শনিবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

চিত্রার বুকে প্রতিমা বিসর্জন এখন কেবলই স্মৃতি

তপন কুমার ঘোষ

চিত্রার বুকে প্রতিমা বিসর্জন এখন কেবলই স্মৃতি

চিত্রাপাড়ে ছোট্ট গ্রাম সুমেরু খোলা। এমনিতে শান্ত, নিরিবিলি। ঢাকে কাঠির বাড়ি পড়লে আনন্দমুখর হয়ে উঠত আমার গ্রাম। বারোয়ারি দুর্গাপূজার আয়োজন করা হতো গ্রামে। এখনো প্রতিবছর আমাদের গ্রামে পূজা হয়। পালমশায় মন্দিরে ঠাকুর গড়তেন। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে একবার সেখানে ঢুঁ মেরে আসা চাই। এর কোনো অন্যথা হবে না। আমরা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ঠাকুর তৈরি দেখতাম। পূজায় নতুন পোশাক। সে এক অন্যরকম আনন্দ। নতুন জামাকাপড় কেনা হতো বছরে একবার। ওই পূজাতেই। অল্পতেই খুশি। টানাটানির সংসার। কিন্তু মা কিছুই বুঝতে দিতেন না। দর্জির দোকানে গিয়ে জামা-কাপড়ের মাপ দিতে হতো। তখন হাফ প্যান্ট আর হাফ শার্টের যুগ। ডেলিভারির ডেটলাইন পার হয়ে যেত। কিন্তু আবুল দর্জির কোনো হেলদোল নেই। নতুন পোশাক পরে ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে পড়তাম আমরা। ঢাকিরা ঢাক বাজাতেন। ঢাকির দলে থাকত কিশোর বয়সের একটা ছেলে। হয়তো বায়না ধরেছে। তাই বাবা নিয়ে এসেছেন। ছেলেটা কাঁসর ঘণ্টা বাজিয়ে বাবাকে সঙ্গ দিত।

অসুর মূর্তি কতটা ভয়াল হয়েছে সেটা নিয়ে আমাদের মধ্যে চলত আলোচনা। অশুভ শক্তির প্রতীক মহিষাসুর। মহিষাসুরের বুকে গাঁথা দুর্গার ত্রিশূল। দেবী দুর্গার কাছে মহাপরাক্রমশালী অসুর কুপোকাত হয়েছে, এ দৃশ্য ছিল স্বস্তির। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির বিজয়ের জয়গান গাওয়া হয় দুর্গাপূজায়। এসব কাহিনি বড়দের মুখে শোনা। তখন ক্লাস এইট বা নাইনে পড়ি। সত্যি বলতে কি, মাটির দুর্গার চেয়ে রক্ত-মাংসে গড়া দুর্গারা নজর কাড়ত বেশি ওই উঠতি বয়সে। নড়াইলের ঐতিহ্যবাহী রূপগঞ্জ বাঁধাঘাটে ঘটা করে পূজা হতো। শহরের পূজা দেখতে আমরা ফি-বছর ওখানে যেতাম। গ্রামে বৈদ্যুতিক আলো ছিল না সে সময়। রাতের বেলায় হ্যাজাক লাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠত পূজা প্রাঙ্গণ। সন্ধ্যায় আরতি প্রতিযোগিতা দেখতে ভক্তদের প্রচণ্ড ভিড় হতো। তখন গ্রামের পূজায় জৌলুস কম ছিল। কিন্তু আনন্দের কমতি ছিল না।

দশমীর বিকালে আশপাশের গ্রামের সব প্রতিমা এনে জড়ো করা হতো নদীর ঘাটে। জমে উঠত ঢাকের লড়াই। জোড়া নৌকা বেঁধে চিত্রার বুকে ভেসে বেড়াত অসংখ্য প্রতিমার নৌকা। ঢাকির ঢাকে তখন বোল, ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন।’ রাত কিছুটা গভীর হলে প্রতিমা বিসর্জন শুরু হতো। মধ্যরাত অবধি চলত বিসর্জনের পালা। মা দুর্গা ফিরতেন শৈলশিখর কৈলাসে, নিজ গৃহে। প্রতিমা নিরঞ্জনের পর নদীর পবিত্র জল সবার মাথায় ছিটিয়ে দেওয়া হতো। ‘আসছে বছর আবার হবে’- ধ্বনি দিয়ে আমাদের ঘরে ফেরা। নির্জন মণ্ডপের এক কোণে একলা জেগে থাকা মাটির প্রদীপ বিষণ্নতা ছড়াত।

ভাসানের দিন সিঙ্গাশোলপুর বাজারে বিরাট গ্রামীণ মেলা বসত। মেলায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয়। বাবার কড়া নির্দেশ, মেলায় গিয়ে উন্মুক্ত দোকান থেকে কিছু কিনে খাওয়া যাবে না। মেলায় আমাদের আকর্ষণ ছিল সদ্য ভাজা পাপড় আর মুচমুচে গরম জিলাপি। জিলাপি থেকে রস ঝরে পড়ছে।

তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল না। বিসর্জনের পরদিন বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিজয়ার প্রণাম করতে দলবেঁধে আমরা বেরিয়ে পড়তাম। নারকেলের নাড়ু আর গুড়ের বাতাসার কৌটা নিয়ে জেঠিমা-কাকিমারা অপেক্ষা করতেন। মাথায় ধান-দূর্বা দিয়ে অন্তর থেকে আশীর্বাদ করতেন, ‘দীর্ঘজীবী হও। মানুষের মতো মানুষ হও। জীবনে অনেক বড় হয়ে মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল কর।’ বড়রা একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। বাবা বলতেন, ‘এদিন সব বিবাদ-বিসম্বাদ ভুলে যেতে হয়। সম্পর্ক ভালো করার দিন এটি।’

কালে কালে অনেক কিছুই বদলে গেছে। সেই নিখাদ আনন্দের দিনগুলো হারিয়ে গেছে। চিত্রা নদী আজও বহমান। নদীতে আগের মতোই নিয়মিত জোয়ার-ভাটা হয়। বিসর্জনের দিন প্রতিমার জোড়া নৌকা এখন আর চিত্রার বুকে ভেসে বেড়ায় না। নদীর ঘাটে, পুকুর বা জলাশয়ে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।

পূজাকেন্দ্রিক সেই মেলা এখন আর তেমন জমে ওঠে না। নাড়ুর কৌটা নিয়ে জেঠিমা-কাকিমারা আর অপেক্ষা করেন না। বিজয়ার শুভেচ্ছা ও প্রণাম জানিয়ে লেখা চিঠিতে ডাকবাক্স আর ভরে ওঠে না। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে শুভেচ্ছা বিনিময় হয় অনলাইনে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয় কদাচিৎ। এটা সুলক্ষণ নয়। দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে? এখন বড় বাজেটের পূজা হয়। পূজায় জাঁকজমক আছে, আড়ম্বর আছে। কিন্তু তারপরও কেমন যেন প্রাণহীন। অন্তরের ছোঁয়া নেই। সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটে একাকিত্বের অতল গহ্বরে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছি আমরা। এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এ সমস্যা তামাম দুনিয়ার।

লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড

সর্বশেষ খবর