বুধবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

মায়াভরা শেখ রাসেল

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

মায়াভরা শেখ রাসেল

শেখ রাসেল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ সন্তান। ১৮ অক্টোবর, ১৯৬৪ সালে তার জন্ম। বার্ট্রান্ড রাসেল ছিলেন সেই সময়ের দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম, যিনি বিশ্বশান্তির পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর এ শ্রদ্ধার প্রতিফলন ঘটে নিজের ছেলে রাসেলের ক্ষেত্রে। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রিয় লেখক খ্যাতিমান দার্শনিক ও নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে পরিবারের নতুন সদস্যের নাম রাখেন ‘রাসেল’। শেখ রাসেল একটি নিষ্পাপ শিশু, পবিত্র ফুলের মতো। সবার আদরের ছিল সে। পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাকে আদর করতেন, মায়ের আদর ছিল, ভাইবোনেরাও তাকে ভীষণ আদর করতেন, ভালোবাসতেন। রাসেল ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল, ভাইবোনদের মধ্যে সে-ই ছিল সবার নজর কাড়ার, আদর নেওয়া আর পাওয়ার, খেলনার পুতুলের মতো, যেন সারাক্ষণই তাকে বড় ভাইবোনেরা আদর করত, টানাটানি করত। দেখতেও ছিল দারুণ ফুটফুটে, যেন বাগানের সদ্যপ্রস্ফুটিত একটা গোলাপ ফুল। ঢাকা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে শেখ রাসেলের শিক্ষাজীবন শুরু হয় চার বছর বয়সে। প্রথম কিছুদিন পরিবারের কাউকে না কাউকে রাসেলকে স্কুলে দিয়ে আসতে হতো। ধীরে ধীরে সে নিজেই স্কুলের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। পরে স্কুলে যাওয়ার জন্য সে ব্যাকুল হতো আর ধীরে ধীরে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে উঠত। খুব অল্প সময়েই স্কুলে রাসেলের অনেক বন্ধু জুটে যায়। মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার এবং খুব বন্ধুবৎসল ছিল সে। তার সেই সময়ের অনেক বন্ধুবান্ধব স্মৃতিচারণা করে বলেছেন, একেবারেই নিরহংকার, নির্বিবাদী ছিল রাসেল। তাকে যে কেউ হত্যা করতে পারে, মেরে ফেলতে পারে এ কথা আমরা কেউ চিন্তাই করতে পারি না। স্কুলের শিক্ষকরাও তাকে খুব ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন। গৃহশিক্ষিকা গীতালি চক্রবর্তীর ভীষণ আদরের ছিল শেখ রাসেল। সবাইকে সে মাতিয়ে রাখত আর নিজে মেতে থাকত। সহপাঠীরাও তার সঙ্গে খেলত, আনন্দ করত। সবার আদরের নিষ্পাপ, নির্মল শিশু শেখ রাসেলের প্রাণ গেল ঘাতকের নির্মম আঘাতে। ঘাতকের হাত একবারও কাঁপল না। ওই নিষ্ঠুর পাষণ্ডগুলো আল্লাহকেও ভয় পেল না। কী অপরাধ ছিল রাসেলের? কেন তাকে জীবন দিতে হলো? সে তো রাজনীতি করেনি, রাজনীতি বোঝেওনি। বোঝার মতো বয়সও তার ছিল না। কিশোর অপরাধীও ছিল না। একটা প্রাণচঞ্চল ফুটফুটে ১০ বছর বয়সের নিষ্পাপ শিশু। তার তখন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে খেলার বয়স। ছোট্ট নিষ্পাপ এই শিশুটিকে হত্যা করতে খুনিদের কি হাতগুলো একটুও কাঁপেনি? তাদের বুক থরথর করেনি? খুনিদের কি সন্তান ছিল না? বা তাদের স্বজনদের শিশু সন্তান ছিল না? ভাবতে অবাক লাগে সেই নিরপরাধ-নিষ্পাপ শিশুদের মুখ একবারও কি এই খুনিদের মনে ভেসে ওঠেনি? কি নির্দয় নিষ্ঠুর সেই খুনিরা। যুদ্ধ ক্ষেত্রেও মানবিক নীতি অনুসারে নিরপরাধ নারী ও শিশুকে হত্যা করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এটা জেনেও খুনিরা নিষ্পাপ রাসেলকে কী করে খুন করতে সাহস পেল?

মানবতাবিরোধী মানবতাহীন কিছু পশু তাকেসহ বঙ্গবন্ধুর গোটা পরিবারকে হত্যা করেছিল সেদিন। ভাগ্যক্রমে বিদেশে অবস্থান করায় দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান; যা ছিল মানব ইতিহাসে এক ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ। এ হত্যাকাণ্ড কারবালার নিষ্ঠুর, নির্মম, হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডকেও হার মানায়। সভ্য জগতে এমনটি করতে পারে কেউ? কোথাও কি আর ঘটেছে এমন হত্যাকাণ্ড; যেখানে নারী-শিশুকেও রেহাই দেয়নি ঘাতকরা?

হত্যাকারীদের কাছে রাসেলের আকুতি ছিল মায়ের কাছে যাওয়ার। কী আচরণ করেছিল ঘাতকরা তার সঙ্গে? ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে যখন একদল বিপথগামী, বিশ্বাসঘাতক তরুণ সেনা কর্মকর্তা ট্যাংক নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবন ঘিরে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে; আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিল, ‘আমি মায়ের কাছে যাব’। পরবর্তী সময়ে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিল, ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দাও’। ব্যক্তিগত কর্মচারী এ এফ এম মহিতুল ইসলামের ভাষ্যমতে, ‘রাসেল দৌড়ে এসে আমাকে জাপটে ধরে। আমাকে বলল, “ভাইয়া আমাকে মারবে না তো?” ওর সে কণ্ঠ শুনে আমার চোখ ফেটে পানি এসেছিল। এক ঘাতক এসে আমাকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে ভীষণ মারল। মারতে দেখে রাসেল আমাকে ছেড়ে দিল। সে কান্নাকাটি করছিল আর বারবার আকুতি জানাচ্ছিল “আমি মায়ের কাছে যাব, আমি মায়ের কাছে যাব।” এক ঘাতক এসে তাকে বলল, “চল, তোর মায়ের কাছে নিয়ে যাই।” বিশ্বাস করতে পারিনি যে ঘাতকরা এত নির্মমভাবে ছোট্ট সেই শিশুটাকেও হত্যা করবে। রাসেলকে ভিতরে নিয়ে গেল এবং তারপর ব্রাশফায়ার।’ ১০ বছর বয়সী শিশুটির জীবনপ্রদীপ ঘাতকরা নির্মমভাবে নিভিয়ে দেয় চিরদিনের জন্য। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবচেয়ে আদরের ফুটফুটে সম্ভাবনাময় শিশু রাসেল, যার নামের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের এক মহান দার্শনিকের নাম যুক্ত ছিল। রাসেল বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে আরেক বিস্ময়কর বঙ্গবন্ধুর মতো প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠত, দেশে ও বিদেশে বার্ট্রান্ড রাসেলের মতোই অমর হয়ে থাকার ভূমিকা পালন করত। রাসেল বেঁচে থাকলে হয়তো বা শামিল হতো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণে। এমনকি হয়ে উঠতে পারত আর এক বঙ্গবন্ধু। বাংলার মানুষ পেত মহান ব্যক্তিত্বশালী, মহান হৃদয়ের অধিকারী আরও এক নেতা। প্রাণসঞ্চারী একটা শিশু, যে দেশ ও জাতির জন্য বড় সম্পদ হতে পারত, আর দেশকে দিতে পারত নেতৃত্ব। শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে একটি আদর্শ ও ভালোবাসার নাম। অবহেলিত, পশ্চাৎপদ, অধিকারবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের আলোকিত জীবন গড়ার প্রতীক। শেখ রাসেল অমর। সব শিশুর অনুপ্রেরণা, বেঁচে থাকবে শিশুদের মধ্যেই। দুরন্ত, দুর্বার শিশু শেখ রাসেল বাস করুক সব শিশুর অন্তরে।

লেখক : প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর