রবিবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আলসেমির অভিশাপে ধুঁকছে মুসলিম বিশ্ব

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

আলসেমির অভিশাপে ধুঁকছে মুসলিম বিশ্ব

একটা সময় ছিল পৃথিবীর উত্থানপতনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মুসলিম জাতি। মুসলমানরা যেখানে গেছে সেখানেই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। জ্ঞানবিজ্ঞানের জয়ধ্বনি উঠেছে। আজও ওয়াজের মাঠগুলোয় আমরা মুসলিম বিজ্ঞানীদের কীর্তিগাথা আলোচনা করি। কিন্তু ৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে মুসলমানরা জ্ঞানবিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু থেকে ছিটকে পড়েছে। ক্ষমতার মোহ আর ভোগের পেয়ালায় মুসলিম নেতারা এমনভাবেই বুঁদ ছিল, কখন যে বাদশাহ থেকে দাসের জাতিতে পরিণত হয়েছে টেরও পায়নি। আজও নেতাহীন মুসলিম বিশ্ব গাজা-সিরিয়াসহ পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে মুসলমানদের এমন দুর্দশা দেখে হুহু করে কেঁদে উঠেছিল কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজীর দরদি কলব। কলব থেকে কান্না ঝরে পড়েছে কলমে। লিখেছেন ‘অনল প্রবাহ’ নামে অনবদ্য কাব্যগ্রন্থ। তিনি গ্রন্থটি লিখেছেন যুবকদের উদ্দেশ করে। উৎসর্গপত্রে বলেছেন, ‘ইস্লামের গৌরবের বিজয় কেতন/হে মোর আশার দীপ নব্য যুবগণ।/মোস্লেমের অভ্যুত্থানে/ ইসলামের জয়গানে/আবার লভুক বিশ্ব নূতন জীবন।’ কবি বলতে চাইছেন, বর্তমান পৃথিবী ভোগের রোগে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। এখানে সবাই মড়ার মতো পড়ে আছে। তাদের জীবনে কোনো আনন্দ নেই। উৎসাহ নেই। নেই উৎফুল্ল মনের মিষ্টি হাসি। এই রোগ-শোক-জীর্ণতা থেকে মানুষকে বাঁচাতে নতুন দাওয়াতের প্রয়োজন। আর সে দাওয়াত হলো চিরনতুন ইসলামের দাওয়াত। ইসলামের বিজয় আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এ কাজের দায়িত্ব তিনি দিয়েছেন যুগের যুবকদের কাঁধে। তিনি এক কথায় ১০০ কথা বলে দিয়েছেন। বলেছেন, মুসলমানের অভ্যুত্থানেই ইসলামের জয় আসবে। আর ইসলামের জয় এলেই বিশ্ব নতুন জীবন পাবে। অর্থাৎ ইসলামকে বিজয়ী করতে হলে আগে নিজেকে খাঁটি মুসলমান বানাতে হবে। আফসোস! আমরা সমাজ বদলে দিতে চাই, রাষ্ট্র বদলে দিতে চাই, ফিলিস্তিন, সিরিয়ার মুসলমানদের জন্য সকাল বিকালে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে কেঁদে বুক ভাসাই, কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত জীবনই কোরআনের ছাঁচে গড়ে তুলতে পারছি না। সেদিন বাসে যেতে যেতে শুনলাম দুই যুবক আলাপ করছে, ফিলিস্তিনের মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। অন্য যুবক বলল, ফজর নামাজের খবর নেই তুমি দাঁড়াতে চাচ্ছ ফিলিস্তিনের মুসলমানদের পাশে! ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের যেখানেই মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে, তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের ইমানি দায়িত্ব। রসুল (সা.)-এর ঘোষণা অনুযায়ী আমরা এক দেহের মতোই। এটা ঠিক। কিন্তু তাই বলে আমার নিজের চরিত্র ঠিক না করে বিশ্ব মুসলমানদের ঠিক করার দায়িত্ব নেওয়াটা আবেগী সিদ্ধান্ত ছাড়া কী বলা যায়। আমি কথায় কথায় মিথ্যা বলি, ভেজাল ব্যবসা করি, সুদ খাই, ঘুষ ছাড়া চলে না, কিন্তু সেই আমিই আবার সমাজ-দেশ-বিশ্ব বদলে দিতে চাই। এটা স্রেফ মোনাফেকি। আমাদের এ মোনাফেকি দেখে মরহুম খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) বলেছিলেন, আমাদের ধর্মীয় আবেগ বেশি, জ্ঞান কম। আসলেই তাই। কিন্তু ভাই, শুধু আবেগের নাম ইসলাম নয়। ইসলাম হলো জ্ঞান ও প্রজ্ঞার নির্যাসে ছাঁচা একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনবিধান। এখানে আপনাকে ফিলিস্তিনি ভাইদের পাশে যেমন দাঁড়ানোর আহ্বান রয়েছে, তেমন নিজেকেও কোরআনের আলোয় আলোকিত মুসলমান হিসেবে আল্লাহর দরবারে দাঁড় করানোর দাবি রয়েছে। নিজেকে কোরআনে আঁকা মুসলমান বানাতে হলে অলসজীবন ত্যাগ করে নিরলস জীবনের সবক নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ইসমাইল হোসেন সিরাজী। তিনি লিখেছেন, ‘জাগাতে অতীত স্মৃতি/জাগাতে অতীত প্রীতি। /অনল প্রবাহ খানি করিয়া রচন/বড় আশে বড় সাধে/দিনু তোমাদের হাতে/হউক অনলময় অলস জীবন।’

মুসলমানদের যে গৌরবময় ইতিহাস আছে, মুসলমানদের যে প্রেমময় জীবনের উদাহরণ আছে সে স্মৃতি জাগিয়ে তোলার স্বপ্ন দেখিয়েছেন কবি। তিনি বলেছেন, খুব সাধ করে, বড় আশা নিয়ে এ অনল প্রবাহ কাব্য গ্রন্থটি তোমাদের হাতে তুলে দিয়েছি। তোমরা যদি ইসলামের গৌরব ফিরিয়ে আনতে চাও, বিশ্বজুড়ে নির্যাতিত, নিপীড়িত মুসলমানদের পাশে দাঁড়াতে চাও তাহলে অলস-কুঁড়েমির জীবন ত্যাগ করে অগ্নিঝরা জীবনের শপথ নাও। আগুন যেমন একবার জ্বলে উঠলে সব জ্বালিয়ে তবে শান্ত হয়, তেমন হে যুবক! তুমিও ইসলামের বিজয় না আসা পর্যন্ত, নিজের আত্মশুদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত নিজেকে থামিও না। আগুনের ধর্মই জ্বালিয়ে দেওয়া। পুড়িয়ে দেওয়া। তেমনি তোমার ধর্মও হবে নিজেকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাঁটি মুসলমানে পরিণত করা। আর এটি সহজ কোনো কাজ নয়। রীতিমতো সাধনা। দিনের পর দিন মোবাইলে বুঁদ হয়ে থাকা, নেশা-আড্ডায় সময় কাটানো বাদ দিয়ে বইয়ে পড়ে থাকা, নামাজের দৌড়ে যাওয়া, কর্মের ভারী বোঝা মাথায় তুলে নেওয়া আসলেই কঠিন কাজ। কিন্তু যুবকের পক্ষে তো কোনো কাজই অসম্ভব নয়। তাই ইসমাইল হোসেন সিরাজী ইসলামের বিজয় পতাকা ওড়ানোর কাজটি দিয়েছেন তরুণদের চওড়া কাঁধেই। শেষ করছি সিরাজীর শেষ চরণগুলো শুনিয়ে, ‘আবার উত্থান লক্ষ্যে/বহাও জগৎ বক্ষে/নব-জীবনের খর প্রবাহ প্লাবন।/আবার জাতীয় কেতু/উড়াও মুক্তির হেতু/উঠুক গগনে পুনঃরক্তিম তপন।’

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি

পীর সাহেব, আউলিয়ানগর

সর্বশেষ খবর