শিরোনাম
সোমবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

দেশেই কর্মসংস্থানের পথ খুঁজতে হবে

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

দেশেই কর্মসংস্থানের পথ খুঁজতে হবে

প্রতি বছরই বিদেশগামীদের সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে গ্রামের মধ্যবিত্ত, উচ্চ শিক্ষিত তরুণ যেমন আছে, তেমনি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত তরুণও আছে। প্রধানত তরুণদের একাংশ উচ্চশিক্ষার জন্য, আর একাংশ চাকরির জন্য বিদেশে যাচ্ছে। শেষোক্তদের মধ্যে শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত ও অশিক্ষিত তরুণরা রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বিদেশে যাচ্ছে উচ্চশিক্ষা লাভের আশায়। শিক্ষা শেষে এদের কম সংখ্যকই দেশে ফিরে আসছে। এতে মেধা পাচার হচ্ছে, বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রাও চলে যাচ্ছে। চাকরির জন্য যারা বিদেশে যাচ্ছে, তারা মূলত জীবনযাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য আনার জন্যই যাচ্ছে। বেকার জীবনের ইতি এবং পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা প্রতিষ্ঠাই তাদের লক্ষ্য। এ জন্য তারা যে কোনোরকম ঝুঁকি নিতে পিছপা হচ্ছে না। বৈধ পথে যারা যাচ্ছে, তাদেরও নানা রকম বিড়ম্বনা ও প্রতারণার শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। আর অবৈধ পথে যারা যাচ্ছে, তারা সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মধ্যেই যাচ্ছে। তারা জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে। মরুভূমি, পাহাড়, জঙ্গল, সাগর অতিক্রম করে ইউরোপ-আমেরিকা যাওয়ার চেষ্টা করছে এবং এই চেষ্টায় তাদের অনেককে বিপদে-বেঘোরে কিংবা সাগরে ডুবে প্রাণ হারাতে হচ্ছে।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশই তরুণসমাজ। দেশের বর্তমান লোকসংখ্যার হিসাবে সাড়ে ৪ কোটির বেশি তরুণ রয়েছে। সুন্দর একটি সমাজ গড়ে তুলতে তরুণ-যুবকদের কাজে লাগাতে হবে। দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ ও মান যদি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের হয়, শিক্ষা লাভের পর উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ যদি থাকে, তবে কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়লেও শিক্ষার মান নেই কম। এতে বরং শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে।

প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও আত্মহত্যা করছে। দারিদ্র্য, বৈষম্য, অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা, ব্যর্থতা ইত্যাদি তাদের আত্মহত্যার উল্লেখযোগ্য কারণ। শিক্ষিত-অশিক্ষিত তরুণ মাত্রই একটি কমন সমস্যার সম্মুখীন। সেটা হলো, কর্মসংস্থানের অভাব বা বেকারত্ব। যে শিক্ষিত তরুণরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাচ্ছে, তাদের লক্ষ্য উচ্চশিক্ষা হলেও প্রকৃত লক্ষ্য উপযুক্ত কর্মসংস্থান এবং অপেক্ষাকৃত উন্নত জীবনযাপন। অন্যদিকে শুধু কর্মসংস্থান বা উন্নত দেশে অভিবাসনের জন্য শিক্ষিত-অশিক্ষিত তরুণরা দলে দলে বিদেশমুখী হচ্ছে।

প্রতি বছর অন্তত ২০ লাখের বেশি তরুণ কর্মসংস্থানের জন্য শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। তাদের কিছু সংখ্যকের দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থান হলেও অধিকাংশই বেকার থেকে যাচ্ছে। এভাবে বেকারের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। আমাদের দেশের জনসংখ্যার মধ্যে তরুণদের অংশই বেশি। দেশে শিক্ষিতের হার শতকরা ৭০ শতাংশের মতো হলেও মোট জনশক্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই বেকার। যাদের অধিকাংশই শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত, কিংবা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে লক্ষাধিক, যাদের বেশির ভাগের কর্মসংস্থান হয় না। ফলে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও। দেশে কর্মসংস্থান যে হারে বাড়ছিল তা হ্রাস পেয়েছে নানা কারণে। তাই অনেকে শ্রম বেচতে বাইরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে সরকারের দেওয়া সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। নিজেদের সম্পদ কাজে লাগিয়ে দেশেই কর্মসংস্থানের পথ খুঁজতে হবে। সময়টা তথ্যপ্রযুক্তির। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছেন এ দেশের যুবকরা। অনেকেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাজের ক্ষেত্র গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছেন। ফলে সমাজে সম্ভাবনার ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে। আসলে যুবসমাজই হচ্ছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রধান চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গড়তে দেশের এই বিশাল শক্তির উপযুক্ত ব্যবহার হওয়া দরকার। এরাই নিজেদের মেধা ও মনন শক্তি ব্যবহার করে নির্ধারণ করবে দেশের আগামী দিনের চলার পথ। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে তরুণ জনগোষ্ঠীকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে। বাংলাদেশের সামনেও সোনালি ভবিষ্যৎ হাতছানি দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফল হবে কি না তা নির্ভর করছে সৃষ্ট সুযোগ কতটা কাজে লাগানো যাবে তার ওপর। বাংলাদেশের জন্য এ মুহূর্তে সমস্যা হলো জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ বেকার। যুব জনগোষ্ঠীর একটি অংশ অভিভাবকদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। যুবসমাজের কর্মসংস্থানের যথাযথ পদক্ষেপ যেমন দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করবে তেমন এ ক্ষেত্রের ব্যর্থতা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেশের সোনালি ভবিষ্যতের স্বার্থেই কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে গতি আনার উদ্যোগ নিতে হবে। নিজেদের সম্পদ কাজে লাগিয়ে দেশেই কর্মসংস্থানের পথ খুঁজতে হবে।

বাংলাদেশ ছিল প্রায় সম্পূূর্ণরূপে একটি কৃষিনির্ভর দেশ। মানুষের কর্মসংস্থানও ছিল মূলত কৃষি ক্ষেত্রে। যেহেতু কৃষিজমি বাড়ছে না, তাই বর্ধিত জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের জন্য কৃষিবহির্ভূত অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বিস্তৃত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। অতীতে সেই প্রক্রিয়াটি যথাযথভাবে না এগোনোয় বেকারত্বের হার অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তরুণ-যুবকরা বাধ্য হয়েছিল ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রযাত্রা কিংবা অন্যান্য উপায়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে। সাম্প্রতিক সময়ে অবৈধভাবে বিদেশযাত্রার সেই ধারা কিছুটা হলেও কমে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে উল্লেখযোগ্য হারে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। ক্রমান্বয়ে এর গতি বাড়ছে। সেই সঙ্গে দেশি বিনিয়োগও বাড়ছে। বর্ধিত কর্মসংস্থানের স্বার্থে সরকারকে শিল্পায়নের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। সেবা খাতসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ডও যাতে দ্রুত বিকশিত হয় তার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পরিস্থিতির আরও উন্নয়ন করতে হবে। তাহলে নিকট ভবিষ্যতে দেশে বিনিয়োগ আরও গতি পাবে, সেই সঙ্গে বাড়বে কর্মসংস্থানের হারও।

 

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ

সর্বশেষ খবর