর বালুকাময় ধু-ধু মরু অঞ্চল সবুজে ঢেকে দিয়েছেন বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্যোক্তা নাজিমুদ্দিন, শিহাবুদ্দিন, কামালুদ্দিন এবং এনামুদ্দিন। এই সহোদর ভাইয়েরা সাধারণ শ্রমিক হিসেবেই ওমানে গিয়েছিলেন। কিন্তু মনেপ্রাণে কৃষিকে লালন করেন বলেই মরুর বুক কৃষিকে ঘিরে গড়ে তুলেছেন বিশাল বাণিজ্যিক কৃষি খামার। হয়ে উঠেছেন বড় কৃষি উদ্যোক্তা। পাঠক, তাদের কথা আমি এর আগে আপনাদের বলেছি। এবার বলতে চাই ওমানের সালালাহর এক কৃষি উদ্যোক্তার কথা।

আরব সাগরের পাশে ওমানের সালালার হাফা নামের অঞ্চলটি ওমানের অন্য অঞ্চলের তুলনায় অনেকটাই সবুজ। ওখানকার মাটি তুলনামূলক উর্বর ও চাষ উপযোগী। মাটির উর্বরতার গুরুত্বটি অনুধাবন করেই অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি সেখানে সূচনা করেছেন কৃষি কাজের। আগেই বলেছি, প্রবাসী বাংলাদেশিরা সাধারণত অন্য পেশায় যুক্ত হয়ে ওমান বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যান। কিন্তু কৃষি ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে তারা যেখানেই গেছেন বিস্তার ঘটিয়েছেন কৃষির। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ভাগ্যের সন্ধানে শ্রমিক হিসেবে মারুফ হোসেন ওমানের সালালায় গিয়েছিলেন প্রায় এক দশক আগে। কিন্তু জীবনের নানারকম চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সাফল্যের খোঁজ পেয়েছেন কৃষি খামারেই। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। চোখে-মুখে দারুণ তারুণ্য লেগে আছে। তার খামারে হাঁটতে হাঁটতে কথা হয়। বলছিলেন, ‘শ্রমিক হিসেবে আসছি। চার মাস কাজ করেও বেতন পাই নাই। চাকরি ছেড়ে দিলাম। পকেটে নাই টাকা। থাকার জায়গা নাই। খাবার নাই। অনেক টাকা খরচ করে এসেছিলাম। ফিরে যাওয়ারও কোনো সুযোগ ছিল না। চার দিন থেকেছি মসজিদে। ব্যাগটা রাখার মতো জায়গাও ছিল না। এক ওমানি আমাকে কাজ দিলেন। কাজ করতে করতে ভাবতাম কী করলে দিন পাল্টাবে। একদিন মাথায় কৃষির চিন্তা আসল। এক টুকরা জমি লিজ নিয়ে শুরু করলাম চাষাবাদ। সেই থেকে শুরু। ধীরে ধীরে এখন ১১ বিঘার এই খামার।’

এই খামারটিই পাল্টে দিয়েছে মারুফের জীবন। নিজের পাশাপাশি এখন আরও অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছেন তিনি। তবে সব সময় মনে রাখেন নিজের জীবনের সংগ্রামের কথা।

খামারে চাষ হচ্ছে নানারকম সবজির। আছে আখ, কলা থেকে শুরু করে পানের চাষও। সবজি উৎপাদনের পাশাপাশি এবারই প্রথম পোলট্রি খামার গড়েছেন মারুফ। পোলট্রিতেও লাভের আশা করছেন তিনি। মারুফ জানালেন তার খামারে উৎপাদিত সবজি বিক্রি হয় সালালাহর বাংলা মার্কেটে। সালালায় নিজেদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য নিয়ে আলাদা বাজার গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশিরা। সেটিও যেন এক টুকরো বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি। সেখানে গেলে মনে হয় না ওমানের কোনো বাজার, মনে হয় বাংলাদেশেরই কোনো কাঁচাবাজারে দাঁড়িয়ে আছি। মারুফের মতো অনেকেই কৃষিতে যুক্ত হচ্ছেন ওমানে। বিনিয়োগ করছেন কষ্টে অর্জিত অর্থ। সেক্ষেত্রে ওমান সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের নীতিগত সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করছেন তারা। এর আগে আরেক কৃষি উদ্যোক্তা ওমানের বাকারার নাজিমুদ্দিনও বলেছিলেন দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে এই কৃষি উদ্যোগগুলো আরও ভালো করে পরিচালনা করা সম্ভব। এতে কৃষি বাণিজ্যের একটা নতুন সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। কৃষিতে বিনিয়োগ বিষয়ে কথা হয় ওমান প্রবাসী ব্যবসায়ী সিআইপি ইয়াসিন চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হলেও অনেক বিষয় রয়ে গেছে যেগুলো সরকারের সঙ্গে সরকারের চুক্তির মাধ্যমে সহজ করা যায়। যেমন কোম্পানি তৈরির লাইসেন্স পাওয়া যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু জমি লিজ নেওয়ার ব্যাপারে দীর্ঘ সময়ের জন্য জমি লিজ না পাওয়া গেলে কৃষি বাণিজ্যের সাফল্য তুলে আনা সম্ভব হবে না।

বর্তমান সময়ে কৃষিতে সফলতা যেমন আছে, আছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকি। কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষমাত্রই টের পাচ্ছেন এর ভয়াবহতা। মারুফ হোসেনও বলছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খামারে নতুন নতুন পোকা-মাকড়ের উপদ্রব বাড়ছে। যা বছর তিনেক আগেও ছিল না।

খামারেই কৃষি শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা রেখেছেন মারুফ। আছে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও। কথা হলো কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে। তারা বললেন, বিদেশের মাটিতে এসেও কৃষির সঙ্গে থাকতে পেরে কাজটা তাদের জন্য সহজ হয়েছে। একেবারে দেশের পরিবেশেই আছেন এমন মনে হয়।

মারুফের খামারের ভালো উৎপাদনের পেছনে রয়েছে প্রতিটি কর্মীর নিরলস প্রচেষ্টা। উদ্যোক্তারাও মনে করেন কর্মীরা ভালো থাকলেই খামারের ফলনে আসবে গুণগত পরিবর্তন, বাড়বে উৎপাদন।

নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিদেশে টিকে থাকার লড়াই করছেন। অর্জন করছেন সাফল্য। তা থেকেই বাড়ছে রেমিট্যান্স আয়। বিদেশের মাটিতে কাজ করে যাওয়া প্রতিটি মানুষ নিজের শ্রমের বিনিময়ে ভালো রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন দেশের স্বজনদের। ব্যক্তিপর্যায়ে প্রবাসীদের এই উদ্যোগগুলো বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের কৃষি বাণিজ্যের পথ তৈরি করছে। সুপরিকল্পনা ও নীতিগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সরকার এগিয়ে এলেই এই পথ আরও প্রশস্ত হবে। বাড়বে বৈদেশিক আয়। এ ক্ষেত্রে কৃষি গবেষণা ও কৃষিশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোরও এগিয়ে আসা উচিত। ‘কৃষিজ্ঞান বাণিজ্যে’র একটি খাতও এখানে বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর