শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

শেকড়ের সন্তান : একজন আদুরী

অধ্যাপক ডক্টর আবু সাইয়িদ

শেকড়ের সন্তান : একজন আদুরী

১. বাবা-মা আদর করে নাম রেখেছেন আদুরী। খেটে খাওয়া পরিবারের একমাত্র কন্যা। দুরন্ত। চপলা। বাবা-মা লেখাপড়ার প্রাথমিক সোপান হিসেবে তাকে ভর্তি করে দেন প্রাথমিক স্কুলে। আদুরীর মাথা আছে। ক্লাসে প্রথম হয়। বাবা-মার গর্ব। শিক্ষকরা বলেন মেয়েকে পড়াতে হবে। লেখাপড়ায় মেধাবী আদুরী মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে। এখন সে কোথায় পড়বে? তিন কিলোমিটার দূরে কলেজ রয়েছে সেখানে ভর্তি হতে গেলে যে অর্থ লাগবে তা তার বাবার পক্ষে দেওয়া কষ্টকর। কিন্তু বাবার জিদ হলো যে করেই হোক মেয়েকে পড়াবে। ছাত্রী ভালো বলে কলেজে তার ভর্তির জন্য বাড়তি টাকা লাগে না। বাবাও দিন খেটে মেয়ের ভর্তির টাকা সংগ্রহ করেন। কিন্তু বই পাবে কোথায়? অথবা কলেজ ড্রেস? বহু কষ্টে চেয়েচিন্তে ধারদেনা করে তার ব্যবস্থা হয়। দুই বেলা প্রতিবেশী ছেলেমেয়েদের টিউশনি করে তার টুকটাক খরচ জোগাড় করে। রোদ হোক বৃষ্টি হোক কলেজে যাওয়া আসা করতে হয়। রিকশায় চড়লে কমপক্ষে লাগে ৪০ টাকা। হেঁটে তাকে চলতে হয় তবুও তার ক্লান্তি নেই। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ভালোভাবে।

২. খোঁজখবর নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সে চাকরির জন্য দরখাস্ত দেয়। কোনো কোনো জায়গা থেকে ইন্টারভিউ কার্ড আসে। পরীক্ষা দেয়। পরীক্ষা দেওয়ার সময় থেকেই দালাল চক্র পিছু লেগে যায়। প্রস্তাব নিয়ে আসে টাকা ছাড়া পাস হবে না, চাকরিও হবে না। বাস্তব অবস্থাও তাই। মেম্বার, চেয়ারম্যান, মেয়র ও এমপিদের কাছে গেলে তারা সহানুভূতি দেখান, সান্ত্বনা দেন। বলেন তুমি ভালো ছাত্রী চাকরি তোমার হবে। কিন্তু ওইসব ‘প্রভুদের’ চারপাশে যে দালালরা থাকে তারা বলে চাকরি হবে না, আগে মাল দাও। কত লাগবে? সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক হতে গেলে কমপক্ষে ৭ লাখ টাকা। আগে হাফ দাও, চাকরি হলে বাকিটা দিও। কানতে কানতে বাড়ি ফেরে আদুরী। বুঝতে পারে টাকা না থাকলে মেধার মূল্য নেই।

৩. প্রাইভেট পড়াতে অন্য গ্রামে যেতে হয়। পথের পাশে নানা জায়গায় বখাটে ছেলেদের আড্ডা। বাজে কথা শুনতে হয়। শুনেও না শোনার ভান করে। কেউ বা এসে সামনে দাঁড়িয়ে যায়। এরা আবার গ্যাং পার্টির সদস্য। ফেনসিডিল, হিরোইন, গাঁজা খায়। দলবেঁধে এলাকার বিভিন্ন জায়গায় মোটরসাইকেলের মহড়া দেয়। মাদক বিক্রি করে প্রকাশ্যে। প্রচুর লাভ। প্রশাসনের প্রশ্রয় আছে। থানা বা ইউএনও অফিসে নালিশ দিলেও কোনো কাজ হয় না। উল্টো বিপদ চলে আসে। ইদানীং তাদের হাতে অবৈধ পিস্তল দেখা যায়। থানা পুলিশ, প্রশাসন জেনেও জানে না। দেখেও দেখে না। কারণ তারা জানে এদের কাউকে ধরলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন আসবে। ছেড়ে দিতে হবে। সে জন্য কী দরকার এদের বিরুদ্ধে যাওয়ার। মন্ত্রী-এমপির লোক। আদুরী এখন বাইরে বের হতে ভয় পায়। সহজে বের হয় না।

৪. এসব বাবা যে জানে না তা নয়। সে জন্য তার বিয়ে দেওয়ার জন্য পাত্র খোঁজে। পাত্র পাওয়া যায়, সেখানেও দরকষাকষি। পাত্রপক্ষ বলে মেয়ে তো ভালো কিন্তু বিয়ের জন্য দিতে হবে কমপক্ষে একটা মোটরসাইকেল আর একটা টিভি অথবা ছেলেকে সরকারি চাকরি দিতে হবে। অন্তত চার-পাঁচ লাখ টাকার নজরানা। কিন্তু ভিতরের এই সর্বনাশা বেকারত্বের কথা, সামাজিক অবক্ষয়ের কথা তার ইনডেক্স কোথায়? পাসের হার দেখিয়ে, মেয়েদের শিক্ষার অগ্রগতি দেখে বিশ্ব চমৎকৃত হয়। আসলে এসব পাস করা গ্রামীণ মেয়েদের জীবন কীভাবে দুর্বিষহ হয়ে আছে তার খোঁজ কে রাখে? গ্রামের সমাজকাঠামো ভেঙে পড়েছে। বাপ-দাদারা যেভাবে সমাজের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতেন এখন তার নজির পাওয়া যায় না। অবৈধভাবে যার টাকা আছে আজ সেই সমাজপতি। সমাজের বিচার-আচার রীতিনীতি তারা মানে না। প্রশাসন তাদের হাতে। থানা তাদের কথা শোনে। সমাজের অবক্ষয় চরম পর্যায়ে। কেউ কারও কথা শোনে না। মানে না। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেও তা কার্যকরী হয় কতটুকু? গ্রামের মেয়েদের সেলফি তুলে ভাইরাল করবে বলে হুমকি দেয়।

মেয়েকে শায়েস্তা করার জন্য বানোয়াট নোংরা ছবি বানায়। বিচার বসায়। গোপনে টাকা দিয়ে তাদের হাত থেকে বাঁচতে হয়। গরিবদের জন্য বিশেষ করে মহিলাদের জন্য সরকারের বিশেষ বরাদ্দভাতা দুর্বৃত্তরা লুট করে নেয়। তাদের ওপর দিয়ে কথা বলবে তার সাহস কার? পত্রপত্রিকায় হরহামেশায় তাদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে খুনো-খুনির সংবাদ প্রকাশ পায়। এ রকম হাজারো ঘটনা। এই দুর্বিষহ সামাজিক পরিবেশে আদুরীরা যাবে কোথায়?

৫. এ রকম আদুরী গ্রামগঞ্জে কমপক্ষে ৩০ জন বেকার, কর্মহীন। প্রবৃদ্ধির হিসেবে ২ লাখ ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়েছে। যেন দিবালোকে ভূত দেখার মতো। খাতা-কলমে আছে কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। কী করবে এরা? এদের চোখের সামনে অন্ধকার ঝুলে আছে। দুঃখে-হতাশায় বিগত ৩১ আগস্ট নেত্রকোনার সালমা আক্তার সকাল ৭টার দিকে মিরপুর ১০ নম্বরের আকন্দ টাওয়ারে আসে। চাকরির পোস্ট খালি নেই জেনে চারতলা থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে। বর্তমান পরিসংখ্যান বলছে, বছরে ১৩ হাজার তরুণ-তরুণী আত্মহত্যা করে। কারণ একই। আস্থার জায়গা নেই। ভরসার স্থল নেই। জীবনের নিরাপত্তা নেই। জীবিকার ব্যবস্থা নেই। বছর কয়েক আগের ঘটনা। উচ্চশিক্ষিত রূপার কথা এখনো মনে আছে। না রূপা আত্মহত্যা করেনি। দুঃসাহসী সে। রাতের বেলায় বাসে করে কর্মস্থলে যাচ্ছিল। একা পেয়ে বাসের মধ্যে তিনজন হেলপার তাকে জোর করে ধর্ষণ করে। টাকা ছিল তাও কেড়ে নেয়। শেষে ঘাড় মটকিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে দেয়। রাষ্ট্রব্যবস্থা সবলের পক্ষে। ব্যাটাছেলেদের পক্ষে, মেয়েদের বিপক্ষে। শুধু তাই নয়, কথায় বলে বাঘে ছুঁলে এক ঘা, পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। থানায় একবার গেলে আর উপায় নেই। চারদিক থেকে ঘুষের বেড়াজাল চেপে ধরে। নারী নির্যাতন, ধর্ষণের মামলা হলে তো কথাই নেই। ধর্ষিতা থানায় যেতে চায় না। লুকাতে চায়। মুখ বন্ধ করে থাকতে চায়। সমাজে জানাজানি হলে তো আর কথাই নেই। কীভাবে ধর্ষণ করল, কোথায় নিয়ে ধর্ষণ করল, ধর্ষণের সময় ধর্ষিতা চিৎকার করেছে কিনা, গোপনাঙ্গে কোনো আলামত আছে কি না সব বলতে হবে। সর্বাঙ্গ খুলে দেখাতে হবে। থানায় গেলেও যা, সমাজ-বিচারেও একই রূপ। কমছে না। বেড়েই চলছে। পরিসংখ্যান তাই বলে।

৬. আমরা গর্ব করে বলি শিক্ষিত মেয়ের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। যেমন সরকার বলছে তেমনি পরিসংখ্যানে তার সাক্ষ্য মিলছে। বাড়লেও সে অনুপাতে বাড়ছে না মেয়েদের চাকরির বাজার কিংবা কর্মসংস্থান। শিক্ষিত মেয়েরা প্রায় শতকরা ৬০ ভাগই পাচ্ছে না কাজ। দেশের কাজে লাগছে না। সামাজিক বিপর্যয়েরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষিত তরুণীদের জীবনের গল্প থেকে বেরিয়ে আসে এরূপ নানা করুণ কাহিনি। পাশের গ্রামের এক বখাটে ছেলে তাকে বিয়ে করতে না পেরে বাড়িতে চড়াও হয়। বাবা-মাকে অপমান করে। ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে। এ অবস্থায় আদুরী কী করবে। মনে বল আছে। নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়। ঢাকায় চলে আসে। দূর সম্পর্কের এক ফুফুর বাড়িতে ওঠে। গাদাগাদি করে থাকে। ভাবনা তাকে সম্ভাবনার পথে নিয়ে যায়। সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। সিদ্ধান্ত নেয় ল’ পড়বে। আইনজীবী হবে। স্বাধীন পেশায় উন্নত শিরে দাঁড়াবে। ল’ কলেজের সহপাঠী অনেক। কেউবা গাড়ি করে আসে। কেউ বা রিকশায়। দামি পোশাক। ঝলমলে। মুখ পরিপাটি করা। জিন্স পরা অনেকেই। তারা রাতের পার্টিতে যায়। এখানে এসে ডিসকো ডান্সের গল্প করে। তাদের কথা হলো, জীবন কদিন? যৌবন কদিন থাকে? ইনজয় করো। এরা লুটেরা ধনীদের উচ্ছন্ন সন্তানদের একাংশ।

৭. সঙ্গী নেই কথা বলার। আদুরী কলেজে একাকী। এভাবে মানুষ বাঁচে। তাকে বাঁচতে হবে। বড় হতে হবে। জীবনের প্রতিজ্ঞা। তার পোশাক চলাফেরা দেখে অনেকে কটূক্তি করে। কেউ বলে ‘বস্তির মেয়ে’ আবার কেউ বলে ‘গ্যারাইম্যা’। আদুরী চুপ করে থাকে। ক্লাসে শিক্ষক আসে পড়া ধরে। জড়োসড়োভাবে সে উত্তর দেয়। শিক্ষক বুঝতে পারে। ক্লাস শেষ হওয়ার পর তাকে ডেকে সব জিজ্ঞাসা করে। তার ক্লাস ফি অর্ধেক করে দেয়। এক সহপাঠী-সেও গ্রাম থেকে এসেছে। বাবা ঢাকায় চাকরি করে। সে তার মনের যন্ত্রণা বুঝতে পারে। একটি মেস ঠিক করে দেয়। আদুরী টিউশনি জোগাড় করে। দুই বেলা পড়ায়। মার কাছ থেকে হাতের কাজ শিখেছে। সুন্দর করে কাপড়ে সুই-সুতা দিয়ে গ্রামীণ ছবি ফুটিয়ে তোলে। কয়েকটি শপিং মলে সাপ্লাই দেয়।

৮. গ্রামের তরুণীদের দেহমন পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বিবর্ণ। বাংলাদেশ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে অগ্রগতির মাধ্যমে এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে রূপান্তর করার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে তা শুধু কথামালার রাজনৈতিক স্লোগান। শিক্ষার সুযোগ, শিক্ষার মান ও ভবিষ্যৎ কর্মক্ষম জনশক্তি তৈরিতে ১২২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৪। স্বাস্থ্য ও সুস্থতায় বাংলাদেশের ওই একই অবস্থান। শারীরিক স্বাস্থ্য ও মানসিক সেবা পাওয়ার সূচকে প্রান্তিক পর্যায়ে। পুষ্টি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আদুরীদের রোগাক্রান্ত পান্ডুরের চোখ-মুখের দিকে তাকালেই পরিষ্কার হবে। যে বয়সে উজ্জ্বল চেহারায় দীপ্ত এবং স্বপ্নময় জাগতিক সৌন্দর্যের স্নিগ্ধতায় ঝলমলে থাকার কথা সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পুষ্টিহীনতায় মেয়েরা রুগ্ন, ব্যাধিগ্রস্ত। ২২ সালের রিপোর্টে দেখা যায়, প্রায় পৌনে ২ কোটি মহিলা অপুষ্টিতে ভুগছে। লেখাপড়া যেন তাদের জীবনে এখন অভিশাপ।

৯. সম্প্রতি ব্রিটেনের দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের স্নাতক পাস ছেলেমেয়েদের মধ্যে ৪৭ শতাংশই বেকার। এর মধ্যে বেসরকারি জরিপ মতে, গ্রামের মেয়েরা ৬০ ভাগই বেকার। এর মধ্যে ১০ ভাগ গার্মেন্টে চলে আসে, যারা কম লেখাপড়া বা নামমাত্র লেখাপড়া করেছে। তারা ঢাকায় এসে গার্মেন্ট বা দর্জি কারখানায় কাজ করে। আইএলওর তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে বেকার ও ছদ্মবেকারের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। সরকার চেষ্টা করছে। কিন্তু সামাজিক-পারিবারিক স্তরে তারা আটকে আছে। ভারতের পার্লামেন্টে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির অর্ধেক হবে নারী। নারী-পুরুষের নির্বাচিত হওয়ার সম-অধিকার সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে। আমাদের দেশে সংসদে নারীদের আসন অনুপাত ৬ শতাংশ। তাও আবার সংরক্ষিত। দল ও পুরুষ সংসদ সদস্যদের কাছে তারা যেন করুণার প্রার্থী।

১০. তারপরও আদুরীদের আত্মপ্রত্যয় ও প্রচেষ্টা জীবনের নতুন বোধ জাগ্রত হচ্ছে। এদের অন্তর-মনে অন্তহীন উদ্যোগ ও প্রেরণার উৎসধারা। তারা ভয়কে জয় করার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। সংবিধানে বর্ণিত, ‘জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের ক্ষমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবে।’ যা ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন-সাধনা। এখন তা মরীচিকার মতো। দুঃস্বপ্নের মতো দাঁড়িয়ে আছে। দিন বদল হচ্ছে। মানুষ জাগ্রত হচ্ছে। দুষ্কৃতকারী, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠবে সামাজিক প্রতিরোধ। সামাজিক অচলায়তন ভেঙে আদুরীরা এগিয়ে যাবেই।

সেই স্বপ্নোজ্জ্বল আলোকিত দিনের আশায় নিরন্তর লড়াই করে যাচ্ছে গ্রামীণ জীবনের আদুরীরা। সুশিক্ষিত আদুরীরাই দিন বদলে এগিয়ে যাবে দৃপ্ত পায়ে।

লেখক : সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ও খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য

সর্বশেষ খবর