রবিবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাজনীতির জীবন্ত কিংবদন্তি ও ইতিহাসের কণ্ঠস্বর

আবুল খায়ের

রাজনীতির জীবন্ত কিংবদন্তি ও ইতিহাসের কণ্ঠস্বর

ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের মহানায়ক, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট সংক্ষেপে বিএলএফ তথা মুজিব বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক সর্বোপরি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য জননেতা তোফায়েল আহমেদের ৮০তম শুভ জন্মবার্ষিকী ও ৮১তম শুভ জন্মদিনে প্রাণঢালা অভিনন্দন ও সংগ্রামী শুভেচ্ছা। নির্ভীক এ রাজনীতিক দেশসেবা তথা রাজনীতিকে জীবনে চূড়ান্ত প্রাধান্য দিয়েছেন। দেশবাসীর অকুণ্ঠ ভালোবাসা এবং অপার দেশপ্রেমকে পাথেয় করেই তিনি এগিয়েছেন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পর স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন ও সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনে সংগ্রামী নেতা তোফায়েল আহমেদের ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

১৯৪৩ সালের ২২ অক্টোবর ভোলা জেলার কোড়ালিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আজহার আলী ও মাতা ফাতেমা খানম। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ও অনলবর্ষী বক্তা তোফায়েল আহমেদ ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত ডাকসুর ভিপি থাকাকালে চারটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত ৬ দফা কর্মসূচি হুবহু ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে ’৬৯-এর মহান গণ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন। ’৬৬-এর ৮ মে থেকে ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৩ মাস কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ‘আগরতলা মামলা’য় আটক সব রাজবন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তিদানে তাঁর নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সারা বাংলায় তৃণমূল পর্যন্ত তুমুল গণ আন্দোলন গড়ে তোলে। ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ সব রাজবন্দিকে মুক্তিদানে স্বৈরশাসককে বাধ্য করেন এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত গণসংবর্ধনা সভার সভাপতি হিসেবে ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে কৃতজ্ঞ জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে জাতির জনককে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আর ’৬৯-এর ২৫ মার্চের মধ্যে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে পদত্যাগে বাধ্য করে গৌরবের যে ইতিহাস সৃষ্টি করেন তা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সেল। ’৬৯-এ তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ’৭০-এর ২ জুন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব ছাত্র ও গণ আন্দোলনে সফল নেতৃত্ব প্রদান করায় তিনি দেশবাসীর অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও আস্থা অর্জন করেন। আবাসিক হল ও ডাকসুর ভিপি থাকাকালে তিনি জাতির জনকের একান্ত সাহচর্যে আসেন। ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে ভোলার দৌলত খাঁ-তজুমদ্দিন-মনপুরা আসন থেকে মাত্র ২৭ বছর বয়সে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের তিনি অন্যতম সংগঠক এবং ‘মুজিব বাহিনী’র অঞ্চলভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত চার প্রধানের একজন। বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া ও পাবনা সমন্বয়ে গঠিত মুজিব বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১০ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ ও ১৭ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের তিনি অন্যতম সংগঠক এবং ’৭২-এর ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত ও বলবৎকৃত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সংবিধানে স্বাক্ষর করেন। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের পর ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন; দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের লক্ষ্যে ১২ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং ১৪ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব নিয়োগ করেন। ’৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। ১৯৭৩-এ নিজ জেলা ভোলা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ’৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ঘোষণার পর প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় ‘রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী’ নিযুক্ত হন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরপরই তাঁকে প্রথমে গৃহবন্দি ও পরে পুলিশ কন্ট্রোল রুম এবং রেডিও অফিসে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দি অবস্থায় তাঁকে ফাঁসির আসামির কনডেম সেলে রাখা হয়। পরে কুষ্টিয়া কারাগারে প্রেরণ করা হয়। দীর্ঘ ৩৩ মাস তিনি কারান্তরালে ছিলেন। ’৭৮-এ কুষ্টিয়া কারাগারে অন্তরিন থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। জাতীয় রাজনীতির চরম দুঃসময়ে দীর্ঘ ১৪ বছর তিনি সফলভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়ার আমলে তাঁর আটকাদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট করা হয়; হাই কোর্ট তাঁকে জামিন প্রদান করলেও স্বৈরশাসক তাঁকে মুক্তি দেয়নি। তখন সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে দীর্ঘ ৩৩ মাসের বন্দিদশা থেকে তিনি মুক্তিলাভ করেন। স্বৈরাচারী জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনামলে বিভিন্ন মেয়াদে চারবার তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ’৮২-এর ২৪ জানুয়ারি সামরিক শাসন জারির পর ২৬ জানুয়ারি সাভারে গ্রেফতার করা হয়। ’৮৩-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করে প্রথমে সামরিক গোয়েন্দা দফতরে, পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, তারপর সিলেট কারাগারে ফাঁসির আসামির কনডেম সেলে রাখা হয়। ’৮৪-তে ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও পরে কুমিল্লা কারাগারে আটক রাখা হয়। ’৮৭-তে ভোলায় গ্রেফতার করে বরিশাল কারাগারে আটক রাখা হয়। ’৯৫-৯৬ এ ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’-এর অধীনে নির্বাচনের দাবিতে যে আন্দোলন হয়, তাতে খালেদা জিয়ার শাসনামলে তাঁকে গ্রেফতার করে রাজশাহী কারাগারে রাখা হয়। ২০০২-এ খালেদা-নিজামী জোট সরকারের শাসনামলে সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার পর বিমানবন্দর থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে প্রথমে ক্যান্টনমেন্ট থানায় পরে কাশিমপুর কারাগারে ফাঁসির আসামির কনডেম সেলে ১২ দিন আটক রেখে সেখান থেকে কুষ্টিয়া কারাগারে পাঠানো হয়। রাজনৈতিক জীবনে সর্বমোট সাতবার তিনি দেশের বিভিন্ন কারাগারে- ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, কুমিল্লা ও সিলেট অন্তরিন ছিলেন। এর মধ্যে সর্বমোট তিনবার তাঁকে ফাঁসির আসামির কনডেম সেলে রাখা হয়। ’৭০-এ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ (পরে বাংলাদেশ গণপরিষদ), ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮-এর সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সর্বমোট আটবার তিনি এমপি নির্বাচিত হন। ’৯১ ও ’৯৬-এর নির্বাচনে ভোলা-১ ও ভোলা-২ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিন জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে ’৯১-এর জাতীয় সংসদে ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’ পুনঃপ্রবর্তনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ’৯২-তে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন এবং দীর্ঘ ১৮ বছর এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ’৯৬-এ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের গণরায়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকারে’ তিনি শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

২০০১-এর ১ অক্টোবরের নির্বাচনে চারদলীয় জোটের ষাড়যন্ত্রিক কর্মকাণ্ডে তাঁর অনুকূলে প্রাপ্ত নির্বাচনি রায় ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এ নির্বাচনের পর দেশব্যাপী খালেদা-নিজামীর সরকার সংখ্যালঘু জনসাধারণসহ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার-নির্যাতন করে। বিশেষ করে ভোলায় এ নির্যাতনের মাত্রা ছিল ভয়াবহ! এর বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হন এবং চারদলীয় জোট ও ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিরোধী আন্দোলনে গুরুদায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭-এ এক-এগারোর পরের দুঃসময়ে তাঁকে স্ত্রী-কন্যাসহ মিথ্যা মামলার আসামি করা হয়। কিন্তু তবু তিনি অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার না করে দলের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমানের (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) পাশে থেকেছেন। সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘জীবন দেব, তবু বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেইমানি করব না।’ ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভোলা-২ আসন থেকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে জাতীয় সংসদে শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০-এ তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন।

প্রায় তেষট্টি বছরের রাজনৈতিক জীবনে হামলা-মামলা ও কারা নির্যাতন ভোগ করা সত্ত্বেও একই আদর্শে ও দলে ধারাবাহিকভাবে স্বীয় অবস্থান সমুন্নত রেখে ‘রাজনৈতিক ইন্টিগ্রিটি’ বজায় রাখার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। অনাগত দিনে স্বাধীন বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদ দেশের চরম দুঃসময়ের কালপর্বে সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে দুঃসাহসের প্রতীক। আমরা দেশবরেণ্য এ সংগ্রামী নেতার নিরোগ ও দীর্ঘ জীবন কামনা করি।

লেখক : গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

[email protected]

সর্বশেষ খবর