সোমবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

অক্টোবরে রাজনীতিতে কী হতে চলেছে

মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

অক্টোবরে রাজনীতিতে কী হতে চলেছে

আজ ১৬ অক্টোবর। মাসের অর্ধেকেরও বেশি দিন পার হয়ে গেছে। কিছুদিন ধরে বিএনপির হাবভাব, কথাবার্তা, হুমকি-ধমকি ও ঘোষণা শুনে মনে হচ্ছে অক্টোবর না যেতেই তারা সরকারের পতন ঘটিয়ে ছাড়বে। এসব হুংকারের কম্পনে সরকারের পতন ঘটবে, নাকি শেষ পর্যন্ত অশ্বডিম্ব নিয়ে বিএনপিকে ঘরে ফিরতে হবে, তা নিয়ে এখন ঘরোয়া রাজনৈতিক আলাপ বেশ জমে উঠেছে। বলতেই হবে, কিছুটা শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা ছড়াতে বিএনপি সফল হয়েছে। এত দিন, গত ১৫ বছর সব সেক্টরে আওয়ামী লীগ সরকারের সর খাওয়া একটা গোষ্ঠী, যারা সব সময় সরকারি পার্টি করে, তারা বেশ কিছুটা চিন্তিত। দেখা হলেই তাদের মুখে শোনা যায় ভাই কী হচ্ছে, ইত্যাদি। এসব নিয়ে লিখব ভেবে পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে ২০১৩ সালের ২৩ নভেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ প্রতিদিনের কপিটির ওপর নজর পড়ল। ওই দিনের পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হওয়া তিনটি শিরোনাম তুলে ধরছি। প্রধান শিরোনামটি ছিল- রাজনৈতিক সংকটের আশঙ্কা ইউরোপীয় পার্লামেন্টের। দ্বিতীয় শিরোনামটি ছিল- প্রস্তুত নির্বাচন কমিশন, ৫ জানুয়ারি ভোট। আর তৃতীয় বড় শিরোনামটি ছিল- ঢাকার বিক্ষোভ সমাবেশে ফখরুল- তফসিল ঘোষণা করা হলে দেশ অচল করে দেওয়া হবে। বিএনপি তখন জামায়াতসহ ২০-দলীয় জোট নিয়ে বেশ শক্তিশালী।

জামায়াতের ক্যাডার বাহিনীর শক্তি তখন প্রবল। তারা তখন কয়েকটি ঘটনায় পুলিশ বাহিনীর কয়েকজন সদস্যকে হত্যা ও পিটিয়ে বিএনপির কাছে বেশ সমাদর লাভ করেছে। বিএনপির সব সমাবেশে জামায়াতেরই প্রাধান্য। তারা বিএনপির কর্মীদের ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে সবার আগে মঞ্চের কাছে অবস্থান নিত। বেগম খালেদা জিয়া তখন সুস্থ ও সবল। লাগাতার সমাবেশ ও রোডমার্চ করছেন, দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাচ্ছেন। ঘোষণা দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে কোনো আপস হবে না। সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে এনে তাদের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। এর শর্টকাট কিছুই মেনে নেওয়া হবে না। আপসহীন নেত্রী তাঁর কথা রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগ বাড়িয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করলেন, আপসের প্রস্তাব দিলেন। বললেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আরও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ও আপনাদের দেওয়া হবে, আপনারা নির্বাচনে আসুন। কিন্তু নেত্রী আপসহীন। প্রধানমন্ত্রীকে কড়া ভাষায় বললেন, ‘ক্ষমতা ছাড়ুন, ভালোয় ভালোয় বিদায় হন। সরকার পতনের আন্দোলনে বিএনপি তখন বেগবান। বেগম জিয়ার নেতৃত্বে রোডমার্চে তখন বিশাল বিশাল সমাবেশ হচ্ছে একটার পর একটা। ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর রোডমার্চ শেষে চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক বিশাল জনসভায় বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা দিলেন- নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, স্বাধীনতাবিরোধী নয়, তাদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। (সমকাল, ২০ অক্টোবর, ২০১১)।

২০-দলীয় সঙ্গী ইসলামী ঐক্যজোটের যে নেতা সেøাগান দিয়েছিলেন, ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ সেই নেতা সম্পর্কে সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, তাকে গ্রেফতার করা হলে এর পরিণতি ভালো হবে না। সুতরাং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে তারা বয়কট করলেন। ঘোষণা দিলেন নির্বাচন প্রতিহত করা হবে। তখন ৫ জানুয়ারি ভোট গ্রহণের দিন এবং তার আগে ও পরে কয়েক সপ্তাহ দেশব্যাপী ভয়ানক সহিংসতা চলে। নির্বাচন প্রতিহত করার নামে ভোট কেন্দ্র হিসেবে নির্দিষ্ট প্রায় দেড় শতাধিক স্কুল, কলেজ, মাদরাসায় আগুন দেওয়া হয়। প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসারদেরও হত্যা করা হয়। ভোট দিতে আসা-যাওয়ার পথে নিরীহ মানুষ জামায়াত-বিএনপির ক্যাডার বাহিনীর হত্যার শিকার হয়। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা ছিল নির্বাচনের পর জামায়াত-বিএনপির ক্যাডার বাহিনী কয়েকদিন ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ শুধু নয়, অনেক জায়গায় ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া এবং লুটপাট করা হয়। সে সময়ের দৈনিক প্রথম আলোর একটা কপি আমার সংরক্ষণে আছে। প্রথম আলোর ২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারি সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় একটা ছবিতে দেখা যায়- একজন হিন্দু নারীর হৃদয়ভাঙা কান্নার সঙ্গে ভয়ার্ত হয়ে মায়ের কোলের শিশুটিও চিৎকার করে কান্না করছে। এ ছবি দেখে যার চোখে পানি আসে না, তাকে মানুষ বলা যায় না। ছবির ক্যাপশনে লেখাটি এখানে হুবহু তুলে ধরছি- ‘খাবারের জন্য কাঁদছে শিশু বিপাশা বর্মণ। কাঁদছেন মা সঞ্চিতা বর্মণও। কারণ, ঘরে খাবার নেই। খাবার আসবে কোথা থেকে? ঘর তো নেই! ঘরদোর, সহায়-সম্বল গেছে এমন ১২২ সংখ্যালঘু পরিবারের। গত রবিবার নির্বাচনের পর রাতে যশোরের অভয়নগর উপজেলার চাঁপাতলা গ্রামের মালোপাড়ায় বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় ১০টি বাড়ি। জামায়াত-শিবির এ নারকীয় হামলা চালিয়েছে বলে জানাল স্থানীয় লোকজন।’ আন্তর্জাতিক অনেক পত্রিকায় এ ছবিটি ইংরেজি ক্যাপশনে ছাপা হয়েছিল। এ কারণেই ওই নির্বাচনের পরপর বিএনপির একজন জেলা পর্যায়ের নেতা রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলে কানাডার একটি ফেডারেল আদালত রায় দিয়েছিলেন- বাংলাদেশে বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল, তাই রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার যোগ্য নয়। তখন শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বের মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠেছিল এটাই কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ। এত নিষ্ঠুর সহিংসতা চালিয়েও জামায়াত-বিএনপি জোট তখন নির্বাচন প্রতিহত করতে পারেনি। নির্বাচনের সাংবিধানিক ও আইনগত বৈধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। ওই নির্বাচনে নির্বাচিত দুজন সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী ও শিরীন শারমিন চৌধুরী যথাক্রমে আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন ও কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ভোটের মাধ্যমে, অন্য দেশের প্রার্থীকে পরাজিত করে। দুটি অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা নিশ্চয়ই চোখ-কান খোলা অবস্থায় এবং নিজ নিজ দেশের স্বাধীন সত্তা ও মর্যাদা বজায় রেখে ভোট প্রদান করেছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সে নির্বাচনে ১৫১ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, যা গণতান্ত্রিক পরিবেশে প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু কেন এমনটা হলো। আগ বাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপক ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব বিএনপি সে সময়ে প্রত্যাখ্যান করার কারণেই তো সবকিছু ভিন্ন রকম হয়ে গেল। বিএনপি তখন তো আলোচনায় বসতেও রাজি হয়নি। গণভবনে দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করা হলো। ১৫১ জন সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় যারা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছেন তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন তখন বিএনপি যে আচরণ করেছে এবং যে পথে গেছে তা যদি রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সংস্কৃতিতে গ্রহণযোগ্যতা পায় তাহলে যে কোনো বড় দল যখন দেখবে তারাও নির্বাচনে জিততে পারবে না অথবা সমঝোতা নয়, ক্ষমতাসীন সরকারের পতন হলেও তাদের জয় নিশ্চিত হবে, তখন যে দলই ক্ষমতার বাইরে থাকবে তারাও ওই একই পন্থা অবলম্বন করবে। অ্যানার্কি সৃষ্টি করা একটা বড় দলের জন্য কঠিন কিছু নয়। একটি ঘটনায় জড়িত দুই পক্ষকেই সমান বলা হলে তুলনামূলক ভালো-মন্দ এবং ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। ভালো-মন্দসহ সবকিছুই তুলনামূলক। এক তরফা নয়, ২০১৪ সালের পর ২০১৮ সালে আরেকটি নির্বাচন হয়েছে। সে সময়ে বিএনপি নেতৃত্বহীনতায় সংকট কাটাতে ড. কামাল হোসেনকে নেতা মেনে নির্বাচনে অংশ নেয়। এর মাধ্যমে বিএনপির আত্মবিশ্বাসের সংকটটি স্পষ্ট হয়ে যায়। লেখাটি শুরু করেছি ২০১৪ সালে নির্বাচনকালীন সার্বিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে। তারপর প্রায় ১০ বছর পার হয়ে গেছে। এ ১০ বছরে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটসহ বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতের মধ্যেও বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে। ২০১৪ ও বর্তমান সময়ের মধ্যে সামান্য কিছু তুলনার উল্লেখ করি। প্রথমত, ২০১৪ সালে সশরীরে ও সক্রিয়ভাবে বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। ২০২৩ সালে এসে তিনি একেবারে নীরব, নিশ্চুপ।

অসুস্থতার কারণে তিনি চলাচলও করতে পারছেন না। ২০২৩-২০২৪ এ সময়ে বিএনপি নেতৃত্বের সংকট কীভাবে কাটিয়ে উঠবে তার কোনো পথ এখনো দেখা যাচ্ছে না। ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব ছাড়া গণ আন্দোলন সফল হয় না। লন্ডনে বসে থাকা তারেক রহমানের নেতৃত্বে কাজ হবে না বলেই তো ২০১৮ সালে বিএনপি ড. কামাল হোসেনকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করে। দ্বিতীয়ত, ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও বিএনপি এখনো ২০১৪ সালের রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে বসে আছে। নতুন কিছু সামনে আনতে পারেনি, যার জন্য লেখার শুরুতেই তখন প্রকাশিত বাংলাদেশ প্রতিদিনের একটি শিরোনাম উল্লেখ করেছি। নিজেদের কী কী কৃতিত্বের দাবি বিএনপি করতে পারে, যার জন্য সাধারণ গণমানুষ তাদের আন্দোলনের পক্ষে সর্বাত্মক ও স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আসবে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা এককথা আর নিজেদের কৃতিত্ব ও জাতীয় অর্জন মানুষের কাছে তুলে ধরা ভিন্ন কথা। কোনো একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের নির্ভরযোগ্য তথ্য উল্লেখপূর্বক বিএনপি কি বলতে পারবে যেখানে আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে তাদের সরকারের পারফরম্যান্স ভালো ছিল। বিএনপির অবস্থানগত যে চিত্র তার বিপরীতে আওয়ামী লীগের অবস্থানগত চিত্রটির দিকে নজর দিলে তুলনামূলক অবস্থানটি বোঝা যাবে। প্রথমেই বলতে হবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা এখন বাংলাদেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ব অঙ্গনে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত, যার কিছু চিত্র সম্প্রতি শেষ হওয়া ব্রিকস ও জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের সময় দেখা গেছে। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালে জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে আওয়ামী লীগ সরকারের পারফরম্যান্স তেমন দৃশ্যমান ছিল না, সেখানে আজ যে কেউ বলবেন গত ১০ বছরে দেশের সব সেক্টরে বিশাল পরিবর্তন ঘটে গেছে। সব পেশা ও শ্রেণির মানুষের আর্থিক সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। একজন গৃহকর্মীর ঘরেও আজ ফ্রিজ ও রঙিন টেলিভিশন, হাতে স্মার্টফোন। গ্রামগঞ্জে এখন আর কাঁচাঘর দেখা যায় না। ঘর থেকে বের হলেই মানুষ গাড়িতে উঠতে পারে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পায়রা ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, কর্ণফুলী টানেল- এগুলো মানুষ দেখছে এবং সুবিধা পাচ্ছে।

সবকিছুরই নানা দিক নিয়ে ন্যায্য বা অন্যায্যভাবে সমালোচনা করা যায়। কিন্তু এত বিশাল বিশাল স্থাপনা চোখে ভাসার পরও যারা বলেন কিছুই হয়নি, তারা বরং মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। কৃষিতে বিপ্লব ঘটেছে। বিএনপির এক ক্ষমতাকালে সারের জন্য আন্দোলন করায় পুলিশের গুলিতে নিরীহ কৃষককে প্রাণ দিতে হয়। কিন্তু এখন সারের অভাবের কথা আর কেউ বলে না। বিদ্যুতের বেলায়ও একই রকম ঘটনা ঘটেছে। ২০০১-০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপির আমলে বিদ্যুতের জন্য আন্দোলনরত মানুষের ওপর গুলি চালানো হয়, আর এখন প্রতিটি মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ। পদ্মা সেতু প্রকল্পে যে বিশ্বব্যাংক অন্যায়ভাবে ঋণ প্রদান থেকে সরে যায় সেই বিশ্বব্যাংক ২০২৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দাওয়াত এবং ওয়াশিংটনে বোর্ড সভায় ভাষণ প্রদানের সুযোগ দিয়ে বিরল সম্মান দেখায়। বিশ্বখ্যাত গবেষণা সংস্থা দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকায় সহযোগী দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট তাদের সম্প্রতি এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে- বাংলাদেশ উন্নয়নের সঠিক ধারায় আছে এবং এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ২৮তম, ২০৩৫ সালে ২৫তম এবং ২০৪০ সালে বিশ্বের মধ্যে ২০তম অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ। এতসব কথার মানে এই নয় যে, আওয়ামী লীগ সরকার সব দোষত্রুটি ও অভিযোগের ঊর্ধ্বে। বিষয়টি সব সময়ই তুলনামূলক। এ কারণেই ২০১৪ আর ২০২৩ সালের মধ্যে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অবস্থানগত পরিবর্তনের চিত্রটি তুলে ধরলাম। তাতে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখলে যে কেউ বুঝবেন গত ১০ বছরে রাজনৈতিকভাবে বিএনপি আরও দুর্বল হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্জন গত ১০ বছরে যেমন অনেক বেশি দৃশ্যমান হয়েছে, তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং ২০১৪ সালে শুধু নয়, গত ১০ বছর ধরে বিএনপি যা পারেনি, সেই সরকার পতন তারা এই অক্টোবর অথবা আগামী দুই-চার মাসের মধ্যে ঘটিয়ে ফেলবে তার কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। শুধু দলীয় সমর্থকদের আন্দোলনে এ পর্যন্ত পৃথিবীতে কোথাও কোনো সরকারের পতন হয়নি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কাজ করলে দৈনিক কম করে হলেও দুই-আড়াই হাজার টাকা আয় করতে পারে।

এটা রেখে দলীয় এজেন্ডার রাজনৈতিক হাঙ্গামায় তারা কেন যাবে, তাতে তাদের কি স্বার্থ উদ্ধার হবে। নিজের ভালো-মন্দ বাংলাদেশের মানুষ এখন ভালোভাবে বোঝে। যৌথ পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশের ৫২ বছরে আন্দোলনের মুখে সরকারের পতন ঘটেছে মাত্র তিনবার। এর মধ্যে আইয়ুব খান ও এরশাদ দুজনই সামরিক শাসক ছিলেন এবং তখন দেশের সব বড় রাজনৈতিক দল একত্রে আন্দোলন করেছে। তৃতীয় পতনের ঘটনাটি ঘটে বিএনপি সরকারের ১৯৯৬ সালে। তখন সাধারণ মানুষ কাজকর্ম ফেলে এবং সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত ফেলে সবাই রাস্তায় নেমে এসেছিল। ১৯৯৬ থেকে ২০২৩, গত ২৭ বছরে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সবকিছুতেই ভূমিধস পরিবর্তন ঘটেছে। তাই ১৯৯৬ সালের ফর্মুলা ও কৌশলে ২০২৩ সালে কাজ হবে না। বিএনপি যদি বাস্তবতা মেনে নেয় তাহলে তারা রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে, দেশও হাঙ্গামা থেকে রক্ষা পাবে। রাজনৈতিকভাবে  ঝোড়ো হাওয়া বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। সুতরাং আকাশে কিছু কালো মেঘ দেখে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকে নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে সবাই অংশ নেবে এটাই প্রত্যাশা করি।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর