বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

‘ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল’ এখন বেহাল

আলম রায়হান

‘ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল’ এখন বেহাল

এক সময় বলা হতো- ‘ধান-নদী-খাল, এই তিনে বরিশাল।’ এবং বাস্তবতাও ছিল তাই। কিন্তু এখন তা কেবলই অতীত। বাস্তবে বিরাজমান হতাশা ও আশঙ্কার দৃশ্যপট। এ দশা রাতারাতি হয়নি। হয়েছে ক্রমান্বয়ে। অনেকেই মনে করেন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিডি)-এর অপরিকল্পিত সেতু-কালভার্ট নির্মাণ, বাস্তবতা উপেক্ষা করে বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)-এর কর্মকাণ্ড এবং সেচের বিষয়ে কাঠের চশমা পরে কেবল নদীভাঙন নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গলদঘর্ম হওয়ার প্রবণতা। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মেধা সংকটই মূলত দেশের পানির সর্বনাশের জন্য মূল দায়ী। সঙ্গে মানুষের অগ্রণযোগ্য প্রবণতা তো আছেই, মগজে ক্যান্সারাস টিউমারের মতো। এ অবস্থায় বিলম্বে হলেও দেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি কথাটি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ১৬ অক্টোবর। তিনি বলেছেন, ‘শুধু পাড় বাঁধলেই হবে না। নদীর ড্রেজিংও করতে হবে।’ নদীদূষণ বন্ধে নৌপথ ভ্রমণে চিপসের প্যাকেট না ফেলার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী। বলা বাহুল্য প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তার উল্টোটাই দেশে চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। ফলশ্রুতিতে পানি সংকট দ্রুততর হওয়ার পাশাপাশি সারা দেশে সেচ সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব অনেকখানি গ্রাস করেছে দক্ষিণ অঞ্চলের কৃষিকে। এর সঙ্গে অবশ্য যুক্ত হয়েছে, কৃষির ব্যাপারে এ অঞ্চলের মানুষের জেঁকে বসা অলস প্রবণতা। ফলশ্রুতিতে দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ চালের জন্য নির্ভরশীল উত্তর অঞ্চলের ওপর। যেখানের ভূগর্ভস্থ পানির ওপর কৃষি নির্ভরশীল। কারণ সেখানে ভূউপরিস্থ পানির দুষ্প্রাপ্যতা রয়েছে। এদিকে দক্ষিণ অঞ্চলের ভূউপরিস্থ যে পানি আছে তা কৃষিতে সেচের জন্য এখনো চলনসই। তবে পানি নিয়ে যেভাবে অর্বাচীন তাণ্ডব চলছে তাতে কতদিন ওপরের পানি থাকে তা নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। এরই মধ্যে ওপরের পানি কমে যাওয়ার কারণে বরিশালের ভূগর্ভে এর মধ্যেই নোনাজল চলে এসেছে। ফলে বছর দুই আগেই ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটকে বরিশালে ভূগর্ভস্থ পানির বদলে ভূউপরিস্থ পানি দিয়ে ধানের গবেষণা খামারে সেচ দিতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন আছে। পাশেই খাল থাকা সত্ত্বেও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কেন সেচের জন্য ডিপ টিউবওয়েলের ওপর নির্ভর করল? জানা কথা, খালের পানি ব্যবহারের চেয়ে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারে খরচ বেশি। আর যেখানে যত খরচ সেখানে তত বাণিজ্য! আসলে এ অবাধ্য বাণিজ্যই দেশের অন্যান্য সেক্টরের পাশাপাশি কৃষি ও পানির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে বলে মনে করা হয়।

এদিকে অনেকেই না জানলেও কেউ কেউ জানেন, দক্ষিণ অঞ্চলের সেচ ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ায় কৃষি উৎপাদন কমে প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বিলম্বে হলেও কুম্ভকর্ণের ঘুম কিঞ্চিত ভেঙেছে বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের। একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। জানা গেছে ‘বরিশাল সেচ প্রকল্পের পুনর্বাসন (প্রথম পর্ব) নামে এ প্রকল্পটি বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে অনুমোদনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় বরিশাল সেচ প্রকল্প (বিআইপি)-এর অন্তত ২১টি পাম্প হাউস মেরামতের মাধ্যমে সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হবে বলে জানা গেছে। এ প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে- ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীমের বিশেষ নজরদারিতে প্রকল্পটি চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া অনেকটাই এগিয়েছে। এ দাবি সত্য হলেও একটি প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়, গোধূলি বেলায় কেন এ যজ্ঞ?

উল্লেখ্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার আমলে ১৯৭২-১৯৭৫ সময়কালে বরিশাল সেচ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। ১৯৭৪ সালের ৮ জুলাই আবদুর রব সেরনিয়াবাত বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানিসম্পদ ও বিদ্যুৎমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব লাভ করার পরিপ্রেক্ষিতে গোটা দেশে কৃষি ও পানি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। আর বিশেষভাবে উপকৃত হয় বরিশালের ৬ জেলা। তখন ছিল এক জেলা। তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত দক্ষিণ অঞ্চলে ইরি চাষের জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফলে ৭৪ সালে ‘ষড়যন্ত্রের দুর্ভিক্ষের’ তীব্রতা এ অঞ্চলে তুলনামূলক কম ছিল। এদিকে বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ও ডিজাইনে এ প্রকল্প নিয়েও অন্যরকম ত্রুটির অভিযোগ আছে। বিশ্বব্যাংকের পরিকল্পনা প্রণয়নের বেলায় বরিশালের পানির উৎস ও প্রবণতা সঠিকভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের আবকাশ আছে। ফলে বরিশালের জন্য গলার কাঁটা হয়ে গেছে বিআইপি এবং দীর্ঘমেয়াদে এ অঞ্চলের অনেক এলাকায় পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এবং খরস্রোতা চওড়া খালে নির্মিত ছোট সাইজের স্লুইস গেটগুলো পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি দ্রুতই ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। এর আগে শত বছর বিরাজমান খালগুলোর সর্বনাশ করে দেয়। এ স্লুইস গেটগুলো এখন অনেক স্থানে কংক্রিট ও লোহার কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। যার কোনো উপযোগ নেই। এ প্রকল্পে অন্যরকম ত্রুটিও ছিল। এর ডিজাইন করা ছিল পানি ডাবল লিফটিং ব্যবস্থার। মানে নদী থেকে পানি তুলে খাল ভরাট করা হবে এবং খাল থেকে জমিতে সেচ দেবে কৃষক। কিন্তু বরিশাল অঞ্চলে সেই সময় খালে পানি রাখার জন্য নদী থেকে তোলার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। এখনো প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন কেবল কয়েক বছর পরপর খাল ও নদী খনন।

স্মরণ করা যেতে পারে, বঙ্গবন্ধু নদী খননের জন্য বিদেশ থেকে আটটি ড্রেজার এনেছিলেন। জানা যায়, নদী খননে ড্রেজার তাঁর বিবেচনায় আসে কিশোর বয়সে মাঠে ফুটবল খেলার সময় পাশের নদীতে ড্রেজার দেখে। নদী ড্রেজিং ও খাল খননের কর্মসূচি পাকিস্তান আমলেও জোরদার ছিল। তখনো খরস্রোতা খালও তিন-চার বছর পরপর খনন করা হতো। আর জিয়াউর রহমান তো গ্রহণ করেছিলেন সারা দেশে খালকাটা কর্মসূচি। কিন্তু অনেকের বিবেচনায় এটি যত ছিল বাস্তবতা, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যদিও এর ওপর গবেষণা করে মহীউদ্দীন খান আলমগীর ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বলা হয় তিনি সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার সুনজরে ছিলেন। অবশ্য তাতে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে মন্ত্রী এবং অনেক কিছু হতে তার কোনো অসুবিধা হয়নি। খালেদা সরকারের প্রথম আমলের শেষ দিকে কথিত জনতার মঞ্চে প্রভাবশালী নেতা হিসেবে তার অতীতের সব কালিমা মুছে গেছে। তিনি যেন হয়ে গেছেন দেবশিশু! এদিকে জিয়াউর রহমানের পরের সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ যেন পুরোই পানিবিমুখ ছিলেন। এর প্রমাণ তিনি ‘বরিশাল ইরিগেশন প্রজেক্টে’ও রেখেছেন। প্রকল্পের ডাবল লিফটিং ব্যবস্থায় প্রথম দফায় নদী থেকে পানি তোলার খরচ বহন করত সরকার এবং জমিতে সেচ দেওয়ার খরচ মেটাত কৃষক। কিন্তু একপর্যায়ে প্রথম লিফটিংয়ের খরচ এরশাদ সরকার বন্ধ করে দিল। এ অবস্থায় পুরো সেচব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। কারণ ডাবল খরচ বহনের ক্ষমতা কৃষকদের ছিল না।

মনে রাখা প্রয়োজন, যোগাযোগে উন্নয়নের নামে যেসব ডিজাইন এবং ভৌগোলিক ও পরিবেশগত বাস্তবতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে কালভার্ট-সেতু-রাস্তা নির্মিত হয়ে আসছে তা কিন্তু আখেরে বাংলাদেশকে পানিশূন্য করে চরম বিপর্যয়ে নিমজ্জিত করতে পারে। তখন চাইলেও আর হয়তো পানি সংকট থেকে দেশকে তোলা যাবে না। নিমজ্জিত টাইটানিক জাহাজ কি তোলা গেছে? আর পানি সংকট হলে খাদ্য নিরাপত্তা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, মিষ্টি পানির ৭০ শতাংশই ব্যবহৃত হয় কৃষি কাজে। ফলে পানির সংকট আরও তীব্র হতে থাকলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না! এ প্রসঙ্গে ১৬ অক্টোবর পালিত বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যে বিশেষ দোতনা রয়েছে। যাতে বলা হয়েছে- ‘পানি জীবন, পানিই খাদ্য। কেউ থাকবে না পিছিয়ে’। কিন্তু পানি প্রশ্নে যারা পিছিয়ে থাকবে তাদের যে কোনো মাত্রায় দুর্দশা হবে তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তখন খাদ্যের জন্য হাহাকার করা ছাড়া হয়তো আর কিছু করার থাকবে না। আর পানি না থাকলে গর্বের পদ্মা সেতু পরিণত হতে পারে ঊষর বালুচরে বিশাল ওভার ব্রিজে। সঙ্গে বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, ৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাওয়ার ফলশ্রুতিতে ‘ধান-নদী-খাল, এই তিনে বরিশাল’ হয়ে গেছে কেবলই অতীত স্মৃতি, সেই বাস্তবতা এখন পরিণত হয়েছে অলীক প্রবচনে! স্লুইস গেটের কারণে খালগুলো যে দশায় পৌঁছে তাতে বিরাজমান অকেজো স্লুইস গেটগুলো কার্যকর করা ছাড়া আপতত আর কোনো উপায় আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন না। আর দীর্ঘমেয়াদে এগুলো অপসারণ করে খাল খনন করতেই হবে। জোর দিতে হবে নদী খননের ওপরও। এ বিষয়টি ১৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আমাদের নদী-নালাগুলো মানুষের জীবনের মতো, এগুলোর প্রবাহ ঠিক রাখতে হবে। মানুষের হার্ট বন্ধ হলে যেমন মরে যায়, নদী-নালার প্রবাহ বন্ধ হলে দেশটাই মরে যায়।’ প্রশ্ন হচ্ছে, নদী-খাল-জলাধার কি কাক্সিক্ষত মাত্রায় বেঁচে আছে? এ প্রসঙ্গে কবিতার একটি পঙক্তি উদ্ধৃত করা যায়- ‘একে কি বেঁচে থাকা বলে!’

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর