শিরোনাম
সোমবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভারতের রাজনীতিতে কি পরিবর্তন আসছে?

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

ভারতের রাজনীতিতে কি পরিবর্তন আসছে?

ভারতের পাঁচ অঙ্গরাজ্যে বিধানসভা ভোটের নির্ঘণ্ট প্রকাশ করল জাতীয় নির্বাচন কমিশন। এই পাঁচ রাজ্য হলো- রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা ও মিজোরাম। দিল্লির নির্বাচন সদনে সাংবাদিক বৈঠক করে ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা করেছেন দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার। রাজ্যগুলোর মধ্যে মিজোরাম বিধানসভার মেয়াদ শেষ হবে ১৭ ডিসেম্বর। বাকি রাজ্যগুলোতে বিধানসভার মেয়াদ শেষ হবে জানুয়ারিতে।

মধ্যপ্রদেশে এক দফায় ভোট হতে চলেছে ১৭ নভেম্বর। রাজস্থানের সবকটি বিধানসভায় ভোট হবে এক দফাতেই ২৩ নভেম্বরে। তেলেঙ্গানায় ভোট হবে ৩০ নভেম্বর। মিজোরামেও এক দফায় ভোট  হবে ৭ নভেম্বর এবং ১৭ নভেম্বর। সব রাজ্যের ভোটের ফল ঘোষণা হবে ৩ ডিসেম্বর। ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে ভোট প্রক্রিয়া। কংগ্রেস, বিজেপিসহ প্রতিটি দলই পাঁচ রাজ্যের এ ভোটকে লোকসভা নির্বাচনের আগে সেমিফাইনাল ধরে নিয়ে এগোচ্ছে। ভোটের ফল যা-ই হোক, তা লোকসভা ভোটের ফলকে প্রভাবিত করতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।

নির্বাচন কমিশনের তরফে জানানো হয়েছে, পাঁচ রাজ্যের মোট ৬৭৯টি বিধানসভা কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ হবে। এবার নতুন ভোটারের সংখ্যা ৬০ লাখ। মোট ভোটারের সংখ্যা ১৬.১ কোটি। কমিশনার জানিয়েছেন, পাঁচ রাজ্যেই নারী-পুরুষ লিঙ্গ অনুপাত ক্রমশ উন্নত হচ্ছে। পাঁচ রাজ্যের প্রতিটিতে কজন মহিলা প্রার্থী রয়েছেন, তা-ও উল্লেখ করা হয়েছে সাংবাদিক বৈঠকে। নির্বাচনি প্রস্তুতির অঙ্গ হিসেবে পাঁচটি রাজ্যে গিয়েই ভোট প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কমিশন। বেড়েছে ভোট কেন্দ্রের সংখ্যাও। মিজোরামের থাকছে ১,২৭৬টি ভোট কেন্দ্র। ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং তেলেঙ্গানায় ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা যথাক্রমে ২৪, ১০৯, ৬৪, ৫২৩, ৫১, ৭৫৬, ৩৫, ৩৫৬।

২০১৮ সালে ছত্তিশগড়ে দুই দফায় এবং বাকি চার রাজ্যে এক দফায় ভোট গ্রহণ হয়েছিল। ৯০ বিধানসভা আসনের ছত্তিশগড়ে প্রথম দফার মাওবাদী উপদ্রুত ১৮টি আসনে নির্বাচন হয়েছিল ১২ নভেম্বর। আর দ্বিতীয় দফার ৭২টি আসনে নির্বাচন হয়েছিল ২০ নভেম্বর। মধ্যপ্রদেশ এবং মিজোরামে একই দিনে ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করেছিল কমিশন। ২৩০টি আসনের মধ্যপ্রদেশ বিধানসভার ভোট হয়েছিল ২৮ নভেম্বর। ওই দিন ৪০ আসনের মিজোরামেও ভোট গ্রহণ হয়েছিল। ২০১৮ সালে ২০০ বিধানসভা আসনের রাজস্থান এবং ১১৯ আসনের তেলেঙ্গানার ভোট গ্রহণও হয়েছিল একই দিনে ৭ ডিসেম্বর। পাঁচ রাজ্যেই ভোটগণনা হয়েছিল। ২০১৮ সালে ২০০ বিধানসভা আসনের রাজস্থান এবং ১১৯ আসনের তেলেঙ্গানার ভোট গ্রহণ হয়েছিল একই দিনে ৭ ডিসেম্বর। পাঁচ রাজ্যেই ভোটগণনা হয়েছিল ১১ ডিসেম্বর। বর্তমানে ছত্তিশগড় এবং রাজস্থানে কংগ্রেস ক্ষমতায় রয়েছে। ওই দুই রাজ্যেই বিজেপির সঙ্গে তাদের সরাসরি লড়াই। ২০১৮-এর বিধানসভা ভোটে জিতে মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস ক্ষমতা দখল করলেও দেড় বছরের মাথাতেই জ্যোতিরাদিত্য শিন্ডের সাহায্যে দুই ডজন বিধায়ক ভাঙিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথের সরকারের পতন ঘটিয়েছিল বিজেপি। তেলেঙ্গানায় ক্ষমতায় রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের ভারত রাষ্ট্র সমিতি (বিআরএস)। সেখানে এবার ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে কংগ্রেস এবং বিজেপির ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা। অন্যদিকে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মিজোরামে মূল লড়াই ক্ষমতাসীন মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এমএলএফ) সঙ্গে কংগ্রেসের। ভারত ও বাংলাদেশে নির্বাচনি ঘণ্টা বেজে উঠেছে একই সময়ে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনার ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন ৩ অথবা ৪ জানুয়ারি নির্বাচন হতে পারে। বিস্তারিত নির্বাচনি নির্ঘণ্ট এখনো ঘোষণা করা হয়নি। ভারতের লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার আগেই সাংবিধানিক সংকট প্রকাশ্যে এসে গেছে। মোদি, অমিত শাহ এবং আরএসএস প্রধান ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের যে সাংবিধানিক কাঠামো আছে তা বদল করবেন। তার কারণ কী? এবার খুলেই বলা যাক। তিনজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের পদ্ধতি হলো প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত কমিটি তিনজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করবেন। ইতোমধ্যে লোকসভায় আইন পাস না করিয়ে এ কমিটি থেকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে বাদ দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। সঙ্গে সঙ্গে বিরোধীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন আর তারই প্রতিবাদে অধীর চৌধুরী বিবৃতি দিয়ে বলেছেন- আমি কমিটিতে আসব না। এটা কংগ্রেস ও ইন্ডিয়া জোটের সিদ্ধান্ত। বর্তমান লোকসভার মেয়াদ আগামী বছরের এপ্রিলে শেষ হবে। তার আগেই নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।

মোদি সরকার চাইছে প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের একজন মন্ত্রীকে আনতে। অথচ মোদি আরএসএস ও বিজেপি দল নির্বাচনি প্রচার শুরু করে দিয়েছে। যে পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হবে সেগুলো হলো হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা ও রাজস্থানে বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের মুখপাত্র হিসেবে রাহুল গান্ধী নির্বাচনি প্রচারণায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন এই পাঁচটি রাজ্যে কংগ্রেসই জিতবে। কারণ এখানে কোনো আঞ্চলিক দল নেই।

রাজস্থানে বর্তমানে কংগ্রেস সরকার ছত্তিশগড়েও তাই। বাকি তিনটি রাজ্যে পাঁচ বছর আগে বিপুল ভোটে কংগ্রেস জয়ী হয়েছিল। মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস সরকার গঠন করলেও বিজেপি কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিধায়ক কিনে নিয়ে কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং সরকার গঠন করে। একই কায়দায় কর্ণাটকে বিধায়ক কিনে নিয়ে সরকার গঠন করেছিল। কয়েক মাস আগে পুনর্নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপির ভরাডুবি ঘটিয়ে।

মধ্যপ্রদেশে বিজেপির অবস্থা খুবই করুণ। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে কমলনাথ যাকে বিজেপি ১৯ জন বিধায়ককে কিনে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল তিনি মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছেন পারলে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানিকে গ্রেফতার করুন, কারণ তিনি ৫০ শতাংশ ঘুষ চালু করে দিয়েছেন। মধ্যপ্রদেশসহ পাঁচ রাজ্যে এখন নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়নি। কিন্তু বিজেপি প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করতে শুরু করেছে। যদিও তাদের কোনো ইশতেহার নেই।

পশ্চিমবঙ্গে আরএসএসের কোনো শাখা সংগঠন ছিল না। কিন্তু আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবৈত সরাসরি স্বীকার করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির জন্য তারা প্রায় ১২০০ শিবির করতে পেরেছেন। প্রতিটি শিবিরে ১১০৪ থেকে ১২০০ অস্ত্রসহ স্বেচ্ছাসেবক আছে। তারা ঘুরে ঘুরে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারান্তে পশ্চিমবঙ্গজুড়ে সীমান্তঘেঁষা গ্রামগুলোতে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে। তার ফলে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। সেদিকে মমতার কোনো নজর নেই। তার একমাত্র লক্ষ্য কী করে ক্ষমতায় টিকে থাকবেন এবং পরিবারের লোকদের তদন্তের মুখোমুখি যাতে হতে না হয় তা দেখা। বিশেষ করে তার ভ্রাতুষ্পুুত্র অভিষেক ব্যানার্জি যার নামে কয়লা, বালিগঞ্জ নিয়োগ দুর্নীতিসহ প্রায় ৮-১০টি বড় মামলা আছে যিনি প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার মালিক তাকে বাঁচাতে মমতা আরএসএস এবং বিজেপির শরণাপন্ন হয়েছেন।

সম্প্রতি ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের প্রাক্তন রাজ্যপাল বিজেপি নেতা তথাগত রায় জানিয়েছেন, বিজেপি ও তৃণমূলের এলাকায় তলায় তলায় সেটিং আছে। এ বিষয়ে তিনি সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন দাদা ও দিদিকে। দিল্লি থেকে প্রচার করা সর্বভারতীয় চ্যানেলের টকশোতে দেশের বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ এবং দেশের বর্তমান অবস্থা যারা ওয়াকিবহাল তারাও এই সেটিংয়ের কথা বলছেন। একদিকে তারা কট্টর হিন্দুত্ববাদী অন্যদিকে তারা জামায়াতকেও সমর্থন করছেন, যেটা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের পক্ষে একটা বিরাট অশোভন সংকেত। তাদের বক্তব্য সাধারণ মানুষের মতোই।

১০ বছর আগে ২০১৪ সালে মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বছরে ২ কোটি চাকরি হবে। সে হিসাবে ২০ কোটি তো দূরের কথা ২০ হাজার চাকরিও হয়নি। অথচ নিজের প্রচারের জন্য তিনি বিদেশি নেতাদের সঙ্গে আলিঙ্গন করেন। বিশেষজ্ঞদের একশ্রেণির লোক টিভির টকশোতে বলছেন, স্বামীজিকে উদ্ধৃত করে চালাকি দ্বারা মহৎ কার্য হয় না। অথচ মোদি ও মমতা ১৪০ কোটি লোককে ধাপ্পাবাজি দিচ্ছেন। বিভিন্ন টকশোতে বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ মানুষও বলছেন, পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন সেমিফাইনাল আর ’২৪-এর লোকসভা নির্বাচন ফাইনাল। দেশবাসী এখন সেদিকেই তাকিয়ে। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী প্রায় সাড়ে ৯ মাস ৩৫০০ কিলোমিটার যে নেতা জনসংযোগ যাত্রা করে সাধারণ মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছেন-সেই রাহুল গান্ধীর দেখাদেখি বিজেপির আঞ্চলিক নেতারাও ভাবছেন এরকম পদযাত্রা করবেন। কিন্তু তারা কোথায় করবেন, কখন করবেন কেউ জানেন না। রাহুল গান্ধীর এই পদযাত্রার ফলেই কর্ণাটক ও হিমাচল প্রদেশে বিপুল জয় সম্ভব হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। তাদের মতে, ভারতের রাজনীতিতে পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠছে।

লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর