শনিবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বরেন্দ্রে সমৃদ্ধির রং ছড়াচ্ছে ড্রাগন ফল

শাইখ সিরাজ

বরেন্দ্রে সমৃদ্ধির রং ছড়াচ্ছে ড্রাগন ফল

গত সপ্তাহে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার বিভিন্ন শহর, উপশহর ও গ্রামে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। বরেন্দ্র অঞ্চলের এ এলাকাগুলোতে গত এক দশকে বেশ পরিবর্তন এসেছে। মাঠে মাঠে এখন আমন ধান সবুজ হয়ে আছে। বিস্তীর্ণ সবুজের মাঝে গাঢ় সবুজ হয়ে আছে বিভিন্ন উচ্চমূল্যের ফল-ফসলের বাগান। বারোমাসি আম, পেয়ারা, মাল্টা ও ড্রাগনের বাগান। ফসল বৈচিত্র্যের দারুণ সম্মিলন এখন বরেন্দ্রের টেরেসগুলোতে। নওগাঁর সাপাহারের সীমান্তবর্তী এলাকায় পুনর্ভবা নদীর পাশ ধরে চলছিলাম। চোখ জুড়াচ্ছিল সবুজ প্রকৃতি আর ফসল বৈচিত্র্যের মাঠ। হঠাৎ চোখ আটকালো ভিন্ন রকম এক বাগান। ড্রাগন ফলের বাগান। প্রত্যন্ত গ্রামে এমন আধুনিক বাগান দেখে বছর ছয়েক আগে চীনে দেখা এক ড্রাগন বাগানের স্মৃতি মনে পড়ল।

২০১৮ সালের কথা। চীনের গোয়াংডং প্রদেশের জংশান শহর থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে শিনশিং কাউন্টির একটি গ্রামে ঢুকেছি। গ্রামটিতে যখন প্রবেশ করলাম সূর্য তখন পশ্চিম দিকে হেলেছে। ঝকঝকে নীল আকাশ। আর রোদের সোনালি আভায় মনে হলো আমরা সত্যিকারের একটা চীনা গ্রামেই যেন প্রবেশ করলাম। এ কথা বলছি কারণ, চীনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এত বেশি ঘটেছে যে, গ্রাম আর শহরকে এখন আর পৃথক করা যায় না। তবে সেখানটায় এখনো গ্রামের কিছুটা আবহ পাওয়া যাচ্ছিল। রাস্তার দুই পাশে ফসলের খেত। সোনালি রং নিয়ে ধান পেকে আছে। আছে সবজি বাগান। পালং শাকের চাষ করছেন কেউ। কেউ বা শর্ষে শাক কিংবা গাজর। পাহাড়ের পাশে চীনা ঐতিহ্যে কৃষি খামার দেখে অভিভূত হচ্ছিলাম। পথ চলতে চলতেই চোখে পড়ল বিশাল ড্রাগন ফলের বাগান। শীতকালে সাধারণত ড্রাগন ফলের মৌসুম নয়। তাই ক্যাকটাস-জাতীয় এ গাছটির বাগান সবুজে ছেয়ে আছে। দিগন্তবিস্তৃত ড্রাগন ফলের বাগান। দূরে চোখে পড়ল ড্রাগন বাগানে সাদা সাদা কী যেন ঝুলছে! একটা দুইটা নয়, অসংখ্য। দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম খুব সম্ভবত ওগুলো লাইট। দিনের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে অমৌসুমে ফল ফলানোর কোনো কৌশল। কারণ নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. মামুনুর রশীদ কন্দাল ফসল আলুর বীজ উৎপাদন নিয়ে কাজ করছিলেন। আমি সে সময় তার গবেষণা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির জন্য গিয়েছিলাম। তখন দেখেছি লাইটের আলো ব্যবহার করে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়ানোর কাজ করছিলেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই ধারণা করলাম, ওগুলো লাইট হতে পারে।

আমরা গাড়ি নিয়ে বাগানটিতে প্রবেশ করলাম। কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম সত্যি সেগুলো এলইডি লাইট। এক তরুণ উদ্যোক্তা, নাম লি ৪০ একর জমি লিজ নিয়ে বিশাল এ ড্রাগন ফলের বাগান গড়ে তুলেছেন। এলইডি বাতি লাগিয়ে তিনি সত্যি সত্যি দিনের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর ফলে লাভও পাচ্ছেন। অমৌসুমেও পাচ্ছেন ফল। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর ঠিক ৬টায় অটোমেটিক জ্বলে উঠল বাতিগুলো। দারুণ প্রযুক্তিটি সত্যি পাল্টে দিয়েছে ড্রাগন ফল উৎপাদনে হিসাব-নিকাশ। প্রতিটি সারিতে মৌসুম শেষে নতুন করে পসরা সাজিয়ে এসেছে ড্রাগন ফল। শুধু বাতির সাহায্যে দিনের দৈর্ঘ্য একটু বাড়িয়ে দিয়েই চার মাসের জন্য ভরপুর ফলন পাওয়ার এক উত্তম ব্যবস্থা। এটি এলইডি বাল্বের এক জাদু। সেই প্রতিবেদন টেলিভিশনে প্রচারের পর দেশে অনেকেই এলইডি বাতি ব্যবহার করে অমৌসুমেও ড্রাগন ফল উৎপাদন শুরু করেছেন। সেগুলোও আমি টেলিভিশনে তুলে ধরেছি।

নওগাঁর প্রত্যন্ত গ্রাম হাফানিয়ায় এমন এলইডি লাইটের বিশাল বাগান দেখে অভিভূত হলাম। গণমাধ্যমের শক্তি এখানেই ‘কৃষি কৌশল’ ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশ থেকে দেশে, কৃষক থেকে কৃষকে। এ বাগানের কথা বেশ কয়েক মাস ধরেই শুনে আসছিলাম। আধুনিক প্রযুক্তির ড্রাগন বাগানটিতে প্রবেশ করলাম। উদ্যোক্তা প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। তাকে সঙ্গে নিয়ে বাগানটি ঘুরে দেখছিলাম। কর্মীরা ব্যস্ত মৌসুমের ফল সংগ্রহে। সারি সারি গাছে ফলে আছে গোলাপি ড্রাগন। তিনি বলছিলেন পেশায় প্রকৌশলী হয়েও কীভাবে যুক্ত হলেন কৃষির সঙ্গে। ‘করোনার সময়টিতে ভাবছিলাম কী করা যায়। পৈতৃকভাবে পাওয়া কৃষি জমিগুলোকে কীভাবে আরও বেশি উৎপাদন খাতে ব্যবহার করা যায়।

শৈশব থেকেই আপনার কৃষি অনুষ্ঠানগুলো আমি দেখে এসেছি। এখনো প্রতিটি পর্বই দেখি। টেলিভিশনে মিস করলে, ইউটিউবে। ওগুলো দেখেই মনে হলো ড্রাগন ফলের বাগান হতে পারে আমার জন্য পারফেক্ট কৃষি কার্যক্রম। বিশেষ করে চীনের প্রতিবেদনটা দেখে উদ্বুদ্ধ হলাম। আমিও কাজ করি তড়িৎ প্রকৌশল নিয়ে। প্রথমে আট বিঘা জমিতে বাগান করলাম। মাশাল্লাহ তিন বছরেই বাগানটি ৪৫ বিঘায় সম্প্রসারণ করতে পেরেছি। বলছিলেন আবুল কালাম আজাদ।

সত্যিই মুগ্ধ হতে হয় দেখে। সুপরিকল্পিত ফল উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় এ অল্প সময়েই পূর্ণতার ছাপ চোখে পড়ে।

খুব অল্প সময়েই ড্রাগন ফল স্থান করে নিয়েছে জনপ্রিয়তার কাতারে। বিদেশি একটা ফল ক্রমেই হয়ে উঠেছে দেশি ফলের মতোই। ড্রাগন চাষ করে লাভের মুখ দেখেছেন অনেক উদ্যোক্তা। ইতোমধ্যেই অনেকের সাফল্য আমি টেলিভিশনে তুলে ধরেছি। গণমাধ্যমে একজনের সাফল্য দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন অনেকজন। এভাবেই ড্রাগন চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে সারা দেশে। আশার কথা হচ্ছে, ড্রাগন বা ড্রাগনের মতো উচ্চমূল্যের ফল-ফসল চাষে যুক্ত হচ্ছেন কৃষির বাইরে থাকা পেশাজীবীরাও। যুক্ত হচ্ছেন তরুণ প্রজন্ম। শিক্ষিত এ তরুণদের হাতে দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে আমাদের কৃষির চিত্র। উদ্যোক্তা বলছিলেন, উৎপাদনে ‘কৌশল’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি কৌশল আয়ত্তে আনতে পারলে ভালো ফলন পাওয়া কঠিন কাজ নয়।

বাগান শুরুর তিন বছরেই তিন দাগে ৪৫ বিঘায় ড্রাগন বাগান সম্প্রসারণ করেছেন এ উদ্যোক্তা। সে হিসেবে বলা যায় কৃষির সাফল্য বেশ ভালোভাবেই ধরা দিয়েছে তার হাতে। তবে একেকজনের সাফল্যের হিসাব একেক রকম। কিন্তু লাভের প্রশ্নে উৎপাদনকেই সামনে রাখতে হয়। উদ্যোক্তা আবুল কালামের দাবি, উৎপাদনের হার হিসাব করলে তিনি এগিয়ে থাকবেন সারা দেশের ড্রাগন উৎপাদনকারীদের মধ্যে।

গ্রামের কৃষি বাণিজ্যের অমিত এক সম্ভাবনার সূচনা হয়েছে। এ ধরনের কৃষি বাণিজ্যের সম্প্রসারণের ফলে গ্রামের অনেক মানুষের কর্মের সংস্থান হয়েছে। ফলে এ ধরনের বড় কৃষি আয়োজনকে ঘিরে গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থান শহরকেন্দ্রিক অভিবাসন বা স্থানান্তর কিছুটা হলেও কমিয়ে আনতে সক্ষম হচ্ছে। এর আগেও আমরা নাচোলে রফিকুলের বারোমাসি আমের বাগানের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়টির ধারণা পেয়েছিলাম।

ড্রাগনই পাল্টে দিয়েছে সব... কৃষির অঙ্ক, বেচাকেনা, কাজের ক্ষেত্র। রঙিন এ ফল রাঙাচ্ছে অনেকের জীবন। বাগানের ছোট্ট এ ঘরটিতে কর্মীরা ব্যস্ত। এখানে চলছে গ্রেডিংয়ের কাজ। কাজ করতে করতে কর্মীরা কথা বলছিলেন আমার সঙ্গে। তারা বললেন, গ্রামে কর্মের একটা ব্যবস্থা হওয়ায় বেশ ভালো আছেন তারা।

ড্রাগন ফলের গোলাপি রং উদ্যোক্তা আবুল কালাম আজাদের হাতে এক অনন্য সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবে ধরা দিয়েছে। তবে তিনি ক্রমবিকাশমান এ ড্রাগন ফলের বাণিজ্যিক ফলনে এক অশনি সংকেতের কথা বললেন- ‘অনেকে ড্রাগন ফল চাষে টনিক নামে এক ধরনের হরমোন ব্যবহার করেন, এতে ফলের আকার বড় হয়, একটা অংশ থাকে সবুজ আর একটা অংশ গোলাপি। এটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।’ আবুল কালাম আজাদের এ তথ্য ভীতিকর। এতে ড্রাগন ফলের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ হুমকির কারণ হতে পারে। বিশ্বজুড়ে ড্রাগন ফলের বিশাল বাজার। আমরা চেষ্টা করছি দেশের উৎপাদন বাড়িয়ে সেই বাজারে প্রবেশ করতে। এ সময়টাতে কৃষির শুদ্ধচর্চা নিশ্চিত করা জরুরি। এ বিষয়ে সরকারের তদারকি যেমন প্রয়োজন, প্রয়োজন আমাদের সবার সচেতন হওয়া।

কৃষিতে আবুল কালাম আজাদের মতো উদ্যোক্তাদের যুক্ত হওয়া আশার আলো ছড়ায়। কেননা তাদের হাতে কৃষি কৌশল সমৃদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। উৎপাদনের তাগিদেই তারা তাদের ভিন্ন চোখে খুঁজে নেয় নতুন কিছু। তাদের উদ্ভাবিত ‘কৃষি কৌশলে’ সাধারণ কৃষকরাও লাভবান হন।

প্রিয় পাঠক, আবুল কালাম আজাদের ড্রাগন ফলের বাগান নিয়ে লেখা এখানেই শেষ নয়। আগামী লেখায় তার বাগানের রাতের দৃশ্য নিয়ে বলব- এমন প্রত্যাশায় আজকে শেষ করছি।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর