রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার চাই

এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া

মেধা বিকাশে শৈশবেই শিশুর প্রতি যত্নবান হতে হবে। এ দায়িত্ব প্রাথমিকভাবে মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদের। এরপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে শিশু প্রথম পা রাখে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা মুখ্য। দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫,৫৬৬, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৪,৭৯৯, ইবতেদায়ি মাদরাসা ৩,৮৩৯, কিন্ডারগার্টেন ২৮,১৯৪, এনজিও স্কুল (গ্রেড ১-৫) ৩,৭৫৩, উচ্চ মাদরাসা সংযুক্ত প্রাথমিক শাখা ৩,৫৩৪, উচ্চ বিদ্যালয় সংযুক্ত প্রাথমিক শাখা ১,৯৮৮, এনজিও লার্নিং সেন্টার ২০৫, শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয় ১,৬১৪, অন্যান্য ৫,৪০০। সর্বমোট ১,১৮,৮৯১টি (সূত্র : বেনবেইস ২০২১)।

আমাদের দাবি, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একাডেমিক লাইব্রেরি বা শিক্ষায়তন গ্রন্থাগার স্থাপন করতে হবে। সরকারি স্কুলেই প্রথম শুরু করতে হবে। পাঠক আপনা-আপনি তৈরি হয় না। তৈরি করতে হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাঠক তৈরির মূল উৎস। সেখান থেকেই পাঠক তৈরি করতে হবে। তাহলে পড়ুয়া এবং প্রকৃত শিক্ষিত জাতি তৈরি হবে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে ১৯৭২ সালে সংবিধান রচিত হয়। সংবিধানে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রাথমিক শিক্ষা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনা করেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে ৩৬,১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। দীর্ঘকাল পর তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ২০১৩ সালে আরও ২৬,১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হয়।

দেশদ্রোহী ঘাতকরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের আঁধারে জাতির পিতাকে হত্যা করে। দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। জাতির পিতা বেঁচে থাকলে এ দেশের মানুষ আরও আগেই হয়তো মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বিনা বেতনে পড়ালেখার সুযোগ পেত বলে আমাদের বিশ্বাস।

সরকার মাধ্যমিক স্তরে (হাইস্কুল ও দাখিল মাদরাসা) সহকারী শিক্ষক মর্যাদায় গ্রন্থাগারিকের পদ সৃষ্টি করেছে। পদটি এমপিওভুক্ত। গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের নাম বর্তমানে ‘তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা’। এই সাবজেক্ট ক্লাসরুটিনের অন্তর্ভুক্ত করে কার্যক্রম পরিচালনায় সরকারের নির্দেশনা রয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারিক (সহকারী শিক্ষক) পদ নেই, গ্রন্থাগার স্থাপনের নির্দেশনাও নেই। বিষয়টি এমন যে, আমি একটি পাঁচতলা বাড়ি বানালাম, কিন্তু উপরতলায় ওঠার সিঁড়ি নেই। কাজেই মাধ্যমিক স্তরে বিষয়টির সঙ্গে পরিচয় না থাকায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর বাড়তি ‘বই পড়া’র কথা বললে শিক্ষার্থীরা হোঁচট খায়। এমনটি কাম্য নয়।

আমাদের প্রস্তাব : (ক) প্রাথমিক স্তরে ‘তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা’ সাবজেক্ট (বিষয়) চালু করতে হবে। অন্তত তৃতীয় শ্রেণি থেকে করা যেতে পারে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে তা অব্যাহত থাকবে। (ক) প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক (তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা) পদ সৃষ্টি করতে হবে, (খ) রুটিনে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাহলে ‘পড়ুয়া’ ও ‘সচেতন নাগরিক’ তৈরির কাজ সহজ হবে।

বরাদ্দ : শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটে সামগ্রিক শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মাত্র ০.৯২ শতাংশ। উচ্চশিক্ষা উপ-খাতে বরাদ্দ মাত্র ০.১২ শতাংশ, যা সার্কভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারত ও নেপালে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মোট জিডিপির তুলনায় যথাক্রমে ৪.৫ ও ৩.৫ শতাংশ। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমান জাতীয় বরাদ্দ ০.৯২ থেকে ক্রমান্বয়ে ২০২৬ সালের মধ্যে ২ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ শতাংশে উন্নীত করা আবশ্যক। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের লক্ষ্যে শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের বর্তমান বরাদ্দ ৮ থেকে ১৫ শতাংশে উন্নীত করার পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ইউনেস্কোর সুপারিশ মতে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৭ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু বার্ষিক বিনিয়োগের পরিমাণ বাংলাদেশে ৫ ডলার, ভারতে ১৪ ডলার, মালয়েশিয়ায় ১৫০ ডলার ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৬০ ডলার।

শিক্ষার গুণগত উৎকর্ষে প্রয়োজন সমন্বিত ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা। তার মধ্যে আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম, পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, প্রয়োজনীয় শিক্ষাদান সামগ্রী ও ভৌত অবকাঠামো, যথার্থ শিক্ষন-শিখন পদ্ধতি, উপযুক্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং ধারাবাহিক পরিবীক্ষণ ইত্যাদি।

দুর্বলতা : বেসরকারি সংগঠন ওয়েব ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের প্রায় ১৯ শতাংশ বাংলা বর্ণ পড়তে পারে না। বাংলায় লেখা শব্দ চিনতে পারে না ৩৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। দেশের দুটি জেলার ১,৫৩৩ শিক্ষার্থীর ওপর পরিচালিত জরিপে এ তথ্য মিলেছে। এ অবস্থায় গুণগত মান নিশ্চিতে ১০টি সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। তার মধ্যে রয়েছে শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত, শিক্ষকদের ক্লাসে নিয়মিতকরণে তদারকি বাড়ানো, শ্রেণির পাঠদান শ্রেণিতেই সম্পন্ন, পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক বাড়ানো।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি ও বেরাইদ গণপাঠাগার

সর্বশেষ খবর