সোমবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

দুর্গোৎসবের সামাজিক বন্ধন

ফণীন্দ্র সরকার

দুর্গোৎসবের সামাজিক বন্ধন

হিন্দুরা নানা দেব-দেবতার পূজা করে থাকে। পূজার ধারাক্রমে এটা এখন সংস্কৃতিরই অংশ হয়ে গেছে। যা হোক ‘দেব’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে জ্যোতির্ময়। দেবী হচ্ছে স্ত্রীবাচক শব্দ। দেবী দুর্গাও জ্যোতির্ময় বা আলোকময়। ‘দুর্গার, ব্যুৎপত্তি হচ্ছে- ‘দ’ অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার বিঘ্ন নাশ করে, ‘গ’ অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং ‘অ-কার শত্রু নাশ করে। এর অর্থ দৈত্য, বিঘ্ন রোগ পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। সব রকম বিপদ-আপদ থেকে রক্ষাকারিণী দেবী জীবনকে আলোকময় করে তুলেন। অন্যভাবে দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। হিন্দু সম্প্রদায় যে দেবতার উপাসনা করে এ উপাসনা হচ্ছে সশক্তির যুগল মূর্তির উপাসনা। যেমন- লক্ষ্মী-নারায়ণ, রাধা-কৃষ্ণ, সীতা-রাম, উমা-শঙ্কর ইত্যাদি। বৈদিক মতে, শক্তি পূজার কোনো স্থান নেই এমন মন্তব্য কোনো কোনো পন্ডিত করে থাকেন। এ রূপ উপাসনা বা পূজা অবৈদিক বা অনার্য ধারা থেকে উদ্ভূত। আবার ধর্মতন্ত্রেই এ শক্তি সাধনার বিশেষ প্রচলন ও আয়োজন লক্ষ্য করা যায়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বৈদিক ও তান্ত্রিক উপাসনা পরস্পরবিরোধী। বৈদিক উপাসনার মূল তত্ত্ব সম্পর্কে অজ্ঞনতার কারণেই পরস্পরবিরোধী ধারা বহমান। বৈদিক দেববাদের উৎস দীপ্তিতে জ্যোতিতে। ‘আর্য জ্যোতি’ আলো বা জ্যোতিই আর্য হয়েছে। সম্মুখে যারা অগ্রসর হন তারাই আর্য পদবাচ্য। সুতরাং বৈদিক ক্রিয়াকল্প মূলত পূজা অর্চনার মাধ্যমেই সংগঠিত হয়।

সনাতনে প্রচলিত অসংখ্য দেব-দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়, এসব দেব-দেবীর উৎস কোথায়? এ প্রশ্ন আসতেই পারে? ভূলোক-দ্যুলোক-অন্তরীক্ষ লোকে যিনি যেখানে আছেন এবং যা কিছু আছে তারইবা উৎস কোথায়? ঋগে¦দন্ডএর উত্তরে বলে ‘এসব কিছুই অদ্বিতীয় ও অখন্ড। এসবের উৎস হলো- দেবমাতা অদিতির গর্ভ থেকে ভিন্ন ভিন্ন দেবতার আবির্ভাব ঘটেছে। দেবমাতা মহাশক্তি রূপিনী, ঐশীশক্তি মহামায়া সব দেবতারই জন্মদাত্রী। তিনি একা অদ্বিতীয়া। শাস্ত্রে আছে ‘দ্বিতীয়া- কা ময়াপরা’ আমা ভিন্ন অপর কে দ্বিতীয়া আছে? সকল দেবতা আমার বিভূতি এবং বিশেষ বিশেষ প্রকাশ। তিনি দৈত্যের দম্ভকে খর্ব করে বলেছেন, ‘পৈশ্যতা দুষ্ট ময়্যেব বিশন্ত্যো মদবিভূতয়।’ এই দেখ সবকিছু আমাতে মিলে একাকার হয়ে যাচ্ছে। বৈদিক দেবতার উপাসনাও মহাশক্তির উপাসনা। অন্যভাবে সব দেব-দেবী সদব্রহ্ম বা ঈশ্বর বস্তুর বিভাসমাত্র।

বেদে বহু দেব-দেবীর উল্লেখ আছে। দেব-দেবী বিভিন্ন নামে পরিচিত এবং আরাধিত। এসব দেবতা সবাই অদিতির প্রকাশ। সবাই অদিতির সন্তান। আর সন্তানরা দৈত্যকুল-সংকীর্ণ ও স্বার্থপরতার প্রতিমূর্তি। দেবতা আর দৈত্যকুলের লড়াই সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই চলে আসছে। কিন্তু এদের সবার পিতা কিন্তু একজনই। তার নাম কশ্যপ বা দ্রষ্টামাত্র। ‘কশ্যপ : পম্যকো ভবিত।’ ইনি শুধু দেখেন। দিতির গর্ভে দৈত্য, আর অদিতির গর্ভে জন্মে দেবতা সকল। পৌরাণিক এসব কাহিনি থেকে জানা যায়, সৃষ্টির সবকিছুর মধ্যে অবিরাম ঘাত-প্রতিঘাত, দুই পরস্পরবিরোধী বিরাজমান। বৈদিক সাধনার ধারায় খন্ড বা সংকীর্ণতাকে পরাভূত করা যায়। অখন্ড উদ্ভাসিত হওয়ার প্রয়াস পায়। দুর্গাপূজা অন্ধকার থেকে মুক্তির প্রত্যয়ে অনুষ্ঠিত হয়। দেবী দুর্গা শিষ্টের পালনে ও দুষ্টের দমনে আবির্ভূতা হন জীবকে শিক্ষার জন্য। অসুর হচ্ছে দুষ্ট অপশক্তি, এ অপশক্তির দমনে দেবী দশভূজা রূপ ধারণ করেন। সমাজজীবনে যে অপশক্তি আছে, প্রতিহিংসাপরায়ণ যে জনগোষ্ঠী আছে তাদের প্রতিহত করতে দেবী হচ্ছে প্রেরণাদায়িনী। সমাজ বলীয়ান হয়, সমাজের মানুষ প্রগতিশীল হয়, দেবী পূজার যজ্ঞ-ভাবনার প্রেরণায়। যজ্ঞ সমাজের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়া না থাকে তবে সমাজ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে হতে অধপতিত হয়। যে কোনো ধর্মীয় উৎসব সমাজকে দেওয়া-নেওয়ার শিক্ষাটাই দিয়ে থাকে। সনাতন ধর্মে হিন্দু সম্প্রদায় পূজা বৈচিত্র্যে একেরই পূজা ‘এক মেবা দ্বিতীয়ম।’ দেবী দুর্গা এভাবে মহাশক্তিরই রূপাধার। বহুত্বের মধ্যে একত্বের অনুভব। সনাতনে উপাসনা বৈচিত্র্যে নিহিত তত্ত্বের অন্যতম অনুষজ্ঞ হচ্ছে দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজায় এ একাত্মানুভূতি সর্বস্তরে তথা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষে অনুভূত। তাই সবার অংশগ্রহণে পূজোৎসব হয়ে ওঠে মাধুর্যময় এবং সৃষ্টি হয় বহুত্ব নিয়ে একত্বের মেলবন্ধন। এভাবে উদ্ভূত হয় সংহতি ভাবনা। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসার ভাব জেগে ওঠে। তৈরি হয় সহাবস্থানের সেতু। সে জন্য দুর্গাপূজা কেবল হিন্দুদের উৎসবে সীমাবদ্ধ নেই। এটা এখন সার্বজনীন। ধর্মীয় আচার ও ক্রিয়াকলাপ হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ, বাদবাকি উৎসবটি নির্বিশেষে সব ধর্ম-বর্ণের। উৎসবের আনন্দ সবাই ভাগাভাগি করে নিই। আধুনিক বিজ্ঞান মতে, জড় ও শক্তি কখনো বিযুক্ত থাকতে পারে না। এ শক্তিকেই সনাতন ধর্মের হিন্দু সম্প্রদায় মাতৃরূপে উপাসনা করে আসছে যুগ যুগ ধরে। মাতৃরূপে এ উপাসনার উদ্যোগটি খুবই বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। পুরাকালে মুনি ঋষিগণ ব্রহ্মশক্তিরূপা জগৎমাতার উপাসনায় দুটি ভাব তুলে ধরেছেন। এ দুটো ভাবের লক্ষ্য আসলে এক। কর্মভেদে, প্রয়োজনভেদে ঘটেছে এসব রূপ-বৈচিত্র্য। এ জন্য দেবী কখনো সৌম্যা, কখনো ভয়ংকর। হৃদয়ে কৃপা, সমরে নিষ্ঠুরতা- উভয়ের একত্র সমাবেশ থেকে জীবকেই আলোর পথে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছেন দুর্গা দেবী। সমাজ যেন পাপ পথে ধাবিত না হয় সে শিক্ষার নিদর্শন দেবী পূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্যই ছাপিয়ে গেছে সমাজের স্তরে স্তরে।   

লেখক : কলাম লেখক

সর্বশেষ খবর