বুধবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

অনুকরণীয় একজন রাখাল ডাক্তার

হোসেন আবদুল মান্নান

অনুকরণীয় একজন রাখাল ডাক্তার

রাখাল বাবুকে শেষ কবে দেখেছিলাম ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে সম্প্রতি গ্রামে গিয়ে যখন তাঁর খোঁজ নিতে গেলাম তখনই জানতে পারি, তিনি আর ইহলোকে বেঁচে নেই। মাত্র কয়েক মাস আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমার প্রবল ইচ্ছে ছিল তাঁকে আরেকবার সামনাসামনি দেখার। বয়স হয়েছিল শত বছরের কাছাকাছি। একটু কম-বেশিও হতে পারে। পরিবারের পক্ষ থেকে বলেছিল ৯৭ বছরের অধিক। আমাদের সময়ের এবং আমাদের শৈশব-কৈশোরের এক কিংবদন্তি গ্রামীণ চিকিৎসকের নাম রাখাল বাবু। পুরো নাম রাখাল চন্দ্র রায় হলেও তাঁকে রাখাল ডাক্তার নামে সবাই চিনতেন। আসল নামটা মনে হয় চাপা পড়ে ছিল স্কুলের নথিপত্রের নিচে। দেখতে ছিলেন মাঝারি উচ্চতার গৌর বর্ণের অভিজাত ব্রাহ্মণদের মতো। তবে হিন্দুশাস্ত্রীয় বিধান মতে, তিনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় না শূদ্র ছিলেন তা এখানে বিবেচনার বিষয় নয়। এমনকি ডাক্তার হিসেবে তাঁর ছোটবড় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট ছিল কি না তাও আমার জানার প্রয়োজন নেই।

তবে শুনেছি, কলকাতাকেন্দ্রিক ন্যাশনাল ডাক্তারের একটা সনদপত্র তাঁর ছিল। কিন্তু তাঁর হাতের যশ ছিল সর্বজনবিদিত। তাই পরিচিতির সীমাও ছিল আশপাশের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে প্রসারিত। তাঁর সৌভাগ্য যে, জীবদ্দশায় তিনি একজন নিবেদিত, অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সুখ্যাতি পেয়েছিলেন।

২. অজাতশত্রু বন্ধুবাৎসল রাখাল ডাক্তার আমৃত্যু গ্রামেই বসবাস করেছেন। গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও স্থায়ীভাবে বাস করেছেন বলে আমার জানা নেই। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সাময়িক ভারতে অবস্থান করেছিলেন বলে শুনেছিলাম। তা-ও যুদ্ধকালীন সেই রক্তাক্ত বিভীষিকাময় দিনগুলোতে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই নিঃসংকোচে স্বদেশের স্বভূমিতে ফিরে আসেন। তাঁকে আমরা জন্মের ঋণ শোধ করা একজন অসাধারণ খাঁটি বাঙালি বলে আখ্যায়িত করতে পারি। জীবিকার মধ্য দিয়েই আমৃত্যু জনসেবা করে গেছেন। যিনি চারপাশের তৃণমূলে বসবাসকারী মানুষের কাছে হয়ে উঠেছিলেন একজন গণহিতৈষী অন্তঃপ্রাণ পরামর্শক। শুনেছি, তাঁর উত্তরাধিকারদের কেউ কেউ এমবিবিএস ডাক্তারও হয়েছেন।

এবং পিতা বা দাদার পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত আছে। কিন্তু এলাকার গরিব মানুষের কাছে তারা রাখাল ডাক্তারের ছেলে বা নাতির চেয়ে কিছুতেই ওপরে যেতে পারছে না। এমনকি তারা আরও অনেক বড় ডিগ্রিধারী হলেও বোধকরি তাঁকে অতিক্রম করে যাওয়া সম্ভব হবে না। তিনি বেঁচে থাকবেন এ জনপদের হারিয়ে যাওয়া একটা সময়ের সাক্ষী এবং প্রতিনিধি হিসেবে।

৩. মনে পড়ে আমার শৈশব থেকে কৈশোর অবধি সময়ে বাবার নির্দেশে বহুবার রাখাল ডাক্তারের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি। তখনো আমি বাইসাইকেলের সিটের নাগাল পেতাম না। তবু আমার চাকরিজীবী চাচার সাইকেল নিয়ে নিচ থেকে প্যাডেল ঘুরিয়ে প্রায় ৬ কি.মি. রাস্তা অনায়াসে পার হয়ে চলে গিয়েছি।

পথে ছোট ছোট ব্রিজ, কালভার্ট, খেতের চিকন আল ধরে তাঁর বাড়িতে যেতে হতো। আমাদের বাড়ির কারও অসুখ-বিসুখ হলে বাবার এককথা ছিল, রাখাল বাবুর কাছে গিয়ে বল, তিনি শুনে ওষুধ-পথ্য লিখে দেবেন। বিশেষ করে আমার মা (যিনি অনেক সন্তানের জননী ছিলেন) তখন তিনি প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। এখন বুঝতে পারি, সমস্যা ছিল গাইনিকোলজিক্যাল। বলা বাহুল্য, আমার বাবা বয়সে রাখাল বাবুর সমসাময়িক ছিলেন। সম্ভবত ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আচমিতা জর্জ ইনস্টিটিউটের ছাত্রাবস্থায় তাঁরা পরিচিত ছিলেন। তবে রাখাল বাবু বাবার চেয়ে বয়সে অল্প জ্যেষ্ঠ ছিলেন। তাছাড়া পঞ্চাশের দশকে আমার বাবা অত্র এলাকার একজন বিশিষ্ট কাবাডি খেলোয়াড় ছিলেন। রাখাল বাবু স্বয়ং বাবার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। যা তিনি প্রসঙ্গক্রমে আমাকেও বলেছিলেন। মা’র আচমকা কিছু হলেই ভোর বেলায় সাইকেল নিয়ে ছুটে যেতাম রাখাল ডাক্তারের কাছে। তিনি তখন তাঁর বাড়ির আঙিনা বা কাছাকাছিতে থাকা পিঁয়াজ, রসুন, মরিচের জমিতে পদস্খলনে নিবিষ্ট চিত্তে নিড়ানির কাজে ব্যস্ত থাকতেন। তখন তাঁর পায়ে কাঠের তৈরি খড়ম আর পরনে ধুতি ও ফতোয়া জাতীয় পোশাক থাকত। আমার স্মৃতির ভিতর আজও সতেজ হয়ে আছে, সেই কুয়াশাচ্ছন্ন অস্পষ্ট রাস্তা ধরে আমি দুয়েকবার সেসব জমির আল পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়িয়েছি। দেখেছিলাম তাঁর হাঁটু অবধি শিশিরের জলের সঙ্গে লেগে আছে মরিচ গাছের ঝরাপাতা।

হাঁটা অবস্থায় আমাকে দেখেই বলতেন, ‘কি হে, আজ কে অসুস্থ বাবা না মা’?

শুনে তিনি বলতেন,

‘যাও বাড়িতে গিয়ে বসো,

আমি একটু পরেই আসছি’।

৪. তাঁর বাড়ির উঠোনে অপেক্ষমাণ জনাদশেক রোগী বা রোগীর আত্মীয়ের সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া সেই আমিও নিঃশব্দে সময় কাটাতাম। ক্রমেই সকালের সূর্যের আলোর উত্তাপ ছড়িয়ে পড়লে, তিনি জমি থেকে ফিরে এসে অন্দরমহলে খানিকটা সময় জিরিয়ে নিতেন। হয়তো সেটা ছিল প্রাতরাশ সম্পন্নকরণের জন্য অন্তর্বর্তী কাল। সূর্যোদয়ের আগেই জেগে উঠতেন তিনি। মনে হতো ঘড়ির কাঁটায় নিত্য-নৈমিত্তিক রুটিনে বাঁধা একটা যাপিত জীবনের আরেক নাম ছিল রাখাল ডাক্তার। বহিরাঙ্গের চেম্বারে বসে সবার আগে আমাকে ডেকে নিয়ে ফাউন্টেনপেনে লেখা এক চিলতে প্রেসক্রিপশন এবং পথ্য ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘যাও বাবাকে দিও’।

আমিও মনের সুখে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম। আমার আসন্ন কৈশোরের সে বয়সে মনে হতো দায়িত্বের চেয়ে বাইসাইকেল চালানোর আনন্দই যেন মুখ্য। রাখাল ডাক্তার কখনো কখনো রোগীকে না দেখেই ওষুধ দিয়ে দিতেন। রোগের বর্ণনা বা লক্ষণ শুনেই তিনি ডায়াগনোসিস করতে পারতেন। সেটা ছিল তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফল। সেকালে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর পরিচিত বা অপরিচিত সেসব রোগী দিব্যি আরোগ্য লাভ করতেন।

৫. বড় হয়ে যখন সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেছি, গ্রামে গিয়ে তখনো দেখেছি তিনি ভীষণ ব্যস্ত ও কর্মক্ষম মানুষ। তাঁকে জীবনভর হাসিখুশি থাকতে দেখেছি। নিয়মিত রোগী দেখছেন, মজার মজার কথা বলছেন, রসিকতা করছেন। এ কথা সত্যি, প্রচণ্ড সংবেদনশীলতা, মেধা, মানবিক মূল্যবোধ ও মননশীলতাই তাঁকে জন্মস্থানে এমন সম্মানের আসন এনে দিয়েছিল। তাঁর মুখের কথা শুনেই যেন রোগীরা মুক্তি পেত। সেটা যেন অনেকটা মনস্তাত্ত্বিক থেরাপির মতো ছিল। তখনই বিস্মিত হয়ে শুনেছি, অশীতিপর হয়েও বাইসাইকেল চালিয়ে আমাদের মানিকখালী বাজারে রাস্তার পাশের একটা বড় ফার্মাসিতে বসার জন্য প্রতি হাঁটবারে অন্তত ১০ কি.মি. আসা-যাওয়া করেছেন। এ কথা সত্যি, কালক্রমে তিনি এলাকাবাসীর শত শত মানুষের কাছে পরম শ্রদ্ধেয়জন হয়ে উঠেছিলেন।

জানা যায়, নব্বই পেরিয়ে গিয়েও রোগী দেখেছেন, নিয়মিত পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকি অনন্তলোকে হারিয়ে যাওয়ার দু-চার দিন আগেও নাকি তিনি তাঁর মহৎ পেশায় সক্রিয় ছিলেন।

বিস্মিত হওয়ার মতো, নিজের জন্মভিটার মাটির ওপর দাঁড়িয়ে থেকে নির্বিবাদে প্রায় একটা শতাব্দীকে পেছনে ফেলে চলে যাওয়া এটা কোনো মামুলি ব্যাপার নয়। তাঁর এমন বিরল আয়ুষ্কালকে নিঃসন্দেহে বলা যায়, গৌরবময় এবং সৌরবময় জীবনের আরেক নাম।

আমি ভাবতে থাকি, লাখো কোটি মানুষের এই মায়াবী পৃথিবীতে রাখাল ডাক্তারদের মতো মানুষগুলোর জীবনকালটাও কী কম গুরুত্বপূর্ণ, কম অপরিহার্য?

লেখক : গল্পকার, প্রাবন্ধিক

সর্বশেষ খবর