শুক্রবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ আলেম হাফেজ, মুফতি মুহাদ্দিসদের দেশ

আল্লামা মাহ্মূদুল হাসান

পৃথিবীর অন্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে আলেম, হাফেজ, মুফতি-মুহাদ্দিসদের সংখ্যা বেশি। এ দেশ থেকে সারা পৃথিবীতে ইসলামের প্রচার-প্রসার হচ্ছে ব্যাপকভাবে। বস্তুত এত সুন্দর একটি দেশে জাতিকে বিভ্রান্ত করে ষড়যন্ত্রের পাঁয়তারা যারা করে তাদের বিচার জাতিই করবে। আমি আজ ওয়াজ করতে পারছি না, আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। এ দেশে লক্ষ-কোটি আলেম আছেন, তারা গরিবি হালতে চলছেন। আমি যদি ইচ্ছা করি তাহলে প্রতি মাসে কোটি টাকা উপার্জন করতে পারি। এমনও লোক এখানে বসা আছেন যাদের বললে লক্ষ-কোটি টাকা দিতে রাজি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি আমার মাদরাসার ওস্তাদদের পকেটে কিছুই দিতে পারছি না। দেশে শত শত মাদরাসা তৈরি করেছি, তাতে মাসে কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। তবে কেউই বলতে পারবে না যে, আমি কারও কাছে একটি টাকার জন্য হাত পেতেছি। একবার এ মাদরাসার জমি ক্রয় করার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একজনকে বিদেশে পাঠাব কালেকশনের জন্য। কিন্তু পরে চিন্তাভাবনা করে তা বাদ দিলাম। কারণ মনে হলো যে, এটা শয়তানের প্ররোচনা। আমি কেন মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পাতব? আমি তো সবকিছুর মালিক আল্লাহর কাছে হাত পাতব। এই যাত্রাবাড়ী মাদরাসার একটি টাকাও বিদেশের নয়। শত শত কোটি টাকার মালিকরা এসে বসে থাকেন, টাকা নেওয়ার আবেদন করেন। দুনিয়ার টাকা-পয়সা আমার প্রয়োজন নেই। আমার কথা হলো- আল্লাহ যদি আমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি সন্তুষ্ট থাকেন তাহলে সেটাই হবে আমার জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমরা আল্লাহর বাহিনী, রসুলের বাহিনী, আমরা মানুষের দ্বারে দ্বারে যাব না। আল্লাহ যদি আমাদের প্রতি খুশি থাকেন তাহলে আকাশ বিদীর্ণ করে তিনি আমাদের জন্য রিজিকের ফয়সালা করবেন। কোরআনে পাকে আছে, যারা গুনাহমুক্ত জীবন বানাবে, আল্লাহর ওপর ভরসা করবে, আল্লাহ তাদের সব বন্দোবস্তের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, অকল্পনীয়ভাবে রিজিক দান করেন।

এ জমানার আহলে সুফফা

হয়তো দুনিয়ার মানুষ আমাদের ফকির, জাতির বোঝা মনে করবে, যেমন মক্কাবাসী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছিল পাগল, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ইত্যাদি। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) দুই-তিন দিন পর্যন্ত না খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকতেন, তবুও নবীর সান্নিধ্য ছাড়তেন না, বাড়িতে যেতেন না, হাঁট-বাজারে যেতেন না; যাতে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস ছুটে না যায়। একদল সাহাবি সর্বদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যে বসে হাদিস লিখতেন, মুখস্থ করতেন। এখানে আপনারা যাদের দেখছেন এরাই হলো ওই পাগলের দল। এরা নবীর রক্তঝরা জীবনের, পাথর বাঁধা জীবনের হাদিস পড়ছেন, তাই কোরআন-সুন্নাহ হেফাজতের জন্য আজ ওরা খেয়ে-না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি হাফেজের দেশ হলো বাংলাদেশ। বহির্বিশ্বে যত খতমে তারাবি হয় তার আশি ভাগই বাংলাদেশের হাফেজরা পড়ান। পৃথিবীর যে দেশেই যাবেন দীনের প্রশ্নে এক নম্বরে থাকে বাংলাদেশ। পাকিস্তান দুই নম্বরে, ভারত তিন নম্বরে আর সৌদি আরব অনেক নিচে থাকে।

মনের দুঃখ

বাংলাদেশের আলেম-ওলামাদের দেশের মানুষ বুঝল না। দুটি গাছ একসঙ্গে থাকলে বাতাসের কারণে একটি অপরটির সঙ্গে লেগে ডালপালা ভেঙে যায়, পাতা ছিঁড়ে যায়। সে জন্য গাছ দায়ী নয়, দায়ী হলো অদৃশ্য বাতাস। বস্তুত এ দেশের কিছুসংখ্যক আলেমকে অদৃশ্য এক বাতাস ব্যবহার করছে, আমরা এ বাতাসকে চিনতে পারছি না। এ বাতাসের কারণে আলেমদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে, অমিল-অনৈক্য জেঁকে বসেছে, তাদের ডালপালা ভেঙে যাচ্ছে, পাতা ছিঁড়ে যাচ্ছে। দুঃখ লাগে যে, আমি আমার জাতি ও প্রশাসনকে তা বোঝাতে পারলাম না। সরকার ও প্রশাসনকে বলতে চাই, আমাদের এসব মাদরাসার ইতিহাস শত বছরের। মাদরাসাগুলোতে আজ পর্যন্ত এমন একটি উদাহরণ দেখাতে পারবেন না যে, এক ছাত্র অপর ছাত্রকে পিস্তল দিয়ে গুলি করেছে, নিজেদের মধ্যে মারামারি-হানাহানি করে হতাহত হয়েছে।

এ মজলিসে আজ সারা বাংলাদেশ থেকে আলেম-ওলামারা এসেছেন, তারা জাতির করুণ অবস্থা দেখে, নবীর সুন্নতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আমাকে মুরব্বি মনে করে এখানে এসেছেন। এ মাদরাসাগুলোতে ৭-৮ বছরের ছেলেরা ছয় মাসে, এক বছরে বা দুই বছরে কোরআনের হাফেজ হচ্ছে। এদের যারা জঙ্গি বলে তাদের বুঝ শক্তির প্রতি দুঃখ হয়। হে জাতির কর্ণধাররা! হে বড় লোকেরা! উচিত ছিল আপনাদের ছেলেদের এসব মাদরাসায় লেখাপড়া করানো। এতে তারা দীন ও শরিয়ত সম্পর্কে বুঝত এবং আমাদের সম্পর্কেও জানত, কিন্তু আপনাদের সন্তানদের এ লাইনে না দিয়ে আমাদের অযৌক্তিকভাবে দোষারোপ করছেন। জেনে রাখুন, এ এতিম ছেলেদের যদি ভালো বাসতে পারেন, মাথায় রাখতে পারেন, তাহলে দুনিয়ার জীবনে শান্তি আসবে এবং পরকালেও জান্নাত লাভ করতে পারব।

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ

সর্বশেষ খবর