শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আমাদের পাতে ফিরুক স্বাদের দেশীয় মাছ

শাইখ সিরাজ

আমাদের পাতে ফিরুক স্বাদের দেশীয় মাছ

নদীমাতৃক দেশ বলে এক সময় মিঠাপানির মাছের বৈচিত্র্য ছিল বিস্ময়কর। বাংলাদেশের নদী-নালা, খাল-বিলজুড়ে ছিল দেশীয় প্রজাতির নানা রকমের মাছ। তাই বাঙালির সমৃদ্ধতম ঐতিহ্যের কথা বলতে গেলে মাছের কথা উঠে আসে সবার আগে। ‘মাছে ভাতে বাঙালির’ মাছ প্রীতি পৃথিবীখ্যাত। আমাদের সাহিত্য, সিনেমা, গান থেকে নিত্যদিনের যাপন সবখানেই জায়গা করে আছে মাছের গুণগান। প্রাকৃতিক মাছের ভাণ্ডার ছিল আমাদের নদী আর বিলগুলো। গবেষকরা বলছেন, দেশে মিঠা পানির মাছের মোট প্রজাতির সংখ্যা ২৬০টি। কিন্তু জনসংখ্যার বিস্ফোরণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং আমাদের অসচেতনতায় নদী-নালার পানি যেমন দূষিত হয়েছে, হারাতে বসেছে খাল-বিল। সঙ্গে সঙ্গে হারাতে বসছে নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ। এ ছাড়াও মাত্রাতিরিক্ত মাছ আহরণ, জলাশয় সংকোচনসহ নানাবিধ কারণে অনেক মাছের প্রজাতি আজ বিলুপ্তপ্রায়। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) ২০০০ সালে ৫৪ প্রজাতির মাছের বিলুপ্তপ্রায় তালিকা প্রকাশ করে। ২০১৫ সালে আরও ৬৪ প্রজাতির মাছকে সেই তালিকায় যুক্ত করে। সে হিসাবে বলা যায়, ১১৮ প্রজাতির দেশীয় মাছ বিপন্ন অবস্থায় আছে।

তবে আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বিপন্ন মাছগুলোকে রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। তারা বিলুপ্তপ্রায় মাছগুলো মানুষের পাতে ফেরাতে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করে চলেছে।

মাস ছয়েক আগে গিয়েছিলাম ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে। বিলুপ্তপ্রায় মাছ নিয়ে তাদের কার্যক্রমের কিছু চিত্র দেখে এসেছি।

বিলুপ্তপ্রায় মাছের তালিকায় আছে দেশীয় শোল মাছ। মাছপ্রেমী মানুষ মাত্রই জানেন শোল মাছের স্বাদের কথা। বিএফআরআই দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল আবিষ্কারে এবার হ্যাচারিতে শোল মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জন করেছে। মিঠাপানির দেশীয় প্রজাতির জনপ্রিয় শোল মাছ খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি পুষ্টিগুণসম্পন্ন। ফলে বাজারে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। আইইউসিএন ঘোষিত বিলুপ্তপ্রায় মাছের তালিকায় থাকা শোল মাছকে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে এর কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনা কৌশল উদ্ভাবনের লক্ষ্যে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহের স্বাদুপানি কেন্দ্রে এ মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন নিয়ে গবেষণা শুরু করে। শোলকে চাষের আওতায় আনার কার্যক্রম সম্পর্কে ব্যাখ্যা করলেন প্রতিষ্ঠানটির বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রবিউল আওয়াল। তিনি আশা প্রকাশ করলেন, বছরখানেকের মাঝেই হ্যাচারিতে শোল মাছের পোনা উৎপাদন সম্ভব হবে।

বলে রাখতে চাই, বেসরকারি খামারিদের উদ্যোগে চাষের জন্য ২০১১ সালে ভিয়েতনাম থেকে শোল মাছের পোনা দেশে আমদানি করা হয় এবং চাষাবাদ শুরু হয়। কিন্তু বিদেশি এ মাছ দেশে তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। বিএফআরআই বলছে, খুব অল্প সময়ের মধ্যে দেশীয় শোল মাছের পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে হস্তান্তর করা সম্ভব হবে। চাষের মাধ্যমে এ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এ মাছ রপ্তানিও করা যাবে। একটু এগোতেই চোখে পড়ল বিএফআরআইয়ের গবেষণা পুকুরে কাজ করছেন দুই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আ ন ম রিজভী কায়সার ভূঁঞা ও ড. মো. মশিউর রহমান। তারা কাজ করছেন আরেক জনপ্রিয় মাছ কালিবাউসের জাত উন্নয়ন নিয়ে। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের হাওর থেকে কালিবাউস মাছ সংগ্রহ করে এনেছেন তারা। পুকুর থেকে জাল দিয়ে তুলে আনলেন বড় বড় কালিবাউস। ড. মশিউর বললেন, কালিবাউস মাছটি বিপন্ন তালিকায় আছে। এর প্রজনন হার খুব কম। দিনে দিনে মাছটির গায়ের রংও উজ্জ্বলতা হারাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি এর উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি এর উজ্জ্বলতাও ফিরিয়ে আনার। এই মাছটাকে দেখুন, বাজারে বা হাওরে যেসব কালিবাউস মাছ পাওয়া যায়, তার তুলনায় রংটা কতো সুন্দর!’ দেখলাম সত্যি, তাদের উৎপাদিত কালিবাউস মাছগুলো আকারে যেমন বড়, তেমনি গায়ের কালো রংটাও বেশ উজ্জ্বল।

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) ২০১৫ সালের তথ্যমতে, ৬৪ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাছের তালিকায় আছে নদীনালা হাওর-বাঁওড়ের মাছ শাল বাইম। বিলুপ্তপ্রায় এ শাল বাইমকে আমাদের পাতে ফেরাতে দীর্ঘ আট বছর ধরে কাজ করছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। ইতোমধ্যে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। এখন চলছে চাষাবাদ পদ্ধতি আবিষ্কারের কাজ। সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার ড. সেলিনা ইয়াসমিন তাদের কার্যক্রম ঘুরিয়ে দেখালেন। হাতে-কলমে দেখালেন কীভাবে কৃত্রিম প্রজননের কাজটি তারা করছেন। তিনি জানালেন, প্রতি ১০০ গ্রাম শাল বাইমে ৩০৩ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়, যেখানে অন্যান্য মাছের ক্ষেত্রে তা প্রতি ১০০ গ্রামে মাত্র ১১০ ক্যালরি। শাল বাইমকে চাষের আওতায় আনা গেলে দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের পরিমাণ যেমন বাড়বে, পুষ্টির চাহিদা পূরণেও এ মাছ রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

বিএফআরআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ধারাবাহিকভাবে গবেষণার মাধ্যমে পাবদা, টেংরা, শিং, মাগুর, গুলশা, গুজি আইর, চিতল, ফলি, মহাশোল, বৈরালি, জাত পুঁটি, মেনি, বালাচাটা, গুতুম, কুঁচিয়া, বাগনা, খলিশা, বাটা, দেশি সরপুঁটি, কালিবাউশ, দেশি কৈ, গজার, গনিয়া এবং আঙ্গুস বা আগুনমুখা এসব প্রজাতির দেশীয় মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া ইনস্টিটিউট বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় মাছ ঢেলা, শাল বাইম, রানী, কাজলি, পিয়ালি, বাতাসি, কাকিলা, ভোল, বাইক্যা ও মিঠা পানির পোয়া মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ নিয়ে গবেষণা করছে। কথা হলো বিএফআরআইয়ের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘প্রাচীনকাল থেকে দেশি প্রজাতির মাছ আমাদের সহজলভ্য পুষ্টির অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এসব মাছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ রয়েছে। এসব উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলে এবং রক্তশূন্যতা, অন্ধত্ব প্রভৃতি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। আমরা চেষ্টা করছি গবেষণার মাধ্যমে এসব মাছের চাষপ্রযুক্তি আবিষ্কারের। বেশ কিছু প্রযুক্তি আমরা মাঠ পর্যায়ে হস্তান্তর করেছি। প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারিত হওয়ায় বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছের প্রাপ্যতা সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মাছের মূল্য সাধারণ ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এসেছে।’ তাদের কার্যক্রমের বিস্তার সম্পর্কে ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ‘এর আগে শুধু ময়মনসিংহের স্বাদুপানির মাছ গবেষণা কেন্দ্র থেকে বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে গবেষণা পরিচালনা করা হতো। এখন ময়মনসিংহের কেন্দ্র ছাড়াও বগুড়ার সান্তাহার, নীলফামারীর সৈয়দপুর এবং যশোর উপকেন্দ্রেও বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণে গবেষণা পরিচালনা করা হচ্ছে।’

আমরা চাই হারাতে বসা জনপ্রিয় দেশীয় জাতের মাছগুলো ফিরে আসুক। এতে আমাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণে যেমন সহায়ক হবে, পাশাপাশি রয়েছে ঐতিহ্যবাহী মাছের আন্তর্জাতিক বাজার তৈরির সম্ভাবনা। আমরা গবেষকদের এ উদ্যোগগুলোর শতভাগ সাফল্য কামনা করি। প্রত্যাশা করি হারাতে বসা সব দেশীয় প্রজাতির মাছ এক দিন আমাদের পাতে ফিরবে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর