বুধবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

প্রবীণবান্ধব দেশ চাই

আফরোজা পারভীন

প্রবীণবান্ধব দেশ চাই

বছর তিনেক আগের কথা, একটা অ্যাওয়ার্ড নিতে গিয়েছিলাম বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ অডিটোরিয়ামে। অনুষ্ঠানটা ছিল ফিল্ম ফর পিস ফাউন্ডেশনের। আর অ্যাওয়ার্ডের নাম ছিল ইন্সপাইরিং উইম্যান অ্যাওয়ার্ড। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতী ১০ নারীকে পুরস্কৃত করেছিল সংস্থাটি। পুরস্কার প্রদান করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পুরস্কৃতদের নাম আগে জানানো হয়নি। ঘোষণাটি দেওয়া হয়েছিল মিলনায়তনে তাৎক্ষণিক। তবে যাঁদের পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা তাঁদের যেতে অনুরোধ করা হয়েছিল। বলতে দ্বিধা নেই, সেদিন যাঁরা পুরস্কৃত হয়েছিলেন তাঁদের এক-দুজন বাদে সবাই কৃতী। তাঁদের কাজ প্রশ্নাতীত। সমাজের জন্য অসামান্য অবদান রেখেছেন তাঁরা। পুরস্কৃত একজন মহিলা একটি এনজিওর প্রধান। অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। করেছেন এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক মানোন্নয়ন। তিনি এলেন হুইলচেয়ারে। কিন্তু হুইলচেয়ারে আসার ব্যবস্থা নেই। অডিটোরিয়ামে কোনো র‌্যাম্প তো নেই। এমনকি মিলনায়তনে ঢুকতে হয় অনেক সিঁড়ি ডিঙিয়ে। সরাসরি ঢুকে পড়বেন তেমন ব্যবস্থা নেই। মহিলাকে নেওয়া হলো চার-পাঁচ জন মিলে হুইলচেয়ার ওপরে তুলে। সবাই সেদিকে তাকিয়ে রইল। আমি প্রতি মুহূর্তে ভয় পাচ্ছিলাম এই বুঝি উনি পড়ে যাবেন। সংস্থাটির কর্ণধারদের একজন দুঃখ করে স্টেজ থেকে বললেন, ‘আমরা ওনাকে পুরস্কৃত করছি, নিমন্ত্রণ করে এনেছি কিন্তু ওনার আসার ব্যবস্থা করতে পারিনি।’

সত্যিই বড় দুঃখজনক! আগে মিলনায়তনগুলো ছিল সমতল। এখন সব বানানো হয়েছে গ্যালারির মতো করে। তাতে যাঁদের পায়ে সমস্যা আছে তাঁদের স্বচ্ছন্দে যাওয়া সম্ভব না। অসুস্থ লোকের পক্ষেও সম্ভব না। কারও কারও পক্ষে একেবারেই না, যেমন ওই মহিলার। ওনার দুটো পায়েই সমস্যা। হাঁটাচলা করতে পারেন না। এ অবস্থায় উনি এনজিও চালাচ্ছেন, মানুষের জন্য কাজ করছেন। কী অসীম, অদম্য কর্মশক্তি! অথচ আমরা তাঁর এগিয়ে চলার পথটি করে রেখেছি রুদ্ধ। আমি জানি না হঠাৎ করে মিলনায়তনগুলো ভেঙে গ্যালারি বানানোর মাজেজা কী? এতে কী বাড়তি সুবিধা? মিলনায়তনে ঢোকার জন্য অতগুলো উচু সিঁড়িরই বা প্রয়োজন কী? অধিকাংশ মিলনায়তনে অতিথিদের জন্য একটাই দরজা থাকে। কাজেই কেউ যে সামনের দিকের নিচু অংশ দিয়ে ঢুকবেন সে সুযোগও নেই। কেউ যদি বলেন গ্যালারি স্টাইল করলে স্টেজ দেখার সুবিধা হয় সেটাও ভুল কথা। কারণ স্টেজ ঘিরে দেয়াল বানিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ফটোগ্রাফাররা। সামনে যাঁরা থাকেন তাঁরা মোবাইল নিয়ে এমনভাবে ছবি তোলেন যে পেছনের লোকের দৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হয়। তা ছাড়া আজকাল স্টেজের দুই পাশে বড় বড় স্ত্রিন টানিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেই সবাই দেখেন। স্টেজে চোখ রাখেন কমই।

বিদেশে দেখেছি কারও সাহায্য ছাড়া একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী একা একাই বাঁচতে পারে। হুইলচেয়ারের জন্য রাস্তার পাশে আলাদা রাস্তা। শপিং মল, রেস্তোরাঁ, পার্কে আলাদা পথ। এমনকি হুইলচেয়ার নিয়ে একজন উঠে যাচ্ছে বাসে-ট্রেনে। একটা ভালো হুইলচেয়ার থাকলে কারও মুখাপেক্ষী তাদের হতে হয় না
আসল কথা হচ্ছে এ দেশে প্রবীণ, বৃদ্ধ, অসুস্থ মানুষের কথা মাথায় রেখে কেউ কাজ করেন না। মানুষের পায়ে সমস্যা থাকতে পারে, শারীরিক অসুস্থতা থাকতে পারে এসব নিয়ে ভাবার লোক নেই। চিন্তা একটাই- কীভাবে সৌন্দর্য বর্ধন করা যাবে। ‘খুব সুন্দর হয়েছে’, ‘দারুণ’, ‘এমন আর হয় না’ বলে এ বছর যা বানানো হয় পরের বছর নানান ত্রুটি বের করে সেটা ভাঙা হয়। দুই পয়সা পকেটে আসে।

সম্প্রতি একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে গিয়েছিলাম ছেলের জোরাজুরিতে। ছেলে বলল ৬৩ বছর বয়সে পিএইচডি করেছ। ডিগ্রি তো দেশের অনেকই নিয়েছ। কনভোকেশন তো একটিও পাওনি। এটায় অন্তত যাও। স্মৃতিটুকু থাক। আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। তিন-চার বছর ধরে পায়ে প্রকট সমস্যা। পঙ্গুত্বের কাছাকাছি। জানতাম ভেন্যুর অনেক দূরে রাস্তা আটকে দেওয়া হবে। নানান সমস্যায় পড়ব। তা-ই হলো। ভেন্যু থেকে অনেক দূরে গাড়ি পার্কিং। এরপর কী হবে। কয়েকটি শাটল গাড়ি আছে। সেগুলো নাকি নামিয়ে দেবে ভেন্যুর পাশে। অনেক কষ্টে উঠলাম। কিন্তু গাড়ি থামল ভেন্যু থেকে আধা কিলোমিটারের চেয়ে বেশি দূরে। এত রাস্তা হাঁটা সম্ভব না। ভেবেছিলাম এত বড় বিশ্ববিদ্যালয়। ২০ হাজারের কাছাকাছি রেজিস্ট্রেশন করেছে। অনেক দিন পর সমাবর্তন হচ্ছে। অনেকেরই তো বয়স হয়েছে। অনেকে অসুস্থ। অবশ্যই হুইলচেয়ার ও ভলান্টিয়ারের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু না। অনেক তো দূর, একটা হুইলচেয়ারও নেই। ফিরে চলে আসব ভাবছি, মনে পড়ল গাড়ির পেছনে একটা হুইলচেয়ার আছে। বেচারা ড্রাইভারকে শাটল গাড়িতে উঠতে দিল না, একটি রিকশা পর্যন্ত নেই। ছেলেটি প্রায় ২ মাইল দৌড়ে এলো হুইলচেয়ার নিয়ে। তারপর ড্রাইভার সামনে পথ পরিষ্কার করতে লাগল আর ছেলে হুইলচেয়ার ঠেলতে লাগল। না আছে কোনো র‌্যাম্প, না আছে হুইলচেয়ার চলার আলাদা রাস্তা। মাঝে মাঝেই ছেলেমেয়েরা হুড়মুড় করে গায়ের ওপর, পায়ের ওপর পড়তে লাগল। সে এক বীভৎস পরিস্থিতি! ছেলে ঘেমে-নেয়ে অস্থির হয়ে উঠল। এভাবে অন্তহীন পথ পাড়ি দিয়ে একসময় ভেন্যুতে পৌঁছলাম। ভাগ্যিস প্রেসিডেন্টস গার্ড রেজিমেন্টের লোকেরা ভালো ছিল। তারা হুইলচেয়ার নিয়ে মাঠ পার হতে দিল। তারপর শুরু হলো আরেক তামাশা। শুনেছিলাম ওখানে নাকি গিজগিজ করছে ভলান্টিয়ার। হ্যাঁ অনেক ভলান্টিয়ার ছিল, তারা কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। কেউ হুইলচেয়ারে হাত লাগায়নি। বরং একজন বলছিল এদিক দিয়ে যান, একজন ওদিক দিয়ে। এই করে করে যখন নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছলাম তখন আর জীবনীশক্তির এতটুকু অবশিষ্ট নেই। আসার সময় একই অবস্থা। একই কাহিনি। মাঝখানে কাহিনি আর একটু আছে। খাবার দেওয়া হচ্ছে পাঁচ-ছয় জায়গা থেকে। কুপনে যে জায়গার কথা আছে সেখান থেকে নয়। কাজেই ড্রাইভার একবার এদিক দৌড়ায়, একবার ওদিক। শেষাবধি না খেয়েই চলে এলাম। এটাই আমাদের দেশের চিত্র। ফুটপাত দখল করে আছে হকাররা। হুইলচেয়ার চলার আলাদা রাস্তা নেই। একই রাস্তা দিয়ে টেম্পো থেকে ঠেলাগাড়ি, বাস থেকে বাইক সবই চলছে। এ অবস্থায় কারও পক্ষে হুইলচেয়ারে চলা অসম্ভব। হাসপাতালে র‌্যাম্প থাকলেও হুইলচেয়ার অপ্রতুল। চেয়ার টানার লোক তো নেই-ই। অথচ মুখে বড় বড় কথা। আমাদের হাসপাতালে ৫০০ হুইলচেয়ার। ১০ তলা, নয় তলা, ১০০ তলায় গেছে তাই নিচে নেই! আর বিপণিবিতান, বাজারঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তো এসব ভাবা স্বপ্ন।

সিঁড়ি নিয়ে আর এক বিপত্তি! রেলিংয়ের পাশে সারি সারি সাজিয়ে রাখা হয় ফুলের টব। রেলিংগুলো তো বানানো হয়েছে অসুস্থ মানুষের জন্য। সেখানেই যদি টব রাখা হয় তাহলে রেলিং ধরবে কী করে! শুধু তাই নয়, অধিকাংশ সিঁড়ির দুই পাশজুড়ে বসে থাকে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা। ঘাড়ে মাথা রেখে ফিসফিস করে তারা। সরতে বললে বিরক্ত হয়। বলে, ‘মাঝখান দিয়ে যান না’। কেউ কেউ আরও একটু এগিয়ে বলে, ‘অসুবিধা তা আসেন কেন? অনলাইনেই তো সব পাওয়া যায়!’ অধিকাংশ দোকানে ক্রেতার বসার ব্যবস্থা নেই। বড় বড় বিপণিবিতান বানিয়ে রেখেছে অথচ প্রবীণদের কথা কেউ ভাবেনি। ফুডকোর্টগুলোয় আজকাল যেসব চেয়ার রাখা হয় তা এত উঁচু যে একজন বৃদ্ধ বা বয়স্ক লোকের সেখানে বসা আর হিমালয়ে চড়া একই। চাকাওয়ালা চেয়ার বয়স্ক ও অসুস্থদের জন্য বিপজ্জনক। এসব ভাবার কেউ নেই।

বিদেশে দেখেছি কারও সাহায্য ছাড়া একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী একা একাই বাঁচতে পারে। হুইলচেয়ারের জন্য রাস্তার পাশে আলাদা রাস্তা। শপিং মল, রেস্তোরাঁ, পার্কে আলাদা পথ। এমনকি হুইলচেয়ার নিয়ে একজন উঠে যাচ্ছে বাসে-ট্রেনে। একটা ভালো হুইলচেয়ার থাকলে কারও মুখাপেক্ষী তাদের হতে হয় না। নিজের কাজ নিজে চালিয়ে নিতে পারে। সবার তো সাহায্য করার লোকও থাকে না। সেখানে সিনিয়র সিটিজেনদের আলাদা সম্মান। তাঁদের জন্য সর্বত্র টিকিটের মূল্য অর্ধেক, ভালো বসা, ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা। কিন্তু আমার দেশ সম্পূর্ণ বিপরীত। এ দেশে যেন ধরেই নেওয়া হয় প্রবীণ আর অসুস্থ লোকজনের বাঁচার অধিকার নেই। তাঁদের আবার কীসের আনন্দ, কীসের বাইরে যাতায়াত! কাজেই তাঁদের জন্য কোনো ব্যবস্থা রাখার দরকার নেই। এ পৃথিবী নবীনদের জন্য। সব করো তাদের জন্য। পলিসি মেকাররা ভুলে যান নবীনরাই প্রবীণ হন। তারাও হবেন। অসুস্থতা রোগ জরা যে কোনো সময় যে কোনো বয়সে হতে পারে। বাংলাদেশ সরকার ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট দিচ্ছে শুনে খুব খুশি হয়ে পাসপোর্ট অফিসে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে শুনলাম, ৬০ বছর যাঁদের বয়স তাঁরা ১০ বছরের পাসপোর্ট পাবেন না। আমার ৬০ বছর হতে অল্প কয়েক দিন বাকি ছিল বলে আমি পাসপোর্ট পেয়েছিলাম। মনে আছে, সেদিন ভীষণ ট্রমাটাইজড হয়ে গিয়েছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, তাহলে কি এরা ধরেই নিয়েছে ৭০ বছর পর্যন্ত কেউ বাঁচবে না! এদেরই তো আরও বেশি দিনের পাসপোর্ট দেওয়া উচিত। যাতে বারবার পাসপোর্ট করা বা রিনিউয়ালের ঝামেলায় যেতে না হয়। শুনেছি বিদেশে বয়স্ক, অটিস্টিক মানুষকে আগে কর্মসংস্থান দেওয়া হয়। যাতে তাঁরা কাজের মাধ্যমে আনন্দে থাকতে পারেন। কারও কাছে হাত পাততে নয়। এর নাম কল্যাণ, এরই নাম কল্যাণরাষ্ট্র। যেখানে সুখকে মূল্য দেওয়া হয়। জানি না আমাদের পরিকল্পনাবিদদের কবে বোধোদয় হবে, অথবা আদৌ হবে কি না কোনো দিন। কবে তাঁরা প্রবীণদের ভালোমন্দের দিকে নজর দেবেন! বছর বছর ঘটা করে প্রবীণ দিবস পালন না করে বরং তাঁদের সুযোগসুবিধার দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক, সাবেক যুগ্মসচিব

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর