বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

পলিথিনকে না বলুন

পলিথিনকে না বলুন

পণ্যটি ক্ষতিকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরও আমরা তা ব্যবহার করছি এবং করছি হরহামেশাই। কী আশ্চর্যজনক। অথচ এটি এমন কোনো বস্তু নয়, যার ওপর নির্ভর না করে চলা যায় না। অত্যন্ত সহজলভ্য বলে আমরা তা এড়াতে পারছি না। এ যেন আত্মঘাতী এক কর্মকাণ্ড। পরিবেশের জন্য পলিথিন কতটা হুমকিস্বরূপ তা প্রায় সবারই এখন কমবেশি জানা। কিন্তু তারপরও তা আমরা বর্জন করছি না। আমাদের এ নিষ্পৃহতা কোনো ভয়ংকরের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে তাও সম্ভবত উপলব্ধিতে নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, পলিথিনের কারণে যে কোনো সময় ভয়ানক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। পলিথিন অপচনশীল দ্রব্য। এই দ্রব্য কৃষি জমিতে ছড়িয়ে পড়ছে। পলিথিন মাটির পুষ্টিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে, মাটিতে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে বাধা সৃষ্টি করছে। ফলে মাটির উর্বরাশক্তি ক্রমেই নষ্ট হচ্ছে। পলিথিন গলিয়ে বিভিন্ন দ্রব্যাদি বানানোর ফলে বাতাসে ছড়াচ্ছে হাইড্রোজেন সায়ানাইড ও ডাই-অক্সিনের মতো বিষাক্ত গ্যাস বা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।

অথচ দিন দিন পলিথিনের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। পলিথিন আধুনিক সভ্যতার অবদান। যন্ত্রসভ্যতা পলিথিনকে সহজলভ্য এবং অতি সস্তায় সরবরাহ করছে। হাতের কাছে পাওয়া যায় বলে যেখানে দরকার নেই সেখানেও আমরা পলিথিন ব্যবহার করি। সব ধরনের কেনাকাটায় পলিথিনই যেন আমাদের প্রধান সহায়ক উপকরণ। মাছের বাজার করছেন-চাই পলিথিনের ব্যাগ, জামা-কাপড় কিনছেন-তার জন্যও দরকার, কোথাও দাওয়াতে-গিফট কিনেছেন, মোড়ানোর কাগজ দিয়ে সুন্দর করে মুড়িয়েছেনও। পলিথিন ব্যাগের কোনো দরকার নেই, কিন্তু তারপরও। দুই টাকার জিনিস হোক আর দুই হাজার টাকার জিনিসই হোক সবকিছুই পুরতে হয় এই পলিথিন ব্যাগে। কাগজের ব্যাগ বা চটের ব্যাগের কথা যেন আমরা ভুলেই গেছি।

আমাদের দেশে প্রতিদিন প্রায় ৬০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে, যার বিশ ভাগ মাত্র অপসারিত হয়। অথচ খোঁজ নেই আমাদের। কাজ শেষ, ফেলে দেই যত্রতত্র। কোনো দায়িত্বজ্ঞান নেই। যত্রতত্র ব্যাগ ফেলার ফলে কী পরিমাণ দুর্দশায় পড়তে হয় তা বাসা-বাড়ির পাইপ বা প্যান আটকে গেলেই বোঝা যায়। রাস্তাঘাটে প্রায় সময়ই দেখা যায় ড্রেনের পানি উপচে রাস্তায় জমা হয়ে আছে। ম্যানহোলগুলো পরিষ্কার করতে গেলেই দেখা যায় পলিথিনের স্তূপ। বাড়ি থেকে আবর্জনা পলিথিনে ভরে বের করতে পারলেই হলো। আবর্জনা ডাস্টবিনে ফেলা হলো কী ড্রেনে ফেলা হলো তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। নিজেরটা ছাড়া বড় করে কোনো কিছু ভাবা বোধহয় আমাদের স্বভাবে নেই। শুধু রাজনীতিতেই প্রতি বছর অন্তত ১৬২ কোটি পলিথিন বর্জ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। ২০০৪ সালে বন্যার সময় প্রতিদিন ৪৫ লাখ পলিথিন ব্যাগ ঢাকার আবদ্ধ পানিতে ফেলা হয়েছিল। এতে সে সময় শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা একেবারে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিল। আমরা সাধারণ মানুষরা যেমন এ ব্যাপারে অসচেতন, সরকার বা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মহলের আচরণও অনেকটা দায়সারা গোছের। পরিবেশ পলিথিনের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সরকারও কিছু কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে তা কার্যকর হচ্ছে না। যেমন-৯০-এর দশকে একবার পলিথিন ব্যাগ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পলিথিন কারখানার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু এতেও কোনো কাজ হয়নি। কারণ বাইরে থেকে চোরাইপথে পলিথিন ঠিকই চলে আসছে। বর্তমানে যে অবস্থা তাতে পলিথিন ব্যাগ তৈরি একটি বিরাট ব্যবসায় দাঁড়িয়ে গেছে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রচুর সংখ্যক শ্রমিকের ভাগ্য। কাজেই পলিথিন ব্যাগ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয়। তবে এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। পরিবেশে পলিথিন ব্যাগের প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলার জন্য ব্যাপক প্রচারণার দরকার। সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থার এ বিষয়ে দায়িত্ব নেওয়া প্রয়োজন। পাশ্চাত্যের কোনো কোনো দেশে আবর্জনা ফেলার দুটি ব্যবস্থা পাশাপাশি চালু আছে। একটিতে সাধারণ আবর্জনা, অন্যটিতে পলিথিনের মাধ্যমে সামগ্রী। তারা পলিথিন নষ্ট করে ফেলে। ফলে পলিথিনের মাধ্যমে পরিবেশ বিপন্ন হয় না। এমনি ব্যবস্থা আমাদের এখানেও নেওয়া যেতে পারে। সরকারের সিদ্ধান্তে কঠোরতা থাকতে হবে। সরকার নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কালো রঙের পলিথিন বর্জনের। অথচ তাও কার্যকর হচ্ছে না। সব পলিথিনই ক্ষতিকর। কিন্তু জনস্বাস্থ্যের জন্য কালো রঙের পলিথিন খুবই ক্ষতিকর। এই ব্যাগের রং বা পিগমেন্টের অধিকাংশই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। অনেক ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত পলিথিন গলিয়ে বাজারে সুলভ এবং বিষাক্ত রং ব্যবহারের মাধ্যমে কালো পলিথিন ব্যাগ তৈরি করা হয়। এতে উৎপাদন খরচ কম হয় বলে উৎপাদকরা এ পলিথিন উৎপাদনে আগ্রহী বেশি। সরকারের উচিত হবে কালো রঙের ব্যাগ উৎপাদন বন্ধে এখনই কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা। তাছাড়া বর্জ্য পলিথিন সংগ্রহের বিশেষ ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সংগ্রহ করে রিসাইকেল করার মাধ্যমে এর অপকারিতা অনেকাংশে হ্রাস করা যেতে পারে। সাধারণ একটা ধারণা পলিথিনের ব্যাগ খুবই সস্তা। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে অর্থাৎ প্রতিদিন এর ব্যবহারের পরিমাণ হিসাব করলেই বোঝা যাবে, প্রতিদিন এর পিছনে কত টাকা খরচ হয়। এ ক্ষেত্রে যদি চটের ব্যাগ ব্যবহার করা যায় তাহলে খরচ অনেক কমে আসবে। চটের ব্যাগ এক নাগাড়ে অনেকদিন ব্যবহার করা যায়। তাছাড়া চটের ব্যাগ ব্যবহার আমাদের হৃতগৌরব পাটশিল্পের ব্যাপক ব্যবহারের একটা সুযোগ সৃষ্টি হবে। কাগজের ব্যাগের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে পরিবেশে এদের কোনো বিরূপ প্রভাব নেই।

আফতাব চৌধুরী

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর