মঙ্গলবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

কবে অপবিত্র হানাদারদের পাক বাহিনী বলা বন্ধ হবে

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

কবে অপবিত্র হানাদারদের পাক বাহিনী বলা বন্ধ হবে

কেন যেন অক্টোবর মাসটা বেশ ব্যস্ততায় কাটছে। ৬ তারিখ গিয়েছিলাম দেবিদ্বারে ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহার বাড়িতে। মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলায় একেবারে নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও ২৪ বছর জেল খেটেছে। যার চাল-চুলা কিছুই নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে বলেছিলাম, বেশ কিছু টাকা দিয়েছিলেন, আমিও দিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয় আমার অনুরোধে একটি বীরনিবাস বরাদ্দ দিয়েছে। সেখান থেকে ৭ তারিখ টাঙ্গাইল, ৮ তারিখ রাতে ময়মনসিংহ সার্কিট হাউসে। স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই ময়মনসিংহ সার্কিট হাউসের সঙ্গে আমার পরিচয়। ১৯৫৭-৫৮ সাল থেকে কতবার ময়মনসিংহ সার্কিট হাউসে মাঠে গিয়েছি, খেলাধুলা করেছি। আমার নানা খন্দকার আবদুল ওয়াহেদ কালু মিয়া ব্রিটিশ ভারতে কলকাতার মোহনবাগানের একসময় ক্যাপ্টেন ছিলেন, গোলরক্ষক ছিলেন। পদানত ব্রিটিশ ভারতে একমাত্র মোহনবাগান ফুটবল দল ব্রিটিশদের পরাজিত করেছিল। সেজন্য মোহনবাগানের সম্মান-মর্যাদা ছিল ভারতজোড়া। কলকাতায় যখন মোহনবাগান-ইস্ট বেঙ্গল খেলা হতো তখন বাড়িতে বাড়িতে ঘরে ঘরে স্বামী-স্ত্রীতে দ্বন্দ্ব বেধে যেত। একদল ইস্ট বেঙ্গল, অন্যদল মোহনবাগান। টাঙ্গাইলের সন্তোষের মহারাজা ইস্ট বেঙ্গল দলের গোড়াপত্তন করেছিলেন। এখনো পশ্চিমবঙ্গে ইস্ট বেঙ্গল-মোহনবাগান দুই ভাগ। মোহনবাগান ঘটি, ইস্ট বেঙ্গল বাঙাল। এ লড়াই বহুদিনের। কিন্তু কোনো রক্তক্ষয়ী নয়, জীবনহানিকর নয়। উত্তেজনাকর এক প্রতিযোগিতা। ১৯৬৩-৬৪ সালের একদিনের কথা আমার এখনো মনে পড়ে। বানিয়ারার নানা খন্দকার আবদুল ওয়াহেদ কালু মিয়া বেশ বয়সী মানুষ। ৬৫-এর ওপর বয়স তাঁর। তিনি ছেলেমেয়েদের শারীরিক প্রশিক্ষণ দিতেন। টাঙ্গাইল থাকলে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ গেলে ময়মনসিংহে। সার্কিট হাউস মাঠে ফুটবল প্রশিক্ষণ হচ্ছিল। ময়মনসিংহ সার্কিট হাউসের মাঠে একসঙ্গে চার-পাঁচটি ফুটবল দল খেলতে পারে। নানা জায়গায় গোলবার সাজিয়ে তখনো যেমন হতো, এখনো হয়। তবে ময়মনসিংহ সার্কিট হাউস মাঠের যে ঐতিহ্য তাতে সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখলেও কম সম্মান দেখানো হয়। কিন্তু সেই সার্কিট হাউস থেকে ৯ তারিখ সকালে বেরিয়ে আসার সময় দেখলাম বড় অবহেলিত অপরিষ্কার, নানা স্থানে কাদাপানি জমা। যেহেতু আগের রাতে গিয়েছিলাম। দোতলায় নতুন ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা করেছিল। শত বছরের বেশি পুরনো ময়মনসিংহ সার্কিট হাউস সব সময় ছিল এক তলা। এই সেদিন দোতলা করা হয়েছে। তাও কটি ঘর করা হয়েছে জানি না। ময়মনসিংহের নতুন ডিভিশনাল কমিশনার উম্মে সালমা তানজিয়া সে ঘরে ছিলেন। যেহেতু ময়মনসিংহ নতুন বিভাগ হয়েছে সেহেতু বিভাগীয় কমিশনারের কোনো বাড়িঘর ছিল না। তবে জেলা প্রশাসকের ২০০ বছর বা তারও আগে থেকে পুরনো ধরনের চমৎকার খোলামেলা বাড়ি রয়েছে। বর্তমান জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাফিজার রহমানকে বেশ ভালো লেগেছে। বেশ খোলামেলা মানুষ। দিনে দিনে কত সময় পার হয়ে গেছে ভাবতেই পারিনি। আমার এক প্রখ্যাত যোদ্ধা কালিয়াকৈরের পাকুরিয়াচালার আবুল কালাম আজাদ বাদল মরিচায় নবী নেওয়াজের কোম্পানিতে কোয়ার্টার মাস্টারের দায়িত্বে ছিল। কোম্পানি কমান্ডার ছিল নবী নেওয়াজ, কোম্পানি চলত বাদলের কথায়, বাদলের নির্দেশে। এর জন্য বাদলকে শাসন এবং কোম্পানি কমান্ডার নবী নেওয়াজকে কঠোরভাবে তিরস্কার করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। পরে দেখেছি, বাদল ছাড়া নবী নেওয়াজের কোম্পানি অন্ধ, পঙ্গু, অচল। সেই প্রিয় বাদলের ছেলে মাসুম। যে বাদলকে আমরা বিয়ে করিয়েছিলাম, মাসুমকে কোলে নিয়েছি। সে এখন একসময়ের ব্রিটিশ ভারতের সব থেকে বড় জেলা ময়মনসিংহের এডিসি (শিক্ষা)। মাসুমই তার বাবার একটা লেখা ‘একটি স্বাধীন বাংলাদেশ : আমার রণাঙ্গনের দিনগুলো... এবং বারুদঘ্রাণের অভ্যর্থনা’ খসড়া দিয়েছিল। লেখাটি আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয়, চমৎকার লেগেছে। বাদলের লেখায় তৎসময়ের দেশের অবস্থা, রাজনৈতিক পরিমন্ডল, লোকজনের মনমানসিকতা সবই চমৎকার ফুটে উঠেছে। তবে বাদলের মতো একজন রাজনীতিসচেতন বীর মুক্তিযোদ্ধার কলমে ‘পাক বাহিনী’ এলে দুঃখ রাখার জায়গা থাকে না। পাকিস্তান হানাদাররা কত কোটি কোটি বাঙালিকে নির্যাতন করেছে, মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রম নষ্ট করেছে, লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। তার পরও যদি ‘পাক’ হয় তাহলে আল্লাহ-রসুলের কী হবে, কোরআন-হাদিসের কী হবে, কী হবে মক্কা-মদিনা-মসজিদ-মন্দিরের? পাকিস্তান পাক- সে ধরনের পাক কি আল্লাহ-রসুল হতে পারেন? মক্কা-মদিনা-মসজিদ-মন্দির হতে পারে? পাক তো পবিত্র। আর পাকিস্তানি হানাদাররা তো অপবিত্র। বাদলের বইয়ের মুখবন্ধ লিখতে গিয়ে এসব লিখেছি। তার পরও পাক আর নাপাক নিয়ে আমাদের দেশে কত মানুষ হানাদারদের, পাকিস্তানি জল্লাদদের পাক বলে অভিহিত করে, পাক বাহিনী বলে অভিহিত করে তার সীমা-পরিসীমা নাই। ময়মনসিংহ থেকে অনেক রাতে এসেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের প্রবাদপুরুষ শাহ সুফি সামান উল্যাহর মাজারে। সে এক বিস্ময়কর মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। খমক হাতে গান গেয়ে বেড়াতেন। মুক্তিযোদ্ধারা যেখানেই পরাজিত হয়েছে সেখানেই ছুটে গিয়েছেন। গেয়েছেন ‘মারো লাথি ভাঙো ছাতি আছে যত রাজাকর। তোরা সব জয়ধ্বনি কর, তোরা সব জয়ধ্বনি কর’। যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল আমার সামনে এসেই গেয়ে উঠেছিলেন, ‘হার গিলারে কেরা দিল মাদবরি? সেই দুঃখে যে আমি মরি। কত খাটাস বাবু দারোগা, শৃগাল পন্ডিত দফাদার। হার গিলারে কেরা দিল মাদবরি? সেই দুঃখে যে আমি মরি।’ এরপর তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। আমি আমার জীবনে ওরকম জ্ঞানের ভান্ডার দ্বিতীয় কাউকে পাইনি। স্বাধীনতার পর থেকে আমি যখনই কোরআন-হাদিস পড়েছি, এখনো পড়ি তখনই আমার কাছে সবই কেমন যেন জানা জানা মনে হয় কারণ সামান ফকিরের কল্যাণে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সামান ফকিরের টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এবং ঢাকায় বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ৬০-৬২ দিন আগে সামান ফকির বঙ্গবন্ধুকে দেখতে চাওয়ায় নিয়ে গিয়েছিলাম বর্তমান গণভবনে। বঙ্গবন্ধু থেকে ৪-৫ ফুট দূরে বসেছিলেন সামান ফকির। সাত-আট জন মন্ত্রী, দু-তিন জন সচিবসহ আমিও ছিলাম। সামান ফকির বারবার বলেছিলেন, ‘বঙ্গপীর বঙ্গপীর, বঙ্গবন্ধু কো? তারে তো দেখি না।’ বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে উঠে এসে সামান ফকিরকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘এই যে আমি আপনাকে ধরে আছি।’ সামান ফকির মাঝে মাঝে খুব খেঁচিয়ে উঠতেন, ঝাড়ি মারতেন। তেমনি বলেছিলেন, ‘আমি তো বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পাই না। না দেখে মিথ্যা বলব আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখতাছি?’ তাঁর কথায় সবাই হেসেছিলেন। আমিও হেসেছিলাম কি না বলতে পারব না। তবে তাঁকে বাড়ি নিয়ে আসার সময় বারবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সব জায়গায় পাগলামি করা কি ভালো? বঙ্গবন্ধু আপনাকে জড়িয়ে রাখল কত করে বলল। তার পরও আপনি তাঁকে দেখতে পেলেন না! ছোট্ট বাচ্চারা কোনো অপরাধ করলে যেমন একেবারে কেমন হয়ে যায় ঠিক তেমনি অপরাধীর মতো আমাকে বলেছিলেন, ‘বঙ্গপীর কী করব, আমি তো বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পেলাম না।’ কি কপাল আমাদের। তার ৬০-৬২ দিন পর বঙ্গবন্ধু আমাদের সবাইকে এতিম করে চলে যান। আমার আরাধ্য সামান ফকির যদি তাঁকে তাঁর রুহানি চোখে ৬০-৬২ দিন আগে থেকেই দেখতে না পান সেটা কি তাঁর দোষ, নাকি কোনো অপরাধ? সেই সামান ফকিরের ২৮ বা ২৯তম মৃত্যুদিনে তক্তারচালা তাঁর মাজারে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে অনেক রাতে ঢাকা ফিরেছি। সকালেই ছিল পদ্মা সেতুতে রেল চলাচল উদ্বোধন। গিয়েছিলাম। মোহাম্মদপুর থেকে হানিফ উড়ালসড়কে পৌঁছাতে দেড় ঘণ্টা লেগেছিল। সেখান থেকে ৩০ মিনিট অনুষ্ঠানস্থল। ১০টায় পৌঁছার কথা, সাড়ে ১০টায় পৌঁছেছিলাম। হায়রে সোনার ব্যবস্থা। রাষ্ট্রীয় অনেক অনুষ্ঠানে অব্যবস্থা দেখি। কারও কোনো মর্যাদা নেই। সিনিয়র-জুনিয়র কোনো মন্ত্রীর নেই। সাবেকরা তো একেবারে খরচের খাতায়। অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে দেখলাম কয়েক মন্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন, জায়গা পাচ্ছেন না। ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। সব সময় ‘লিডার লিডার’ সম্বোধন করে। কেন যেন প্রায় সময়ই তার সঙ্গে দেখা হয়। সেদিনও হয়েছে। এসএসএফের লোকজন সেদিন মাননীয় মন্ত্রী এবং ডেপুটি স্পিকারের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে দেখে অবাক না হয়ে পারিনি। অনেক জায়গায়ই ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুকে ডানে-বাঁয়ে পাই অথবা আমিই তার ডানে-বাঁয়ে বসি। সেদিনও ডানে বসেছিলেন, বাঁয়ে সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, তারপর কৃষিমন্ত্রী আমাদের প্রিয় ড. আবদুর রাজ্জাক, তারপর শেখ শহীদ। ইনাম আহমেদ চৌধুরী আসন পাচ্ছিলেন না দেখে আমার বড় অবাক লাগছিল। ডেপুটি স্পিকারের ডান পাশে এসএসএফ-প্রধান মুজিবর রহমান, সেনাপ্রধান ও আরও কার যেন আসন রাখা হয়েছিল। সে আসন রক্ষার জন্য এসএসএফ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীর যে তাগিদ আমন্ত্রিতদের বসবার জন্য, দেখাশোনা করার জন্য তার বিন্দুবিসর্গও ছিল না। উদ্বোধনী আলোচনা শুরু হলে রেল সচিব তার শুভেচ্ছা বক্তব্য দিতে ওঠেন। বক্তৃতার একপর্যায়ে তিনিও পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণের কথা বলতে গিয়ে পাক বাহিনী বলেছিলেন। বিরক্তি এবং ক্ষোভে আমার অন্তরাত্মা ফেটে পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু কী করব, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠলেও পাকিস্তানিদের রেখে যাওয়া প্রেতাত্মাদের সঙ্গে পেরে উঠছি না। কিন্তু কী করব, উপায় নেই। বহুদিন পর বোন রেহানাকে সামনাসামনি দেখলাম। ওর নাতিপুতিরা সঙ্গে ছিল। রেহানার জন্মদিন ১৩ সেপ্টেম্বর ববিকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছিলাম। এই প্রথম ওকে পাইনি। তাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে পারিনি। আজ থেকে ১২-১৩ বছর আগে একদিন ১৫ আগস্ট লন্ডন থেকে ফোন করেছিল, ‘ভাই আপনি কি ৩২-এর বাড়িতে গিয়েছিলেন?’ বলেছিলাম, না তো রে। ‘আপনি এক্ষুনি যান। ও বাড়ি কি শুধু আমাদের দুই বোনের? আপনার না? আপনিই তো আমাদের ভাই, আমার বাবার ছেলে। আমরা তো রক্তের, আপনি তো রাজনৈতিক সন্তান।’ আরেকদিন বলেছিল, ‘ভাই পানি কাটলে কি ভাগ হয়? রক্ত তো তারও চাইতে ভারী। আমরা আপনাকে আপন ভাবি। আপনি আমাদের ছাড়বেন কী করে?’ তারও পরের কথা রেহানার দুই মেয়ে, এক ছেলে। অবন্তি সব থেকে ছোট। ওকে ভালোও বাসে বেশি। রাত ১১টার দিকে রেহানার ফোন, ‘ভাই, আবার মামা হলেন। আপনার আরেক ভাগনি হলো। জানেন তো, দুইটা মা একত্র করলে তবেই মামা। মামা হওয়া সহজ নয়।’ ওর এসব কথা আমাকে ভীষণ আলোড়িত করে। আজ থেকে বছর দশেক আগে জেটএয়ারে দিল্লি থেকে ফিরছিলাম। হঠাৎই দেখি রেহানা। প্লেন আকাশে ওড়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে ববি এসে হাজির, ‘মামা, মা পাঠিয়ে দিল। বলল যা তো দেখে আয় মামা ভাইগ্না চিনে কি না।’ জানি সময়ের অদলবদলে, জোয়ারভাটায় অনেক কিছু বদলে যায়। কিন্তু কেন যেন আমি বদলাতে পারলাম না। বাবা আমাকে কত মারতেন। কিন্তু খেতে বসে যখন মাছের মাথাটা আমার পাতে তুলে দিতেন তখন হৃদয় জুড়িয়ে যেত। বাবার হাত ধরে যখন গ্রামের হাটে যেতাম আমাকে সম্রাট আকবরের চাইতেও বড় মনে হতো। আমার পিতার মতো বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী পড়াতে বসিয়ে কত মারতেন। রাজনৈতিক জীবনে কত গালাগাল করতেন। কিন্তু কেন যেন আমার সমস্ত অন্তরাত্মা হৃদয়জুড়ে লতিফ সিদ্দিকী। অমনি রেহানা-হাসিনাও। সন্তানের মতো আমার বোন। রেহানাকে আমি সেভাবেই দেখি, ভালোবাসি, স্নেহ করি, কল্যাণ কামনা করি। আমার বড় বোনের অভাব ছিল। নিঃস্ব রিক্ত অবস্থায় সেটাও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন হাসিনা পুরো করেছেন। আমার মধ্যে তেমন খুব একটা বেশি অপূর্ণতা কাজ করে না। কিন্তু দেশের অবস্থা দেখে দেশের মানুষের দুর্দশা দেখে বড় অস্বস্তিবোধ করি। একটি বিরোধী দল বিএনপি পশ্চিমা শক্তিনির্ভর হয়ে কত কথা বলছে। তাদের বিবেচনায় একবারও আসে না এই আমেরিকা আমাদের স্বাধীনতা চায়নি, আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তারা সর্বতোভাবে কাজ করেছে, পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে। এমনকি সপ্তম নৌবহর পর্যন্ত পাঠিয়েছিল। আমেরিকাকে পরাজিত করেই আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। সেই বাংলাদেশে আমেরিকার দয়াদাক্ষিণ্য করুণা দেশের মানুষ ভালোভাবে নেবে না। আমরা একটা অবাধ সরকারি প্রভাবমুক্ত সুষ্ঠু সুন্দর ভোটারদের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। আর এই নির্বাচনের জন্য কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ আমাদের গামছার দল প্রয়োজনে ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। আমেরিকার প্রভাব বিএনপির পক্ষে গেলে ভালো, আওয়ামী লীগের পক্ষে গেলে খারাপ। এ তো হতে পারে না। ভালো সবার পক্ষে ভালো, খারাপ সবার পক্ষে খারাপ।

এই যে আজ কদিন ইসরায়েল প্যালেস্টাইনের ওপর অন্যায় আক্রমণ করেছে। সেই অন্যায়কারীর পক্ষে দাঁড়িয়েছে আমেরিকা ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তি। আমার মুসলিম ভাইদের যারা গৃহহীন করছে, মানবতা যারা পদদলিত করছে তাদের পক্ষে আর যা কিছু হোক বাংলার মানুষ যাবে না। বাংলার ভোটার জল্লাদ আমেরিকার দালালদের আর যা কিছু হোক ভোট দেবে না। ভেবে দেখতে হবে, আমরা আজ প্রস্তর যুগে নই, অন্ধ যুগে নই। আমরা আধুনিক যুগের বাসিন্দা। আমেরিকার কত শত মানুষ ইসরায়েলের এই বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে। সারা বিশ্বের ঘরে ঘরে আজ নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে, ইয়াসির আরাফাতের দেশের পক্ষে সোচ্চার আন্দোলন করছে এটা কি বাংলার মানুষের চোখে পড়ছে না? নিশ্চয় পড়ছে। তাই অবশ্যই বলব, বিদেশি শক্তির কাছে ধরনা দিয়ে আর যা কিছুই হোক বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণের এবং ভোটারের সমর্থন পাওয়া যাবে না।

লেখা যখন শুরু করেছিলাম, তখন হঠাৎই খবর পেলাম সখিপুরের ফজলুর মা আর ইহজগতে নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। জন্ম-মৃত্যু চিরসত্য। জন্মিলে মরিতে হইবে। মৃত্যুর স্বাদ সব প্রাণকে গ্রহণ করতে হবে। হাদিস-কোরআনে কোনো কোনো জায়গায় আমি এও দেখেছি, কারও মৃত্যুতে দুঃখিত হওয়াটা, ব্যথিত হওয়াটা খুব বেশি ভালো না। মৃত্যু আল্লাহর ইচ্ছাপূরণ। ফজলুর বাবা শরাফ উদ্দীন হাজি সত্যিই এক অসাধারণ মানুষ। কয়েক বছর আগে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন। আমার বাসায় ছিলেন। বৈঠকখানায় বসে কথা হচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অধিকাংশ মানুষ আমাকে স্যার বলে সম্বোধন করে। ফজলুর বাবাও করেন। হঠাৎই বলে বসলেন, ‘স্যার দুনিয়ায় যা খারাপ মদ-ভাং-গাঁজা-নর্তকী সবই না যারা বেহেশতে যাবে তাদের জন্য মহান আল্লাহ বরাদ্দ করে রেখেছেন। দুনিয়ায় ভাং-গাঁজা-মদ বেহেশতের শরাবান তাহুরা হুরপরী সেবাদাসী এটা কী নিয়ম? দুনিয়ায় যা খারাপ আল্লাহর পবিত্র বেহেশতে সে সবেরই না চল!’ আমি উত্তর দিইনি বা দিতে পারিনি।

তবে এটাই সত্য। আল্লাহর বেহেশত অন্য জিনিস। সেখানে পাপের কোনো কারবার নেই। সেই জনাব শরাফ উদ্দীন হাজির স্ত্রী ফজলুর মা হঠাৎই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমারও এক পরম সৌভাগ্য গত ১০-১৫ বছর ওদের বাড়িতে খেতে যেতে অনুরোধ করছিল। কিন্তু খাওয়া হয়নি। গজারিয়ার কীর্তনখোলায় কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সম্মেলনের দিন ওদের বাড়িতে খেতে গিয়েছিলাম। ফজলুর মাকে আমার স্ত্রীর দেওয়া শাড়ি দিয়ে এসেছিলাম। তিনি আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। সব ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন। পরম করুণাময় আল্লাহ তাঁর পরিবার-পরিজনকে এই শোক সইবার শক্তি দিন এবং তাঁকে বেহেশতবাসী করুন।

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর