মঙ্গলবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

কষ্ট বুকে চেপেই চলে গেলেন শফি বিক্রমপুরী

মহিউদ্দিন খান মোহন

কষ্ট বুকে চেপেই চলে গেলেন শফি বিক্রমপুরী

এক পাহাড় কষ্ট বুকে চেপে পরপারে চলে গেলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও চলচ্চিত্র নির্মাতা শফি বিক্রমপুরী। গত ১৭ অক্টোবর থাইল্যান্ডের ব্যাংকক জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এই দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্বের জীবনাবসান ঘটে। অশীতিপর এই রাজনীতিকের মৃত্যুসংবাদ যখন পেলাম, মনটা হাহাকার করে উঠল। টেলিফোনের ওপাশে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন তাঁর ছেলে হাফিজুর রহমান; যিনি সেখানে ছিলেন। তাঁর একজন গুণমুগ্ধ কর্মী হিসেবে এ সংবাদ ছিল আমার জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। কেননা, তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা চার দশকের। সম্পর্ক ছিল আক্ষরিক অর্থেই আন্তরিক। ফলে মনটা বিষণ্ণ হলো। পরিচিত কয়েকজনকে জানালাম দুঃসংবাদটি। পরদিন তাঁর মৃতদেহ ঢাকায় আসে রাত দেড়টায়। ১৯ অক্টোবর ফজরের নামাজ শেষে গুলশান আজাদ মসজিদে প্রথম এবং সকাল ১০টায় বিক্রমপুরের শ্রীনগর ছনবাড়িতে (ঢাকা-মাওয়া হাইওয়ের পাশে) তাঁরই প্রতিষ্ঠিত আল-মদিনা জামে মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পাশের পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

শফি বিক্রমপুরী নামটির সঙ্গে পরিচয় স্বাধীনতার পরপরই। সম্ভবত ১৯৭৩ সালে পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’র বিজ্ঞাপনে প্রযোজক হিসেবে নামটি দেখে বুঝতে পারলাম তিনি আমাদের বিক্রমপুরের মানুষ নিশ্চয়ই। পরে জানতে পারলাম তাঁর বাড়ি আমাদেরই উপজেলার (তখন বলা হতো থানা) সেলামতি গ্রামে। সুস্থ বিনোদনমূলক সিনেমা বানিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। ডাকু মনসুর, রাজ দুলারী, বাহাদুর, কলমী লতা, দেনমোহর, সবুজ সাথী ইত্যাদি অসংখ্য ছবির তিনি প্রযোজক ছিলেন, পরিচালকও ছিলেন কোনো কোনোটির। অবশ্য নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন অশ্লীলতার ভাইরাস বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়ে, চলচ্চিত্র ব্যবসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি।

শফি বিক্রমপুরী ভাইয়ের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় হয় ১৯৭৯ সালে। সেবার ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-৫ (শ্রীনগর-লৌহজং) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। আমি তখন ছাত্ররাজনীতি করি এবং নবগঠিত দল বিএনপির একজন মাঠকর্মী। আমাদের দলের প্রার্থী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার উইং কমান্ডার এম হামিদুল্লাহ্ খান (অব.)। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সাবেক মন্ত্রী দলটির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এম কোরবান আলী। নির্বাচনি প্রচারণা চলাকালে কয়েকবার শফি বিক্রমপুরীর সঙ্গে দেখা হয় আমার। কুলির মাথায় মাইকের বোঝা চাপিয়ে পায়ে হেঁটে আমরা প্রচার কাজ চালাতাম। তেমনি প্রচার চালাতে গিয়ে একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয় লৌহজং উপজেলার হলদিয়া বাজারে। তিনি বোধহয় কোথাও মিটিংয়ে যাচ্ছিলেন। আমরাও সেখানে গেছি। একটি চায়ের দোকানে কয়েকজন সঙ্গীসহ তিনি চা খাচ্ছিলেন। আমি গিয়ে পরিচয় দিয়ে বললাম, ‘ভাই, আমরা ধানের শীষের কর্মী’। সহাস্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘বসো বসো। চা-বিস্কুট খাও’। চা খেতে খেতে নির্বাচনের ফলাফল সম্বন্ধে তাঁর কাছে জানতে চাইলাম। হাসতে হাসতে বললেন, ‘কে জিতবে জানি না। তবে আমি যে জিতব না, এটা নিশ্চিত।’ বললাম, ‘তাহলে কেন অযথা টাকা-পয়সা ব্যয় করে প-শ্রম করছেন?’ আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘ছোট ভাই, যে কোনো প্রতিযোগিতায় একজনই ফার্স্ট হয়, সবাই না। কিন্তু প্রতিযোগিতা না থাকলে সে লড়াই, তা খেলা হোক বা রাজনীতি, অর্থবহ হয় না। দেশে যেহেতু গণতন্ত্র চালু হয়েছে, তাকে কার্যকর করতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন অপরিহার্য।’ সেদিন তাঁর কাছে আমার শেষ প্রশ্ন ছিল, লিডার কি রাজনীতিতে আসবেন? স্মিত হেসে বলেছিলেন, ‘এ পৃথিবীতে কখন কী ঘটবে, আল্লাহতায়ালা কখন কাকে দিয়ে কী কাজ করাবেন তা শুধু তিনিই জানেন। এ বিষয়ে এখনো ভাবি নাই।’

পরের বছরই রাজনীতির মাঠে পা রেখেছিলেন শফি বিক্রমপুরী। নির্বাচনি সফরের অংশ হিসেবে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গিয়েছিলেন সেই হলদিয়া হাইস্কুল মাঠে। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কে এম ওবায়দুর রহমান ও হামিদুল্লাহ খান। সে জনসভায় আমিও উপস্থিত ছিলাম। প্রেসিডেন্ট জিয়া হেলিকপ্টার থেকে নেমে মঞ্চে হেঁটে আসার পথে দুই পাশে শফি বিক্রমপুরীর ‘বদনা’ মার্কার পোস্টারের প্রাচুর্য দেখে চমকিত হয়েছিলেন। জনসভা শেষে ঢাকায় ফেরার পথে হেলিকপ্টারে বসে জিয়াউর রহমান ডা. বি. চৌধুরীকে বলেন, ডাক্তার সাহেব, ‘শফি বিক্রমপুরী তো একজন ভালো মানুষ। তাঁকে দলে আনছেন না কেন? তাঁর মতো লোক দলে থাকলে জনগণের কাছে দলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে’। না, সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিতে যোগদানের আমন্ত্রণ পাননি শফি বিক্রমপুরী। কয়েক মাস পরে তাঁকে ফোন করে বিষয়টি জানান বি. চৌধুরী। কেন এ বিলম্ব তা অবশ্য জানা যায়নি। হয়তো দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি চাননি, এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী বাড়ুক। তবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দলের পরিধি বাড়াতে জিয়াউর রহমানের তাগিদে শেষ পর্যন্ত শফি বিক্রমপুরী আমন্ত্রণ পান এবং ১৯৮০ সালের গোড়াতেই যোগ দেন এক বছর বয়সী দল বিএনপিতে। তারপর থেকে দলের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। দলের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন যখন জাতীয় পার্টির মহাসচিব, তিনি শফি বিক্রমপুরীকে তাদের দলে যোগ দিতে বলেছিলেন। কিন্তু শফি বিক্রমপুরী সে আহ্বান অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গেই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এই বলে যে, লিডার, আমি একটি রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করি, সেখান থেকে বিচ্যুত হব না। ১৯৮৩ সালে শফি বিক্রমপুরী বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হন। ২০০৯ সালের কাউন্সিলে তাঁকে দলের সহ-প্রকাশনা সম্পাদক করা হয়। কিন্তু ২০১৬ সালের কাউন্সিলে রহস্যজনক কারণে তাঁকে কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়। গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদ তো দূরের কথা, নির্বাহী কমিটির একটি সদস্যপদও তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। এ নিয়ে তাঁর মনে আক্ষেপ ছিল, কিন্তু কোনো অভিযোগ করেননি কারও কাছে। আমার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল নানা কারণে। তিনি আমাকে খুবই ¯ন্ডেœহ করতেন। তাঁর লেখা ‘আমার দেখা ঢাকার পঁচাত্তর বছর’ বইয়ের কাজের জন্য প্রায় প্রতিদিনই তাঁর বাসায় যেতাম। তখন কখনো কখনো আক্ষেপের কথা বলতেন। দল থেকে বঞ্চিত দুই ভাই কথা বলতাম নানা বিষয়ে। আফসোস করে বলতেন, ‘শহীদ জিয়ার বিএনপি আর আজকের বিএনপির মধ্যে অনেক তফাৎ। জিয়াউর রহমানের হাত ধরে এ দলে এসেছি, ম্যাডামের নির্দেশে কাজ করেছি। এখনকার নেতৃত্ব হয়তো ভাবছে, আমি অকেজো। তাই তারা বাদ দিয়েছে।’ বলেছিলাম, আপনার পদত্যাগ করা উচিত। তাহলে অন্তত অন্যায়ের প্রতিবাদ হবে। একটু হেসে বলেছিলেন, ‘আমি পদত্যাগ করলে তা ম্যাডামের জন্য অসম্মানজনক হবে। এ কাজ আমি করতে পারব না।’ বিক্রমপুরী সাহেবের কথা শুনে বিস্মিত আমি ভাবছিলাম, নেতৃত্বের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল হলে একজন মানুষ এভাবে চিন্তা করতে পারেন! বলতে দ্বিধা নেই, তিনি যেটা পেরেছেন, আমি সেটা পারিনি। বঞ্চনার প্রতিবাদে ছেড়েছি দল। কিন্তু কেন এভাবে অপদস্থ করা হলো শফি বিক্রমপুরীকে? এটা কি বিএনপির চিন্তার দৈন্যতা, নাকি গুণীজনদের সম্মান দিতে ব্যর্থতা? অথচ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিএনপির দিকে সব সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন শফি বিক্রমপুরী। এরশাদের শাসনামলের কথা। বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিস তখন ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে। আর্থিক সংকটের কারণে বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। অবস্থা এমন যে, পরের মাসেই বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। খবর শুনে নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে বেগম খালেদা জিয়ার টেবিলে রেখে বলেছিলেন, ‘ম্যাডাম অফিসের ভাড়া শোধ করার ব্যবস্থা করুন।’ ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও অফিস সংকটে পড়েছিল বিএনপি। নয়াপল্টনের অফিস তালাবদ্ধ। আমি তখন মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের নিত্য সহচর হিসেবে দলীয় কাজে নিয়োজিত। একদিন আমাকে ফোন করে ন্যাম ভবনে মহাসচিবের বাসায় এলেন শফি ভাই। প্রেস ব্রিফিং শেষে তিনি দেলোয়ার ভাইকে বললেন, ‘ভাই, আপনার এখানে তো জায়গা হয় না। এক কাজ করুন, আমার কাকরাইলের অফিসের দুইটা রুম আপাতত অফিস হিসেবে ব্যবহার করেন’। দেলোয়ার ভাই পরদিন আমাদের নিয়ে ৬৬, কাকরাইলের সে অফিসটি দেখে এলেন। (বর্তমানে তা জাতীয় পার্টির কার্যালয়)। চেয়ার-টেবিল কেনা হলো। একদিন মহাসচিব অফিসও করলেন। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং রিজভী আহমেদও সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু পরদিনই ওই অফিসে তালাবদ্ধ হলো। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যক্তিরা হুমকি দিল শফি বিক্রমপুরীকে। নানাভাবে তাঁকে উত্ত্যক্ত করা হয়েছিল। এক ভয়ানক মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন তিনি সে সময়। এভাবে দলের সংকটের সময়ে একজন বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে এগিয়ে এসেছেন শফি বিক্রমপুরী। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে তাঁর প্রিয় দলের কাছ থেকে পেয়েছেন অবহেলা এবং অসম্মান। ২০১৬-এর কাউন্সিলের পর যখন নতুন কমিটি ঘোষিত হলো, দেখা গেল সেখানে কোনো পদেই শফি বিক্রমপুরীর নাম নেই। ৫৯২ জনের ‘জাম্বো সাইজ’ কমিটিতে ঠাঁই হলো না তাঁর। অথচ কত অর্বাচীন, অপোগ- ওই কমিটিতে জায়গা পেয়েছে, যাদের না আছে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, না আছে সমাজে গ্রহণযোগ্যতা, না আছে দলের প্রতি তেমন কোনো অবদান। শেষের দিকে শফি ভাই আফসোস করে বলতেন, ‘আমার দুর্ভাগ্য কি না জানি না, যে দুটি ক্ষেত্রে আমি বিচরণ করেছি, দুটোই আজ অবক্ষয়ের শিকার। চলচ্চিত্র আক্রান্ত অশ্লীলতা আর অপসংস্কৃতিতে আর রাজনীতি ডুবে গেছে অনৈতিকতায়। এখানে আমার মতো মানুষ বেমানান।’ বোধকরি নিজেকে বেমানান মনে করেই তিনি সরে গিয়েছিলেন রাজনীতির মাঠ থেকে। শফি বিক্রমপুরীর মৃত্যুর দুই দিন পরে বিএনপি মহাসচিব একটি শোকবার্তা দিয়েছেন। শোকবার্তাটি দেখে আমি হতভম্ব! শফি বিক্রমপুরী যে বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন, শোকবার্তার কোথাও তার উল্লেখ নেই। সেখানে তাঁকে শুধু একজন চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিচালক হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। এটা কি নিছক ভুল, নাকি বিএনপিতে শফি বিক্রমপুরীর অবদানকে অস্বীকার করার চেষ্টা? এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। দলে মূল্যায়ন না পেয়ে কষ্ট পেয়েছিলেন শফি বিক্রমপুরী। ভাগ্য ভালো মৃত মানুষের পক্ষে পত্রিকা পড়া সম্ভব নয়। না হলে তাঁর মৃত্যুতে তাঁরই দলের এমন তাচ্ছিল্যপূর্ণ শোক (!) দেখে তিনি হয়তো পরপারেই আত্মহত্যা করতে চাইতেন। বলা হয়ে থাকে, যে দেশে গুণীর কদর নেই সে দেশে গুণী জন্মায় না। কথাটি আমি একটু ঘুরিয়ে বলতে চাই- ‘যে দলে নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীর মূল্যায়ন নেই, সে দলে নিবেদিতপ্রাণ ও বিশ্বস্ত কর্মীর দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে বাধ্য’। যে দল শফি বিক্রমপুরীর মতো একজন বিশ্বস্ত ও নিবেদিতপ্রাণ নেতাকে মর্যাদা দিতে জানে না, সে দলে গ্রহণযোগ্য নেতার অভাব দিন দিন প্রকট হবেই।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর