শনিবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

নাতিশীতোষ্ণতার সন্ধানে

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

নাতিশীতোষ্ণতার সন্ধানে

অতি শীতে কাতর সাইবেরিয়ার পাখিরা নাতিশীতোষ্ণতার খোঁজে হিমালয় পেরিয়ে নেপাল নালন্দা বেড়িয়ে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ছাড়িয়ে সাভারে অতিথি হয়ে কেন আসে মোটা বুদ্ধির বাবর আলীর মাথায় তা সহজে ঢোকে না। পাখিরা, বাবর আলী যতদূর জানে তাদের গতিপথ নির্ধারণে বিদেশি বিশেষজ্ঞ বা চিন্তাচৌবাচ্চার (থিঙ্ক ট্যাঙ্ক) কাছ থেকে ছবক নেয় না, নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, এ ব্যাপারে তারা ভূরাজনীতির ধারেকাছে নেই, তারা তাদের নিজস্ব উপলব্ধিতে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই সমতটে পাড়ি জমায়। বাবর আলী বুঝবার পারে না, পাখিরা যা বোঝে মানুষ কেন তা বোঝে না। কর্কশ কণ্ঠের কাকরাও নিজেদের স্বার্থ নিজেরাই বোঝে, তাদের কেউ বিপদে পড়লে ভেদাভেদ ভুলে সবাই সমবেদনা জানাতে সমানুভূতিতে স্বশব্দে একত্রিত হয়, গণতন্ত্রের ছবক নেওয়া বুদ্ধিমান মানুষ তা কেন করে না বা পারে না, বেচারা বাবর আলীর বুঝে আসে না। বাবর আলীর ছেলে আদম আলী হিসাব বিজ্ঞানে পড়ে গাঁও গেরামেরই কলেজে। আজকাল বাড়ি থেকে দুই পা ফেললে কলেজ, তিন পা এগোলে বিশ্ববিদ্যালয়ও মিলতে পারে। আগের আমলের দূর দূরান্তের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, আল আজহার, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ এবং হাল জমানার কলম্বিয়া, ইউবিসির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দেশের ঘরে ঘরে গড়ে তোলা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার তুল্য মূল্যেরও হিসাব বাবর আলী মেলাতে পারে না। ছেলেবেলায় ব্যাকরণ স্যার তাদের সন্ধি বিচ্ছেদ আর সমাস পড়িয়েছিলেন। মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস নামে ও কামে তার কাছে ছিল প্রিয়। বিশ্ব (দুনিয়ার) বিদ্যা যেখানে লয় (ক্ষয়) হয় সেটিই বিশ্ববিদ্যালয় কি না এ কথা লিখলে তার স্যার কবর থেকে উঠে এসে নম্বর কেটে নেবেন। যে লেখাপড়ায় মানবসম্পদ দক্ষ ও করিৎকর্মা হয়ে ওঠে না, রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল দেশে বিদেশিরা এসে বিলিয়ন ডলার কামিয়ে নিয়ে যায়, শিক্ষিত বেকারের ভারে ভেঙে পড়ে পরিবার সমাজ ও অর্থনীতি সেই দেশ কীভাবে স্মার্ট হবে বাবর আলীরা ভেবে পায় না।

আদম আলী হিসাববিজ্ঞানে আজব এক শুমার শিখছে এখন- ‘ব্যালান্স শিট’। যেখানে আয়-ব্যয়, লাভ ক্ষতি, পুঁজি ও মুনাফা, দায় দেনা সবতের হিসাব মিলিয়ে দেখানো হয়। এভাবেই নাকি ব্যক্তি বা কোম্পানির আর্থিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। মোটা বুদ্ধির না হয়ে চিকন বুদ্ধির হলে বাবর আলী তার গ্রামের মাথা মোতালেব শিকদারের হাল হকিকতের একটা ব্যালান্স শিট কষতে বলত আদম আলীকে। বড় মাদবর মতলেব শিকদারের বিশাল বাড়ি, সহায় সম্পত্তি, লোকলস্কর, তার প্রচণ্ড প্রভাব ঘরে-বাইরে। তার ক্ষমতাও এমন সে শুধু মেয়েকে ছেলে আর ছেলেকে মেয়ে বানানো বাদে আর সব পারে। গ্রামের লোক মনে মনে ভাবে মতলেব শিকদারের ব্যালান্স শিট কষলে, তার সাঙ্গপাঙ্গদের ঘর সংসার সহায় সম্পত্তি এবং গ্রাম উন্নয়নের আসল চেহারা সুরত বেরিয়ে আসত। মতলেব মিয়ার ব্যালান্স শিটে পাওয়া যেত তার এবং তার খয়ের খাঁদের আয় অর্জনের চাইতে ব্যয় বর্জনের পরিমাণ বেশি, দেখা যেত তার পুঁজির বেশ ঘাটতি, গ্রাম উন্নয়নের নামে সম্পদ অপচয় অপব্যবহার অপহরণে, ধার-দেনায় সব শেষ। কেউ শিকদারকে অস¦ীকার করতে পারবে না, তিনি গ্রামের জন্য অনেক কিছু করেছেন। তবে তার তোষামোদি সাঙ্গপাঙ্গদের একেকটি অপকর্মের সঙ্গে তার সুকর্মের হিসাব মিলালে হয়তো দেখা যাবে মতলেব মিয়ার বাঁয়ে তেমন কিছু থাকে না। কথায় আছে না এক বালতি খাঁটি গরুর দুধে দুই ফোঁটা গো চোনা পড়লে যেমন হয় মোতালেব শিকদারের অনেক প্রচারসর্বস্ব প্রশংসনীয় কাজও ম্লান হয়ে যায়। গ্রামবাসীর জন্য এত ভালো কাজ করেও তাঁদের মন তিনি কেন পান না তার হদিস তার চাটুকাররাও মেলাতে পারেন না। দুর্মুখেরা এ কথা ভয়ে বলতেও পারে না যে, গ্রামের মানুষকে বোকা বানিয়ে, তাদের পাত্তা না দিয়ে নিজেকে বুদ্ধিমান (সেই চালাক কাকের মতো যে অন্যরা যাতে না দেখতে পারে সে জন্য নিজে চোখ বুজে মাংসের টুকরা লুকায়) মনে করে বলেই এমনটা হচ্ছে বলে তার নিজের লোকেরাই মনে করে। তবে এটা ঠিক গ্রামবাসীরও বুঝতে হবে, তাদের জন্য উন্নয়ন করতে গিয়ে মোতালেব মাদবর কেন দোষের ভাগীদার হবেন। যার যা বা যতটুকু ভালো তার তারিফ করতে হবে, ন্যায়-নীতিনির্ভর ও বাস্তবতাকে স্বীকার করতে হবে। নীতিবিবর্জিত ও স্বার্থান্ধ তোষামোদকারীরাই জনদরদি মোতালেবের মতো মাদবরকে ভুল পথে নিয়ে যায়, বাবর আলীর বিবেচনা তাই-ই।

এমতাবস্থায় মোটা বুদ্ধির বাবর আলী তাদের ছোটবেলার ওস্তাদজি চৌরাস্তার আরজান পণ্ডিতের কাছে যায় ব্যাপারটা খোলাসা করার ছবক নিতে। পণ্ডিত তামাকের হুকোয় টান দিতে দিতে বলতে থাকেন। শোন-

ইংরেজিতে একটা কথা আছে excess of anything is bad অর্থাৎ কোনো কিছুর বাড়াবাড়িই খারাপ। মাত্রা অতিক্রম করলে অনেক ভালো জিনিস মন্দ রূপ বা আকার ধারণ করতে পারে। যেমন- মাত্রা অতিক্রম করলেই সাহস হঠকারিতায়, আত্মউৎসর্গ আত্মহত্যায়, প্রতিযোগিতা হিংসায়, ধর্মভীরুতা ধর্মান্ধতায় পরিণত হতে পারে। অবস্থা বিশেষে সমালোচনা পরচর্চায়, প্রশংসা চাটুবাদে, তেজ ক্রোধে, দেশপ্রেম দেশদ্রোহিতার স্তরে নেমে আসতে পারে। নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রা যেমন সবার পছন্দ তেমনি সুরের মধ্যে পঞ্চম স্বরই মিষ্ট এবং শ্রেষ্ঠ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বারবার বলেছেন- তোমরা কোনো কিছুতেই সীমালঙ্ঘন করো না। আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীকে ভালোবাসেন না। লোকমান হাকিম তার ছেলেকে উপদেশছলে বলেছেন, মাটিতে হাঁটবে মধ্যম মেজাজে আর তোমার স্বর হওয়া উচিত মোলায়েম, স্বরের মধ্যে গাধার-স্বরই নিকৃষ্ট।

প্রত্যেকের উচিত খাওয়া-দাওয়া, চাওয়া-পাওয়া, চিন্তা-চেতনা, আশা-প্রত্যাশা, আগ্রহ-আকাক্সক্ষার ক্ষেত্রে একটা পরিমিতিবোধ মেনে চলা। অধিক ভোজনই অধিকাংশ রোগবালাইয়ের কারণ। পরিমিত আহার শরীর ও মনের জন্য অপরিহার্য। মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা সরবরাহে সমস্যা সৃষ্টি করে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। অধিক পরিশ্রমে মন ও শরীর ভেঙে পড়ে। অতি কথনে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। অতিরিক্ত সব কিছু খারাপ। বাবর আলী তুমি তো জান অতিভক্তি চোরের লক্ষণ নামে একটি প্রবাদ এখনো চালু আছে।

বাড়াবাড়ি কখনোই সুখকর হয় না। অতি উত্তেজিত ব্যক্তির হার্টবিট ও রক্তের চাপ বাড়ে। অতি দ্রুত চলাচলকারী গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সমূহ বিপদের কারণ ঘটাতে পারে। চলনে বলনে আচার ব্যবহারে কর্মকাণ্ডে মধ্যম পন্থা অবলম্বনই সেরা অভ্যাস বলে বিবেচিত। আনন্দ-সর্বনাশের অধিক উচ্ছ্বাস কিংবা অতিশোকে কাতর হতে নেই। আনন্দের পরে বিষাদ আসছে আর বিষাদের পর আনন্দ আসবেই এই বোধ ও বিশ্বাসে সব পর্যায়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা বা রাখার উপকারিতা অস্বীকার করা যায় না। ভগবৎ গীতার (অধ্যায়-২ শ্লোক-১৫) যেমন বলা হয়েছে O best (Arjuna), the person who is not disturbed by happiness and distress and is stead in both is certainly eligible for liberation.

মধ্যপন্থা অবলম্বনে ঝুঁকি কম। মধ্যমে অবস্থানে থাকলে উঁচু মাত্রায় উঠতে যেমন সুবিধা হয়, নিচু মাত্রায় নামার ক্ষেত্রেও অসুবিধা হয় না। অথচ অতি নিম্নমাত্রায় থাকলে তাকে মধ্যপন্থা পেরিয়ে উচ্চ পন্থায় যেতে বেশ বেগ পেতে হয়। আবার উচ্চ পন্থা থেকে মধ্যপন্থা হয়ে নিম্ন পন্থায় নামতেও বেশ বিব্রতকর হতে হয়। বিশ্বাস ও বয়ানে মধ্যপন্থা নিরাপদ ও সুশ্রাব্য। কোকিলের স্বর পঞ্চম ও মধ্যমানের তাই এত মিষ্ট। পক্ষান্তরে কাকের স¦র সপ্তম, কর্কশ সুশ্রাব্য নয়। মধ্যপন্থার সুর বা স্বর সহজে অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে উচ্চগ্রামের গান বা কথাবার্তা অশ্রাব্য ও ঝগড়া বাদানুবাদের ভাষা। চরম অবস্থান গ্রহণে সহজে সমঝোতা হয় না। সমাধান খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়। মিষ্টি সুরের গান বা কথা সব সময়ই মোলায়েম ও কোমল প্রশান্তির পরিচয় তুলে ধরে, আনন্দ ও উপভোগের সুযোগ সৃষ্টি করে।

যারা প্রকৃত বুদ্ধিমান তারা আজকের ঘটনা নিয়ে আজ ভাবেন না। এটি তাঁরা ভেবেছিলেন বেশ কিছুদিন আগে এবং আজ যা ভাবছেন, তা আজকের জন্য নয়, ভাববেন বেশ কিছুদিন পরের জন্য। যারা তাৎক্ষণিক ঘটনায় আপ্লুত, বিমোহিত, বিমর্ষ কিংবা উৎফুল্ল হন, তাঁরা অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুব একটা স্বচ্ছ ধারণা পোষণ করতে সক্ষম বলে মনে হয় না। সময় যেহেতু দ্রুত পরিবর্তনশীল, সেহেতু তাৎক্ষণিক বলে কিছু নেই এবং তাৎক্ষণিকের ঘটনায় চূড়ান্ত সবকিছু ভাবাও সঠিক নয়। তবে তাৎক্ষণিকের ঘটনা কিন্তু তাৎক্ষণিক নয়, এটি সময়ের ধারাবাহিকতারই একটি অংশ। সে কারণেও তাৎক্ষণিকই চূড়ান্ত নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা বর্তমানের কার্যকারণকে এবং ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টিক্ষেপে প্রভাব ফেলতে বাধ্য। সুতরাং বর্তমানের ঘটনাকে সতর্ক ও সংহত ও সংযমের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত, পরবর্তীতে কী ঘটে তার জন্য। এটা করতে পারলে উত্তেজনা পরিহার করা সম্ভব। প্রতিশোধ স্পৃহা এবং অকারণ বাড়াবাড়ি ব্যক্তি ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে অসম্ভব করে তুলতে পারে। কেহ অত্যাচারিত হলে প্রতিশোধ গ্রহণের প্রশ্ন আসে। কিন্তু এই প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘিত হলে প্রতিশোধ গ্রহণও অত্যাচারে পর্যবসিত হতে পারে। প্রতিশোধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘিত হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে বাধ্য এবং যা সামাজিক ভারসাম্য বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতিবর্ষণে বন্যা হয়, অধিক শীতে কাতর হয়, অতি গরমে হাঁসফাস করে সবাই। সবারই স্বপ্ন থাকে বসন্তের বাতাস, নাতিশীতোষ্ণ নিরপেক্ষ পরিবেশ, পরিমিত বর্ষা আর মধ্যম বা পঞ্চম সুরের গান। বাবর আলী ভাবে মোতালেব মিয়াকে সাইবেরিয়ার পাখিদের মতো নাতিশীতোষ্ণতার খোঁজে যেতে বললে কেমন হয়?

লেখক : সাবেক সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান এবং প্ল্যানিং কমিশনের সাবেক সদস্য

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর