রবিবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আলেকজান্ডারের শূন্যহাত, অশোকের পরিবর্তন, অসহায় প্যালেস্টাইন

নঈম নিজাম

আলেকজান্ডারের শূন্যহাত, অশোকের পরিবর্তন, অসহায় প্যালেস্টাইন

বিশ্ব আজ হানাহানি-সংঘাতে আক্রান্ত। শান্তি শব্দটি মুছে যাচ্ছে ডিকশনারি থেকে। প্যালেস্টাইনের মুসলমানরা নিষ্ঠুর বর্বরতার শিকার হচ্ছে। রেহাই মিলছে না নারী ও শিশুদের। যুদ্ধবাজ বিশ্বকে কে বোঝাবে মানবতার চেয়ে বড় কিছু নেই। যুদ্ধের শেষ পরিণতি ভালো হয় না। খালি হাত নিয়েই দুনিয়ায় আসে মানুষ। শেষ বিদায়ে যেতে হয় একইভাবে। চাইলেও পৃথিবীর সবচেয়ে দাপুটে মানুষ সঙ্গে কিছু নিতে পারে না। একাকী আসতে হয়। যাওয়াটাও হয় সাদা কাফনে ঢাকা। প্রকৃতি এভাবে দুনিয়া তৈরি করেছে। প্রকৃতির নিয়মের বাইরে কারও যাওয়ার সুযোগ নেই। মিসরের ফেরাউনদের বেঁচে থাকার বড় আকুতি ছিল। বিশ্বের বিস্ময় নিয়ে নিজেদের মমি তৈরি করেছিলেন সেই যুগে। মমির সঙ্গে রাখতেন সম্পদ। ভাবতেন মৃত্যুর পর আবার বেঁচে উঠবেন। তখন সেই সম্পদ কাজে লাগবে। প্রকৃতির নিয়মে একবার চলে গেলে আর কেউ ফিরে আসে না, কাজে লাগে না দুনিয়ার সম্পদের ভান্ডার। মৃত্যুর আগে সম্রাট আলেকজান্ডার বুঝলেন সবকিছুই মূল্যহীন। যশ, খ্যাতি, অর্থবিত্ত, তলোয়ারের শক্তি কোনো কাজে লাগছে না। বড় আক্ষেপ নিয়ে পৃথিবীজয়ী শাসক আলেকজান্ডার বিদায় নিলেন। যাওয়ার আগে অসহায়ের মতো তিনটি ইচ্ছার কথা বলেছিলেন মৃত্যুর পর বাস্তবায়ন করতে।

যখন বুঝলেন আর থাকবেন না, কোনো হেকিম, কবিরাজ, সেরা চিকিৎসক বাঁচাতে পারবেন না তখন তিনি বললেন, পৃথিবীতে অনেক কিছু করেছি। এখন আর কোনো চাওয়াপাওয়া নেই। মৃত্যুর পর তিনটি ইচ্ছা যে কোনোভাবে পালনের নির্দেশ দেন তিনি। সেনাপতিরা অবিশ্বাস্য চোখ নিয়ে তাকালেন। তারাও ১০ দিন আগে ভাবতে পারেননি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক এভাবে অসহায় হয়ে উঠবেন। চারপাশের মানুষগুলো বললেন, হে দুনিয়ার বীর, আপনার যে কোনো আদেশ শিরোধার্য থাকবে। আপনি নির্দেশ দিলে পৃথিবীকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেব। আলেকজান্ডার বললেন, আর কোনো যুদ্ধের নির্দেশ নয়। আমার মৃত্যুর পর শেষকৃত্যে মরদেহের কফিন বহন করবেন চিকিৎসকরা। আর কফিন যাওয়ার পথের দুই ধারে ছিটিয়ে দিতে হবে টাকাপয়সা, ধনরত্ন, স্বর্ণ-হীরার টুকরো। আমার দুই হাত কফিনের দুই পাশে ঝুলিয়ে দেবে। অনুষ্ঠানে আগত দুনিয়ার রাজা-বাদশাহ, ধনী-গরিব সবাই দেখবে কফিনের দুই পাশে ঝুলছে আমার শূন্যহাত।

এমন অদ্ভুত নির্দেশ নিয়ে চিন্তিত হলেন আলেকজান্ডারের সেনাপতি, মন্ত্রিপরিষদ, আত্মীয়-পরিজন। সবাই অবাক হলেন। বুঝতে পারলেন না কেন এমন নির্দেশনা। জীবিত আলেকজান্ডারের সামনে অদ্ভুত নির্দেশের কারণ জানার সাহসও কেউ দেখালেন না। সবাই নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। একজন সেনাপতি ভয়ে ভয়ে বললেন, সবকিছু পালন অবশ্যই করব আমরা। তবু একবার কি বলবেন বিশ্বজয়ী যোদ্ধার কেন এমন চাওয়া? পিনপতন নীরবতা চারপাশে। আলেকজান্ডার সবার দিকে তাকালেন। তারপর ব্যাখ্যা দিলেন। তিনি বললেন, অ্যাপ্রোন পরে থাকা দুনিয়ার চিকিৎসকরা যখন কফিন বহন করবেন তখন মানুষ বুঝবে চলে যাওয়ার সময় তাদের করার কিছু নেই। ডাক যখন আসবে তখন সবাইকে চলে যেতে হবে দুনিয়া ছেড়ে। সবচেয়ে শক্তিশালী, বিত্তশালী, দুনিয়াজয়ী সম্রাটকে এই চিকিৎকরা বাঁচিয়ে রাখতে পারেননি। তাদের কোনো ক্ষমতাই নেই কাউকে রক্ষা করার। বিশ্ব বুঝবে চিকিৎসকদের ক্ষমতাও নির্ধারিত। সম্রাট আলেকজান্ডারের জীবন দেওয়ার ক্ষমতা নেই বলেই তারা কফিন বহন করছেন। দুনিয়ার সম্রাট সামান্য অসুখের কাছে পরাজিত হয়েছেন।

ধনরত্ন ছিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশের কারণ এরপর তিনি ব্যাখ্যা দিলেন। বললেন, আমার তরবারির সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা পৃথিবীর কারও ছিল না। আমি হেঁটে গেলে দেশ জয় হতো। অনেক সময় নাম শুনেই অনেক ক্ষমতাবান রাজা পালিয়ে যেতেন ক্ষমতা ছেড়ে। দেশের পর দেশ জয় করেছি। দুনিয়ার সব সম্পদ জমা করেছি। ধনরত্ন, হীরা-জহরতের অভাব নেই। এত অসহায়ভাবে মৃত্যুর কথা কল্পনাও করিনি। আজ অসুস্থতার সময় কোনো সম্পদ কাজে লাগল না। সব সম্পদের বিনিময়ে কেউ আমাকে রক্ষা করতে পারল না। কফিনযাত্রার সময় যুদ্ধ, হানাহানি করে অর্জিত সম্পদ রাস্তার ধুলোয় পড়ে আছে। কোনো সম্পদ ভোগ করতে পারলাম না। কোনো হীরা-জহরত, টাকাপয়সা কাজে লাগল না। দুই দিনের দুনিয়ায় অর্জিত সম্পদ যাওয়ার সময় মূল্যহীন। অথচ এ সম্পদের জন্য অনেক যুদ্ধ করেছি। লড়াই করেছি। আজ আমার সব সম্পদ মূল্যহীন। কোনো কিছুই এখন আমার নয়। সবকিছু পড়ে আছে রাস্তায়। আমি চলে যাচ্ছি। সঙ্গে কিছুই যাচ্ছে না। রাস্তার ধুলোয় পড়ে আছে সম্পদের পাহাড়। দুনিয়ায় লড়াই করে অর্জিত সম্পদ চিরবিদায়ের সময় সঙ্গে যায় না। মানুষ সম্পদের জন্য লড়াইয়ে এ সাধারণ বিষয়টিও বোঝে না।

সর্বশেষ তিনি ব্যাখ্যা দিলেন কফিনের দুই পাশে হাত ঝুলিয়ে রাখার। গভীর বেদনা নিয়ে আলেকজান্ডার বললেন, কফিনের দুই পাশে আমার শূন্যহাত ঝুলবে। মানুষ দেখবে মায়ের গর্ভ থেকে শূন্যহাতে দুনিয়াতে এসেছিলাম। দুই হাত দিয়ে তরবারি ধরে সারা দুনিয়ার ক্ষমতার মালিক হলাম। একটা নির্দেশে সারা পৃথিবী তছনছ হয়ে যেত। আমি হুংকার দিয়ে হেঁটে গেলে দেশ জয় হয়। যুদ্ধে জড়ালে দুই হাতের তরবারির আঘাতে জমে যায় লাশের পাহাড়। সামান্য অঙ্গুলিহেলনে সেনারা উপহার দেয় একটার পর একটা দেশ। পৃথিবীতে আমার চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর কেউ নেই। যাওয়ার সময় কোনো ক্ষমতাই কাজে লাগল না। কোনো কিছুর বিনিময়ে রক্ষা করতে পারলাম না নিজেকে। রাজ পরিবারে জন্ম নিলেও মায়ের গর্ভ থেকে এসেছিলাম পোশাকবিহীন শূন্যহাতে। পৃথিবীর সব অর্থ, ক্ষমতার মালিক হয়েও ফিরে যাচ্ছি শূন্যহাতে। হাতের মুঠোয় তরবারি নেই, অর্থসম্পদও নেই। কফিনের দুই পাশে ঝুলছে দুটি শূন্যহাত। এই হাতে আর কোনো ক্ষমতা নেই। অর্থসম্পদ নেই। চাওয়াপাওয়ার কিছু নেই। আর কোনো দিন এ দুই হাতে তরবারি উঠবে না। মানুষ বুঝবে, শূন্যহাতে সবাই আসে, আবার চলেও যায় খালি হাত নিয়ে।

আলেকজান্ডারের কথায় উপস্থিত অনেকের দুই চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছিল। ক্ষমতার বণ্টনসহ বিভিন্ন বিষয়ে আরও কিছু নির্দেশনা দিলেন সম্রাট। সবাই সেই নির্দেশগুলো লিখে নিচ্ছিলেন। অবাক চোখে ভাবছিলেন মাত্র ৩০ বছর বয়সে অর্ধেক পৃথিবী জয় করেছিলেন এই মানুষটি। কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। আজ তাঁকে চলে যেতে হচ্ছে। কেউ রক্ষা করতে পারছে না। ভারত অভিযানের সময় একজন জ্যোতিষী তাঁকে হুঁশিয়ার করেছিলেন। কেউ একজন বলেছিলেন ভারতীয়রা ভালো হাত দেখতে পারে। আলেকজান্ডার হাসলেন। বললেন, হাত দেখে সব বলে দিতে পারে? সবাই আবার তা বিশ্বাসও করে? কি অদ্ভুত! এরপর তিনি নিজের হাত এগিয়ে দিলেন। বললেন, আমার ভবিষ্যৎ বলো। জ্যোতিষীর চোখে ভয়ের আভাস নেই। পরোয়া নেই মৃত্যুর। অপ্রিয় কঠিন সত্য তুলে ধরলেন। হাত দেখে বললেন, হে দুনিয়ার সম্রাট, সারা পৃথিবীর অধিপতি আপনি এখান থেকে যাচ্ছেন ব্যাবিলন। হে মহাবীর, ব্যাবিলন হবে আপনার শেষ গন্তব্য। তারপর আপনাকে থামতে হবে। আলেকজান্ডার হাসলেন। বললেন, অর্ধেক দুনিয়ার অধিপতিকে তুমি থামতে বলছ? তোমার সাহস দেখে বিস্মিত হচ্ছি।

আলেকজান্ডার কোনো কিছু বিশ্বাস করলেন না। তাঁর সহচররাও হাসলেন। তাঁরা ভাবলেন, দুনিয়ার বীরকে কে আটকে রাখবে? যাঁর তরবারি চলে সূর্যের আলোর গতিতে, তাঁকে কে থামাবে? টানা অভিযান শেষ করে বাগদাদে গেলেন আলেকজান্ডার। তাঁকে দেখে উৎসবে ভেঙে পড়ল বাগদাদ শহর। রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে মানুষ অভিবাদন জানাল। আয়োজনের শেষ নেই। এক বন্ধুর আমন্ত্রণে রাতে গেলেন দাওয়াত খেতে। মহাবীরের সম্মানে বিশ্বের সব দেশ থেকে সংগ্রহ করা হয় সুরা। দুনিয়ার সেরা সুন্দরীদের জড়ো করা হয় নাচগানের জন্য। দুনিয়ার সব সুস্বাদু খাবারের শেষ ছিল না। তালিকায় ছিল সম্রাট যত দেশ জয় করেছেন তত দেশের খাবার। বিশাল, বর্ণাঢ্য আয়োজনের সবকিছু আলেকজান্ডারকে বিমোহিত করল। তিনি আনন্দিত হলেন। ধন্যবাদ জানালেন বন্ধুকে। টানা যুদ্ধে শরীর ছিল ক্লান্ত। মন একটা উৎসবের দিকে ছিল। সেই উৎসব পেয়ে শরীর আবার চাঙা হলো। তিনি মুগ্ধ চোখে উৎসবে অংশ নিয়ে ব্যাপক মদপান করলেন। আগত অন্য অতিথিরা বসে থাকলেন না। সবাই শরিক হলো উৎসব আনন্দে। আয়োজককে সবাই ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, এমন উৎসব দুনিয়ায় কেউ কোনো দিন দেখেনি। কোনো দিন দেখবেও না।

এ উৎসবের সময়টা খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সাল। মে মাসের আবহাওয়া ছিল অন্যরকম। আলেকজান্ডারের বয়স মাত্র ৩৩ বছর। তারুণ্যের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস নিয়ে বিশ্বজয়ী সিদ্ধান্ত নিলেন এ উৎসব টানা চলবে। আগামী কিছুদিন তিনি বিশ্রামে থাকবেন। সবাইকে নির্দেশ দিলেন আনন্দ করতে। সেনাপতি থেকে সিপাহি সবাই উচ্ছ্বাসে মাতলেন। অনেক দিনের যুদ্ধে তারাও কিছুটা ক্লান্ত ছিলেন। শরীর ও মনের ক্লান্তি দূর করতে সবাই আনন্দে মাতোয়ারা হলেন। কেউ তখনো কল্পনা করেননি এ উৎসবই সম্রাটের জীবনের শেষ। চারদিকের পরিবেশে আনন্দিত সম্রাট ব্যাপক মদপান করেন। অতিরিক্ত মদপানের কারণে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। উৎসব থেমে গেল। টানা তিন দিন ভয়াবহ জ্বরে পুড়লেন আলেকজান্ডার। অতিরিক্ত জ্বরে জ্ঞান হারাচ্ছিলেন। দুনিয়ার সব ডাক্তার-কবিরাজ জড়ো করা হলো। চিকিৎসা চলল টানা ১০ দিন। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন দুনিয়ার বাদশাহ। কেউ বুঝতে পারছিলেন না এ লড়াইয়ে কে জয়ী হবেন। শেষ মুহূর্তে দুনিয়ার সম্রাট বুঝলেন আর থাকবেন না। চলে যেতে হবে সব ছেড়ে। পৃথিবীর কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি আর কাজে লাগবে না। যে আলেকজান্ডারের সামনে দাঁড়ানোর সাহস দুনিয়ার কোনো যোদ্ধার ছিল না, সামান্য জ্বর তাঁকে কাবু করল। শেষ পর্যন্ত এ জ্বরের কাছেই পরাজিত হয়ে বিদায় নিলেন সম্রাট। শেষ মুহূর্তে প্রিয়জনদের দিলেন সেই ঐতিহাসিক তিন নির্দেশ; যা যুদ্ধবাজ দুনিয়ায় উপমা হয়ে আছে।

মহাবীর আলেকজান্ডারকে বলা হতো দেবতা জিউসের বংশধর। তাঁর জন্মের দিন গ্রিসের দেবী আর্টেমিসের মন্দির পুড়ে যায়। মিথ আছে, দেবী আর্টেমিস এসেছিলেন আলেকজান্ডারের জন্মের সাক্ষী হতে। গ্রিসের ম্যাডিসনের রাজা ছিলেন আলেকজান্ডারের বাবা দ্বিতীয় ফিলিপ। মাত্র ২০ বছর বয়সে বাবার রাজত্বের দায়িত্ব নেন আলেকজান্ডার। বাবার আশীর্বাদ ছিল তাঁর প্রতি। মাত্র ১০ বছরের শাসনে তিনি নিজের সাম্রাজ্যের সীমানা অ্যাড্রিয়াটিক সাগর থেকে সিন্ধু নদ পর্যন্ত বিস্তার ঘটান। এত দ্রুত চলে যাবেন, ভাবেননি। মৃত্যুর আগে দেখলেন, দেবতারা তাঁকে নিয়ে যেতে এসেছেন। বুঝলেন দুনিয়ায় আর থাকতে পারবেন না। কষ্ট পেলেন, হায় দুই দিনের দুনিয়ায় এত লড়াই-যুদ্ধ কেন করেছিলেন? মিথ আছে, দেবতাদের কাছ থেকে শেষ বিদায়ের আগে পাওয়া বাণী থেকেই তিনি তিনটি নির্দেশের কথা বলেছিলেন মানবকুলকে। এ নির্দেশের সারমর্ম হলো, খালি হাতে দুনিয়ায় এসেছ। যেতে হবে খালি হাতেই।

সম্রাট আলেকজান্ডারের সঙ্গে মিল রয়েছে রাজা অশোকের। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর ভারতবর্ষে অশোকের যাত্রা শুরু। যুদ্ধবিগ্রহ ও শেষ জীবনের উপলব্ধিতে আলেকজান্ডারের মতোই ছিলেন রাজা অশোক। প্রথম জীবনটা অশোককে কাটাতে হয়েছিল পারিবারিক ক্ষমতার লড়াইয়ে। বাবা তাঁর অন্য ছেলেকে ক্ষমতায় বসানোর পক্ষে ছিলেন। দাদার একটা প্রশ্রয় ছিল অশোকের প্রতি। বাবা অশোককে পাঠাতেন অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনে। নিষ্ঠুরতা নিয়ে অশোক সবকিছু তছনছ করে দিতেন। ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার কারণে সবাই তাঁকে ভয় পেত। অনেক সময় তাঁর নাম শুনেই থেমে যেত গৃহযুদ্ধ। বিদ্রোহীরা পালিয়ে যেত। অশোকের জীবনের শুরুটা ছিল যুদ্ধবাজিতে ভরা। ক্ষমতা পেয়ে অশোক নিষ্ঠুর শাসকে পরিণত হন। দেশ জয় নেশায় পরিণত হয়। তরবারি চলত বাতাসের গতিতে। এই যুদ্ধবাজ বদলে যান শেষ জীবনে। কলিঙ্গ যুদ্ধে লাখো মানুষের প্রাণহানি-রক্তপাত-বীভৎসতা তাঁকে বদলে দেয়।

অশোককে নিয়ে মিথ ছিল, তিনি যেদিকে হেঁটে যেতেন লাশের পাহাড় জমত। জেদি নিষ্ঠুর রুক্ষ অশোককে বাবার চেয়ে বেশি পছন্দ করতেন দাদা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। অন্য পুত্রকে ক্ষমতা দিতে চেয়েছিলেন বাবা বিন্দুসার। মন্ত্রীরা বুঝতেন দক্ষতায় এগিয়ে যুদ্ধবাজ অশোক। তক্ষশীলার বিদ্রোহ দমন দিয়ে অশোকের শুরু। তারপর তাঁকে পাঠানো হয় কলিঙ্গ রাজ্যে নির্বাসনে। নতুন জীবনে রাজকুমারী কৌরভীর প্রেমে পড়েন। কৌরভীকে বলা হতো রূপের দেবী। প্রথম দেখায় দুজন মুগ্ধ হন। কেউ কারও পরিচয় না জেনে বিয়ে করেন দুজনে। নির্বাসন শেষ হলে উজাইন নগরীর বিদ্রোহ দমনে ডেকে পাঠানো হয় অশোককে। এখানেও অশোক সফল হন। বাবার মৃত্যুর পর ভাইদের মধ্যে শুরু হয় ক্ষমতার বিরোধ। একমাত্র আপন ভাইকে বাদ দিয়ে বাকি সব ভাইকে হত্যা করেন অশোক। এরপর দায়িত্ব নেন রাজত্বের। মৌর্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট হিসেবে টানা আট বছর সাম্রাজ্য পরিচালনায় ভয়াবহ শাসকে পরিণত হন। ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য অশোক সৃষ্টি করেন। বার্মা (মিয়ানমার) থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত ছিল পরিধি।

কলিঙ্গ দখল করতে গিয়ে গণহত্যায় শামিল হয় সম্রাট অশোকের বাহিনী। লাখো মানুষকে হত্যা ছাড়াও পুড়িয়ে দেওয়া হয় পুরো অঞ্চল। যুদ্ধ শেষে সবকিছু ঘুরে দেখতে বের হন অশোক। চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন শুধু আগুনের কুণ্ডলী ও মানুষের লাশের সারি। রক্তের বন্যা, পোড়া আগুনের ছাই অশোককে ভাবিয়ে তোলে। তিনি ঘুমাতে পারছিলেন না। মৃত্যুবিভীষিকায় বিষাদগ্রস্ত হয়ে ওঠেন। এ সময় স্বামীর পাশে দাঁড়ান স্ত্রী দেবী। এই নারীর সঙ্গে পরিচয়, একবার অসুস্থ হওয়ার পর তাঁর সেবা করেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। দেবী ছিলেন দেখাশোনার মূল দায়িত্বে। নতুন করে বিষাদগ্রস্ত সম্রাটের বিছানার পাশে বসে তাঁর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অহিংস নীতির পক্ষে অশোককে আগ্রহী করেন দেবী। তারপর বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেন। নিজেকে বদলে ফেলেন সম্রাট অশোক। নিষ্ঠুর শাসন পরিহার করে ধর্মশাসকে রূপান্তরিত হন। শুরু করেন বৌদ্ধধর্মের প্রচার। তাঁর পুত্রকেও কাজে লাগান ধর্ম প্রচারে। রাজা অশোক ঢাকার বিক্রমপুরে এসেছিলেন। এখানে তিনি তাঁর দাদার কাছ থেকে প্রাপ্ত গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছিলেন। পরে এখানে একটি বৌদ্ধ মন্দির স্থাপন করেন। এ নিয়ে অতীশ দীপঙ্কর বিস্তারিত লিখে জমা দেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে। অশোক শেষ জীবনের শাসনে প্রাণী হত্যা আইন করে নিষিদ্ধ করেন। নিরামিষ ভোজ চালু করেন।

আলেকজান্ডার ও রাজা অশোক শেষ জীবনে বদল হলেও আধুনিক যুগের ইসরায়েলি শাসকদের কোনো পরিবর্তন নেই। প্যালেস্টাইন কাঁদছে। বিশ্বমোড়লরা অবস্থান নিয়েছে ইসরায়েলি নিষ্ঠুরতার পাশে। ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা দুনিয়ার অনেক ক্ষতি করেছে। এখন যোগ হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতা। বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলমানদের পবিত্র এলাকা অবৈধভাবে দখল নিয়েছে ইহুদিরা। এখন প্যালেস্টাইনিরা নিজ দেশে পরবাসী। হামাসের হামলার অজুহাতে আজ গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে হাসপাতাল। রেডক্রসের অ্যাম্বুলেন্স রেহাই পায়নি অসহায় রোগী বহন করে হাসপাতালে যাওয়ার পথে। নারী-শিশুদের কান্না আজ দুনিয়াকে উতলা করলেও বিশ্বমোড়লদের ঘুম ভাঙছে না। প্যালেস্টাইনে নিষ্ঠুর হত্যালীলার শেষ নেই। মানবতার ফেরিওয়ালারা এখন ইসরায়েলের বর্বরতার পক্ষ নিয়েছে। তারা যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তির পথ তৈরি করতে পারত। কেউ তা করছে না। বরং উসকানি দিচ্ছে বিশ্বকে আরও অস্থিরতার দিকে নেওয়ার।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর