শিরোনাম
সোমবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

শিশুদের সঙ্গে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ

মাওলানা মুজিবুর রহমান ফরাজী

শিশুদের সঙ্গে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ

শিশুরা মানবসমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। তাই শিশুদের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা, সহমর্মিতাপূর্ণ আচরণ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এ কারণেই প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হৃদয় থেকে শিশুদের প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধ। শিশুদের প্রতি নবীজির ভালোবাসা ও মমত্ববোধ ছিল উম্মতের জন্য শিক্ষা। তাতে ফুটে ওঠে ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় তা উঠে এসেছে-

১. শিশুদের প্রতি স্নেহ-মমতা : হজরত আমর ইবনে শুয়াইব তাঁর বাবা থেকে, তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের বড়দের সম্মান বোঝে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়’ (তিরমিজি, আবু দাউদ)।

২. শিশুদের চুমু দেওয়া : শিশুদের ভালোবেসে তাদের চুমু দেওয়াও সুন্নত। তাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করা এবং ভালোবেসে কাছে টেনে নেওয়া হলো স্বাভাবিক মানবিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাঁর নাতি হাসান ও  হোসাইন (রা)-কে আদর করতেন। তাদের সঙ্গে সখ্যতা ও আন্তরিকতায় বিনোদনে মেতে উঠতেন। হাদিসে পাকে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, (একবার) রসুলুল্লাহ (সা.) হাসান ইবনে আলী (রা.)-কে ভালোবেসে চুমু খেলেন। সেখানে আকরা ইবনে হাবেস আত-তামিমি (রা.) উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, আমার ১০ জন সন্তান আছে; আমি তাদের কাউকে কখনো চুমু খাইনি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকান এবং বলেন, ‘যে দয়া করে না, তার প্রতিও দয়া করা হয় না’ (বুখারি)।

৩. এতিম শিশুদের ভালোবাসা : নিজেদের শিশু-সন্তানসহ সব শিশুকে ভালোবাসাই সুন্নত। সুন্নতে নববীর অনুসরণে শিশুর প্রতিই স্নেহ-ভালোবাসা দেখাতে হবে। বিশেষ করে এতিম শিশুদের প্রতি স্নেহ-মমতায় সতর্ক ও যত্নশীল হওয়া জরুরি। আল্লাহতায়ালা প্রিয় নবী (সা.)-কে এতিমদের প্রতি স্নেহ-মমতা প্রকাশের ব্যাপারে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছেন এভাবে- ‘তুমি কি এমন লোককে দেখেছ, যে দীনকে অস্বীকার করে? সে তো ওই ব্যক্তি যে অনাথকে (এতিমদের নির্দয়ভাবে) রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয়’ (সুরা মাউন ১-২)। হজরত সাহাল ইবনে সাদ (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি ও এতিমের প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে কাছাকাছি থাকব। এ কথা বলে তিনি তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল দ্বারা ইঙ্গিত করেন এবং এ দুটির মাঝে সামান্য ফাঁক রাখেন’ (বুখারি)। ৪. প্রতিবন্ধী শিশুদের স্নেহ-মমতা : শারীরিক কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের স্নেহ-মমতার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়াও সুন্নত। তাদের অবজ্ঞা বা অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। বিশেষ এক ঘটনায় প্রতিবন্ধী সাহাবার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মহান আল্লাহ আয়াত নাজিল করেছেন। এক দিন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশ নেতাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করছিলেন। এ অবস্থায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা) সেখানে উপস্থিত হয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দীন সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার অনুরোধ করেন। এতে আলোচনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ায় নবীজি একটু বিরক্তি প্রকাশ করেন। সে সময় তিনি কুরাইশ নেতাদের মন রক্ষার্থে প্রতিবন্ধী সাহাবির প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেননি। মহান আল্লাহর কাছে বিষয়টি পছন্দনীয় হয়নি। তখনই আয়াত নাজিল হয়। আল্লাহ বলেন, ‘সে ভ্রুকুঞ্চিত করল এবং মুখ ফিরিয়ে নিল। কারণ তার কাছে অন্ধ লোকটি এলো। তুমি কেমন করে জানবে, সে হয়তো পরিশুদ্ধ হতো অথবা উপদেশ গ্রহণ করত। ফলে উপদেশ তার উপকারে আসত। পক্ষান্তরে যে পরোয়া করে না, তুমি তার প্রতি মনোযোগ দিয়েছ’ (সুরা আবাসা ১-৬)। এরপর থেকে প্রিয় নবী সব সময় প্রতিবন্ধীদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং আর প্রতিবন্ধী যদি শিশু হয় তবে তো কথাই নেই।

৫. নবীজি শিশুদের বাহনে পরিণত হতেন : নবী নন্দিনী হজরত ফাতিমা (রা.) আনহার দুই শিশুপুত্র হাসান ও  হোসাইন (রা.) প্রিয় নবীকে বাহন বানিয়ে তাঁর পিঠে চড়তেন। কাঁধে উঠতেন। প্রিয় নবীও তাদের জন্য বাহনের মতো হয়ে তাদের পিঠে ওঠাতেন এবং কাঁধে চড়াতেন। শুধু নাতি বলে নয়; সব শিশুকেই প্রিয় নবী (সা.) সমান আদর করতেন। হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, একদিন এশার নামাজে রসুলুল্লাহ (সা.) হাসান অথবা হোসাইনকে কোলে নিয়ে আমাদের দিকে বেরিয়ে এলেন। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজের উদ্দেশে সামনে অগ্রসর হয়ে তাঁকে রেখে দিলেন। তারপর নামাজের জন্য তাকবির বলেন ও নামাজ আদায় করেন। নামাজে একটি সিজদা লম্বা করলেন। আমার পিতা (শাদ্দাদ) বলেন, আমি আমার মাথা উঠালাম এবং দেখলাম, ওই ছেলেটি রসুলুল্লাহ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিঠের ওপর আর আর তিনি সিজদারত। আমি সিজদায় ফিরে গেলাম। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজ শেষ করলে লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রসুল, আপনি আপনার নামাজে একটি সিজদা এত লম্বা করলেন, যাতে আমরা ধারণা করলাম, হয়তো কোনো ব্যাপার ঘটে থাকবে অথবা আপনার ওপর ওহি নাজিল হয়েছে! তিনি বলেন, ‘এর কোনোটিই নয়; বরং আমার এ সন্তান আমাকে সোয়ারি বানিয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি উঠতে অপছন্দ করলাম, যেন সে তার কাজ সমাধা করতে পারে।’ (নাসাঈ)।

 

লেখক : ইসলামী গবেষক ও পীর সাহেব সূর্যপুর, কুমিল্লা

সর্বশেষ খবর