সোমবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

দেশে কি একজন এসিল্যান্ডই ঘুষ নেন?

প্রভাষ আমিন

দেশে কি একজন এসিল্যান্ডই ঘুষ নেন?

সম্প্রতি গণমাধ্যমে একটা শিরোনাম দেখে একটু চমকে গেলাম, ‘ঘুষ নির্ধারণ করে দেওয়া সেই এসিল্যান্ড বরখাস্ত’। খবরটি এরই মধ্যে আপনারা সবাই জেনে গেছেন, তাই বিস্তারিত বলার দরকার নেই। খালি একটু মনে করিয়ে দিই পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার এসিল্যান্ড মাসুদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে সম্প্রতি। তার ‘অপরাধ’ তিনি জমি নামজারির ঘুষের রেট নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। যে বৈঠকে তিনি ঘুষের রেট ঠিক করে দিয়েছিলেন, পরে তার অডিও ভাইরাল হলে তিনি বিপাকে পড়ে যান।  এমনিতে জমি খারিজ বা নামজারি করতে সরকার নির্ধারিত খরচ ১ হাজার ১৭০ টাকা হলেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভূমি কার্যালয়গুলোর কর্মকর্তারা দলিল ভেদে নেন ৫ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। মাসুদুর রহমান সবার সঙ্গে আলোচনা করে সেটা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন ৬ হাজার টাকা।

খবরটি পড়ে নিশ্চয়ই আপনারা মাসুদুর রহমানের ওপর খুবই ক্ষিপ্ত হয়েছেন। তাকে বরখাস্ত করাই ঠিক হয়েছে মনে করছেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, অডিওটি শুনে এবং খবর পড়ে মাসুদুর রহমানের উদ্যোগকে আমার খারাপ লাগেনি। বরং মনে হয়েছে তিনি ঘুষের বিশৃঙ্খল বাজারে একটা শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করেছেন। এমনিতে বাংলাদেশে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। হলেও এত সময় আর ধৈর্য লাগে, তাতে ঠিক পোষায় না। তার চেয়ে ঘুষ দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া অনেক লাভজনক। প্রকাশ্যে একটি জাতীয় দৈনিকে ঘুষের পক্ষে লিখছি বলে নিশ্চয়ই আমার ওপরও ক্ষিপ্ত হচ্ছেন। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, জীবনে ঘুষ খাননি বা ঘুষ দেননি, এমন কাউকে চেনেন আপনি। মুখে মুখে আমরা যত আদর্শলিপি পাঠ করি না কেন, ভিতরে ভিতরে আমাদের সমাজ অনেক আগে বদলে গেছে। ঘুষ-দুর্নীতি এখন অনানুষ্ঠানিকভাবে সামাজিক বৈধতা পেয়ে গেছে। বাংলাদেশে সৎ সরকারি কর্মকর্তা নেই, এমন দাবি আমি করছি না। কিন্তু সৎ মানুষের এখন টিকে থাকাই মুশকিল। মাসুদুর রহমান হয়তো অতিষ্ঠ হয়ে ঘুষের রেট ঠিক করে দিয়েছেন। অনেক অফিসে রেট আগে থেকেই ঠিক করা আছে। কে কতটুকু পাবেন, তাও নির্ধারিত। এর মধ্যে কেউ ঘুষের ভাগ নিতে না চাইলে, অন্যরা বিব্রত হন, তাকে বদলি করতে উঠেপড়ে লাগেন।

কয়েকদিন আগে ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতে একটা নাটকের ছোট্ট ক্লিপ দেখা হয়ে যায়। মিনিট দুয়েকের ক্লিপ। দুই জামাই ঈদের ছুটিতে শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। বড় জামাই দুর্নীতিবাজ, এসেছেন বড় গাড়ি নিয়ে। ছোট জামাই সৎ চাকরিজীবী, এসেছেন ব্যাটারিচালিত রিকশায়। শ্বশুরবাড়ির গেটেই দুই পক্ষের লেগে যায়। ছোট বোন তার দুলাভাইয়ের মুখের ওপর বলে দেন, আপনি একটা অসৎ, দুর্নীতিবাজ। জবাবে বড় জামাই বেশ গর্বের সঙ্গে বলেন, দুর্নীতিবাজ হতেও যোগ্যতা লাগে। তোমার জামাইয়ের সেটা নেই। শ্বশুরবাড়িতে ঢোকার পরও দুজনের কদর হলো আলাদা। শ্বশুর-শাশুড়ি দুর্নীতিবাজ বড় জামাইয়ের আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। সৎ ছোট জামাইয়ের দিকে কারও খেয়ালই নেই। ২ মিনিটের ছোট নাট্যাংশেই দারুণভাবে উঠে এসেছে আমাদের সমাজের চিত্র। দুর্নীতিবাজরা এখন সমাজে বুক ফুলিয়ে চলে। নিজের দুর্নীতি করার যোগ্যতার জানান দেয়। ঘরে-বাইরে-সমাজে দুর্নীতিবাজের থাকে আলাদা কদর। সৎ পথে চলার যে শিক্ষা আমরা ছেলেবেলায় পাই, বাস্তবজীবনে তার কোনো প্রয়োগ নেই। সর্বত্রই দুর্নীতিবাজদের রমরমা। যে শিক্ষকরা আমাদের নীতিকথা শেখান, ঢাকায় শিক্ষাভবনে এলে তাকেও ঘুষ দিয়ে কাজ করাতে হয়। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, দুজনই তো সমান অপরাধী বলে জেনেছি। ঘুষ নেওয়া যদি অপরাধ হয়, ঘুষ দেওয়াও তো অপরাধ। বলুন তো আপনারা কে অন্তত ঘুষ দেওয়ার অপরাধটি করেননি? একসময় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক রিপোর্টে দুর্নীতিতে আমরা চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। ইদানীং আর চ্যাম্পিয়ন হই না বটে, তবে অবস্থার খুব হেরফের হয়নি। বরং দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

বাংলাদেশে ৯০ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ইসলাম ধর্মে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলা আছে। কিন্তু তবুও বাংলাদেশে দুর্নীতি হয় বেশি। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মানুষ হজে যায়। খোঁজ নিলে দেখবেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ হজযাত্রী বয়স্ক। অথচ হজ একটি পরিশ্রমসাধ্য ইবাদত। সামর্থ্য থাকলে কম বয়সে হজে যাওয়াই উত্তম। কিন্তু বাংলাদেশের অনেক মানুষ সামর্থ্য হলেও হজে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। অনেকেরই বিশ্বাস- পবিত্র মক্কা শরিফে গিয়ে হজরে আসওয়াদে চুমু খেতে পারলে সারা জীবনের সব পাপ মুছে যাবে। যারা এই বিশ্বাস করেন, তারা হজের জন্য অপেক্ষা করেন। সারা জীবন মানুষ ঠকিয়ে, জমি দখল করে, অন্যের হক মেরে, ঘুষ খেয়ে, দুর্নীতি করে টাকা কামাই করেন। আর অপেক্ষা করেন শেষ জীবনে হজ করে সব পাপ মুছে ফেলবেন। হজ করে এসে আর কোনো পাপ করবেন না। এমন গল্পও শুনেছি, সারা জীবন উপরি আয়ে চলেন। আর বেতনের টাকাটা আলাদা করে রাখেন হজ করবেন বলে। অন্তত হজটা সৎ পথে উপার্জিত অর্থে করতে চান। অজু করার অনেকে আর ঘুষের টাকা স্পর্শ করতে চান না। ড্রয়ার খুলে দেন, যাতে টাকাটা সরাসরি সেখানে রাখা হয়। এমন পরিকল্পিতভাবে দুর্নীতি করে, শেষ জীবনে হজ করলে তার হজ কবুল হবে কি না, সারা জীবনের সব পাপ এক লহমায় মুছে যাবে কি না; সেটা মহান আল্লাহ জানেন। দুর্নীতি করে অঢেল অর্থ কামাইয়ের পর অনেকে গ্রামে মসজিদ বানান বা মসজিদে বড় অনুদান দেন। মসজিদে তার নামে বড় মারহাবা হয়। সেই দুর্নীতিবাজের আশা, কেয়ামত পর্যন্ত এই মসজিদে যারা নামাজ পড়তে আসবেন, তাদের সওয়াবের একটা অংশ তিনি পাবেন। দুর্নীতির টাকায় বানানো মসজিদ থেকে আদৌ সেই দুর্নীতিবাজ সওয়াব পাবেন কি না, সেটাও আল্লাহ জানেন। ছেলেবেলায় স্কুলে এক ধর্ম শিক্ষক এক কোরবানির ঈদের আগে আমাদের বিপদে ফেলে দিলেন। তিনি ক্লাসে প্রশ্ন করলেন, কোরবানি দিলে তো সওয়াব হয়। আমরা সবাই বললাম, জি স্যার। এবার তিনি প্রশ্ন করলেন, গরু চুরি করলে তো গুনাহ হয়। আমরা আবার সবাই বললাম, জি স্যার। এবার তিনি বললেন, ধর, একজন যদি একটা গরু চুরি করে কোরবানি দেয়, তাহলে গুনাহ আর সওয়াবে কাটাকাটি হয়ে যাবে। মাঝখানে মাংসটা লাভ। আমরা বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। অঙ্ক তো পরিষ্কার, গুনাহ আর সওয়াবে কাটাকাটি, মাঝখানে মাংসটাই লাভ। শিক্ষক এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, চুরির গরুতে কোরবানি হয় নারে গাধার দল। আসলে এক মণ দুধ নষ্ট করার জন্য এক ফোঁটা চনাই যেমন যথেষ্ট। একজন দুর্নীতিবাজের সব অর্থই অবৈধ। সৎ পথে উপার্জন আর অসৎ পথে উপার্জন বলে আলাদা কিছু নেই। দুর্নীতিবাজের হজও কবুল হবে না, মসজিদের সওয়াবও তার অ্যাকাউন্টে জমা হবে না।

বাংলাদেশের পুরো সিস্টেমটা এখন এমন হয়ে গেছে, চাইলেও কারও পক্ষে দুর্নীতিমুক্ত জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। ব্যক্তিজীবনে আপনি যত সৎই হোন না কেন, সিস্টেম আপনাকে আপস করতে বাধ্য করবে। আপনি যদি মনে করেন, কোথাও আপনি ঘুষ দেবেন না। আপনার কোনো কাজই হবে না। নিজে দুর্নীতি না করলেও আপনাকে ঘুষ দিয়ে কাজ করাতে হবে। বাংলাদেশে এখন দুর্নীতির সংজ্ঞা ও ধারণা পাল্টে গেছে। কেউ যদি ঘুষ নিয়ে আপনার কাজটা করে দেয়, আপনি তার প্রতি কৃতজ্ঞই থাকবেন। কিন্তু এখন অবস্থা এমন হয়েছে, ঘুষ নিয়েও কাজটা করে দেয় না, এমনকি ঘুষের টাকা ফেরতও দেয় না। হয়তো সেই ঘুষখোর এমন প্রভাবশালী, তার কাছে আপনি টাকা ফেরত চাইতেও পারবেন না।

সমাজে দুর্নীতিটা এখন গ্রহণযোগ্য হয়ে গেছে। দুর্নীতি করে কামানো টাকাই সেই দুর্নীতিবাজের সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণ করছে। ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়া মানুষ চলেন সমাজের উঁচুতলায়। দুর্নীতিবাজ চিনতে আপনার দুর্নীতি দমন কমিশনে যেতে হবে না। একটু চোখ-কান খোলা রাখলে, আর সহজ অঙ্ক জানলে, আপনি দুর্নীতিবাজ চিনতে পারবেন। হয়তো আপনার পাশেই বসে আছেন। বেতন পান ৫০ হাজার টাকা, বাসা ভাড়া দেন ৬০ হাজার টাকা, ছেলেমেয়ে পড়ে দামি স্কুলে, পার্কিংয়ে থাকে চকচকে গাড়ি। আপনি অঙ্ক জানলে তাকে চিনবেন। কিন্তু কিছু বলতে পারবেন না। কারণ দুর্নীতি করে কামানো টাকায় তিনি মর্যাদা কিনেছেন, ক্ষমতা কিনেছেন। আপনি তার কাছে চুনোপুঁটি। কারও কারও অবশ্য চক্ষুলজ্জা আছে। আমার এক পরিচিত লোক আছেন, ছোটখাটো সরকারি চাকরি করেন। জমি, ফ্ল্যাট কেনার যা খবর পাই, তাতে শত কোটি ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু লোকজনের চোখ পড়ে যাওয়ার ভয়ে গাড়ি কেনেন না। শত কোটি টাকার মালিক, কিন্তু চড়েন রিকশায়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ড্রাইভারের শত কোটি টাকার হিসাব তো আপনাদের সবার জানা। কেউ কি কখনো সেই ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করেছেন, আপনি এত টাকা পেলেন কোথায়?

দুর্নীতির এই সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাই দুর্নীতি ঠেকানোর পথে সবচেয়ে বড় বাধা। সম্প্রতি দুর্নীতি মামলার এক রায়ের পর্যবেক্ষণে এক বিচারক বলেছেন, ‘রায় দিয়ে সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করা সম্ভব নয়। দুর্নীতিগ্রস্তদের সমাজ থেকে বয়কট করতে হবে। তাদের সঙ্গে চলাফেরা করবেন না, আত্মীয়তা করবেন না। তাদের কাছে ছেলেমেয়ের বিয়ে দেবেন না। বিয়ে দিলেই তারা সুখী হবে না। তারা দাওয়াত দিলে যাবেন না। ‘কারোর দাওয়াতে যাওয়া মানে রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থান নেওয়া।’ আসলেই আদালতের একটা-দুইটা রায়ে দুর্নীতি বন্ধ হবে না। দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। কিন্তু আমরা বয়কট করি না, বরণ করি।  বিচারক দুর্নীতিবাজের সঙ্গে ছেলেমেয়ের বিয়ে না দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটে উল্টো ঘটনা। বিয়ের আলোচনার সময় মেয়েপক্ষ কৌশলে জেনে নেয়, ছেলের উপরি আয় আছে কি না। সৎ পাত্র বাজারে অচল। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতেও সম্মান জোটে না সৎ পাত্রের।

আসলে দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে না পারলে বিচার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। যেদিন সন্তান তার পিতার আয়-ব্যয়ের হিসাব চাইবে, যেদিন স্ত্রী তার স্বামীর ঘুষের টাকা ফিরিয়ে দেবে, যেদিন স্বজনরা দুর্নীতিবাজকে ঘৃণা করবে; সেদিনই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারের লড়াই শুরু হবে। ফিরছি দুর্ভাগা মাসুদুর রহমানের কথায়। ঘুষের রেট ঠিক করে দেওয়ায় বেচারাকে বরখাস্ত হতে হয়েছে। মাসুদুর রহমান একটু বোকা। নইলে এভাবে ঘোষণা দিয়ে রেট ঠিক করে দিতেন না। যারা মাসুদুর রহমানকে বরখাস্ত করেছেন এবং যারা এই লেখা পড়ছেন, তাদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন, মাসুদুর রহমানের অপরাধটা কী?  ঘুষ খাওয়া না ঘুষের রেট ঠিক করে দেওয়া নাকি সেটা প্রকাশ করে দেওয়া? যদি রেট ঠিক করে দেওয়া বা প্রকাশ করে দেওয়া অপরাধ হয়, তাহলে কোনো কথা নেই। আর ঘুষ খাওয়াকে যদি আপনি অপরাধ মনে করেন, তাহলে একটা সম্পূরক প্রশ্ন, দেশে কি একজন এসিল্যান্ডই ঘুষ খান?        

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর