শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

এখনো সমকালীন সৈয়দ মুজতবা আলী

প্রতিদিন ডেস্ক

এখনো সমকালীন সৈয়দ মুজতবা আলী

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা রম্য লেখক, পণ্ডিত ও অসীম জীবনবোধের পরিপূর্ণ সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি ইংরেজি, আরবি, ফারসি, রুশ, জার্মান, সংস্কৃতসহ ২২টি ভাষা জানতেন। বহু ভাষাবিদ অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী সৈয়দ মুজতবা আলীর পড়াশোনার বিস্তৃতিও ছিল বিশাল। তিনি ভাষা, ধর্ম, দর্শন, সমাজতত্ত্ব সবকিছুতেই সমানভাবে আগ্রহী ছিলেন। লেখাপড়া করেছিলেন বিশ্বভারতী, আলীগড়, জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয় ও কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্ম ১৯০৪ সালের দিনে অর্থাৎ ১৩ সেপ্টেম্বর আসামের করিমগঞ্জে। নিজের সৃষ্টি আর কর্মের মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে আছেন বাংলা সাহিত্যে। সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯২৬ সালে বিশ্বভারতী থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। আফগানিস্তানে কাবুলের কৃষিবিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। সৈয়দ মুজতবা আলী নিজস্ব এক গদ্যশৈলীর নির্মাতা। বিভিন্ন ভাষায় ব্যুৎপত্তি ও অসাধারণ পাণ্ডিত্যের সংমিশ্রণে তিনি যে গদ্য রচনা করেছেন তা খুবই রসগ্রাহী হয়ে উঠেছে। কাজী নজরুল ইসলামের পর বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেন সৈয়দ মুজতবা আলী। সেই সময়কার সব ছোট-বড় কাগজে নিয়মিত লিখতেন তিনি। এসব পত্রিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মোহাম্মদী, চতুরঙ্গ, মাতৃভূমি, কালান্তর, আল-ইসলাম, আনন্দবাহার, দেশ, শনিবারের চিঠি, বসুমতী প্রভৃতি। সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রথম রচনা ‘নেড়ে’ নামের একটি গল্প। ১৯-২০ বছর বয়সে লিখিত এ গল্পটি বিশ্বভারতী দেয়াল পত্রিকায় ১৯২৩-২৪ সালে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে এটি সংকলিত হয়ে ছাপার হরফে আসে ১৯৬৭ সালে ‘পছন্দসই’ শীর্ষক গ্রন্থে। ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত ‘দেশে বিদেশে’ ভ্রমণ কাহিনির মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। এটিকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ভ্রমণ কাহিনি হিসেবে মানা হয়। এ ভ্রমণ কাহিনিতে তিনি নান্দনিকভাবে আফগানিস্তানের কাবুল শহরকে তুলে ধরেছেন। আবদুর রহমান, অধ্যাপক বেনওয়া, আহমদ আলী, খুদাবখশ, বগদানফ, মুইন-উস-সুলতান প্রভৃতি তাঁর দেশে বিদেশে গ্রন্থের চরিত্র। অবশ্য বই আকারে প্রকাশের আগে ১৯৪৮ সালে দেশ পত্রিকায় দেশে-বিদেশে ভ্রমণ কাহিনিটি প্রকাশ পেয়েছিল। সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত প্রথম উপন্যাস-অবিশ্বাস্য প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে। সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থ হলো- পঞ্চতন্ত্র (আষাঢ়, ১৩৫৯), চাচা কাহিনী (আষাঢ়, ১৩৫৯), ময়ূরকণ্ঠী (চৈত্র, ১৩৫৯), পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা (বৈশাখ, ১৩৬৩), জলে ডাঙ্গায় (মাঘ, ১৯৬৩), ধূপছায়া (পৌষ, ১৩৬৪), দ্বন্দ্বমধুর (বৈশাখ, ১৩৬৫), চতুরঙ্গ (ভাদ্র, ১৩৬৭), শবনম (১৩৬৭), শ্রেষ্ঠ গল্প- সংকলন গ্রন্থ (জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৯), ভবঘুরে ও অন্যান্য (জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৯), বহু বিচিত্র-সংকলন গ্রন্থ (আষাঢ়, ১৩৬৯), শ্রেষ্ঠ রম্যরচনা- সংকলন গ্রন্থ (ভাদ্র, ১৩৬৯), টুনি মেম (চৈত্র, ১৩৭০), প্রেস-অনুবাদ (শ্রাবণ, ১৩৭২), বড় বাবু (ফাল্গুন, ১৩৭২), দু-হারা (চৈত্র, ১৩৭২), পঞ্চতন্ত্র-দ্বিতীয় পর্ব (আষাঢ়, ১৩৭৩), হাস্যমধুর-সংকলন গ্রন্থ (অগ্রহায়ণ, ১৩৭১), পছন্দসই- সংকলন গ্রন্থ (আশ্বিন, ১৩৭৪), রাজা উজির (বৈশাখ, ১৩৭৬), শহর ইয়ার (ভাদ্র, ১৩৭৬), হিটলার (১৩৭৭), কত না অশ্রুজল (বৈশাখ, ১৩৭৮), মুসাফির (অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮)। মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয়’ (ফাল্গুন, ১৩৮২), ‘তুলনাহীনা’ (১৯৭৪ ইং)। এসব গ্রন্থের গ্রহণযোগ্যতা ও সময়ে সময়ে আজও বিশেষ মুদ্রণ জানিয়ে দেয়, সৈয়দ মুজতবা আলী এখনো সমকালীন। তিনি যুগ যুগ ধরে জিইয়ে থাকবেন তাঁর অমর সৃষ্টি ও লেখনীর পাঠ ও বিস্তৃতির মাধ্যমে। সৈয়দ মুজতবা আলী সম্পর্কে এ দৈন্যের কারণ তাঁর সম্পর্কে লেখালেখি হয়েছে খুবই কম। তিনি নিজেও তাঁর সাহিত্য জীবন সম্পর্কে কোনো কৌতূহল পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, ‘আমি বেঁচে থাকতে কেউ আমার সম্পর্কে কিছু লেখুক, সেটা আমি চাই না। তবে, আমার মৃত্যুর পর যে যত খুশি লেখুক, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।’ মৃত্যুর আগ অবধিও তাঁর রসবোধ বজায় ছিল। বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর পর সবাইকে বলবে আলী সাহেব তার বেস্ট বইটা লেখার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু কী করবেন, উনার তো প্যারালাইসিস হয়ে ডান হাতটা অবশ হয়ে গেল। হাতটা ভালো থাকলে তিনি দেখিয়ে দিতেন সৈয়দ মুজতবা আলীর বেস্ট বই কাকে বলে।’ সাহিত্যে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৫০ সালে তিনি নরসিং দাস পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬১ সালে কলকাতায় তাঁকে আনন্দ পুরস্কার প্রদান করা হয়। সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন। ১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ৭০ বছর বয়সে ঢাকায় তিনি ইন্তেকাল করেন।

সর্বশেষ খবর