বুধবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

মধ্যপ্রাচ্যে ভূমিযুদ্ধ না ধর্মযুদ্ধ!

মোশাররফ হোসেন মুসা

মধ্যপ্রাচ্যে ভূমিযুদ্ধ না ধর্মযুদ্ধ!

স্যামুয়েল পি হান্টিংটন ১৯৯৩ সালে ‘সভ্যতার সংকট’ নামক এক গবেষণা গ্রন্থে বলেছেন, ‘আগামী পৃথিবীর দ্বন্দ্ব-সংঘাত কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শগত কিংবা অর্থনৈতিক কারণে হবে না, বরং এর কারণ হবে সংস্কৃতি ও ধর্ম।’ সে জন্য তিনি সাত-আটটি প্রধান সভ্যতাকে সমন্বয় করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু মার্কসবাদীরা বহু আগে থেকেই বলে আসছেন, ‘সব দ্বন্দ্বের পেছনে কাজ করে অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব।  অর্থনীতিই সংস্কৃতি নির্মাণ করে। ধর্মকে যতই গুরুত্বের চোখে দেখা হোক না কেন এটি একটি সংস্কৃতি ছাড়া কিছু নয়। গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের কারণে কিংবা প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণে নতুন ধর্মের উৎপত্তি ঘটেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পের বিকাশ হলে প্রচলিত ধর্মগুলো আপনা-আপনি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অতীতে শাসকরা ধর্মযুদ্ধের নামে ভূমি দখল করেছে; বর্তমানে আধিপত্যবাদীরা ভিন্ন কৌশলে একই কাজ করছে।’ মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, সেখানে ভূমির চেয়ে ধর্মই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে অনেকগুলো উপাদান ব্যবহার করে, তার মধ্যে ধর্ম হলো বড় উপাদান। যেমন, মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হওয়ায় তারা ধর্মকে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে আফ্রিকান দেশগুলোতে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ধর্ম অনুপস্থিত। আবার যারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের পক্ষে কথা বলছেন তাদের উদ্দেশে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন-মরিশাস ও ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে বহুসংখ্যক হিন্দু বসবাস করে। কোনো কারণে যদি তারা সে দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ভারতে এসে দাবি করে- তাদের একটি ভূখন্ড দেওয়া হোক। তাহলে কি ভারত রাজি হবে?

ইহুদিরা জেরুজালেমকে পবিত্র প্রতিশ্রুত ভূমি এবং আব্রাহামকে তাদের আদি পুরুষ মনে করে। জেরুজালেমে একই স্থানে ইহুদিদের টেম্পলমাউন্ট, খ্রিস্টানদের সেপালকা গির্জা ও মুসলিমদের আল আকসা মসজিদ অবস্থিত। নৃতাত্ত্বিকদের মতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে কেনান রাজ্যে সেমিটিক সভ্যতা গড়ে ওঠে। এ অঞ্চলটিতে বিভিন্ন সময় বৈদেশিক শক্তি দ্বারা দখল-পাল্টা দখলের ইতিহাস রয়েছে। ধর্ম মতে, আজ থেকে চার কিংবা সাড়ে চার হাজার বছর আগে কেনান রাজ্যে (বর্তমানে প্যালেস্টাইন) মুসা (আ.)-এর জন্ম ঘটে। সে সময় মিসরের ছিল ফারাও বা ফেরাউনদের শাসন। ফেরাউনের দাসত্ব থেকে তার অনুসারীদের মুক্ত করতে গিয়ে তিনি ফেরাউনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে রোমানদের আক্রমণে তার অনুসারীরা ভূমিচ্যুত হন এবং বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ইহুদিরা বিশ্বাস করে তাদের প্রতি নবীর নির্দেশ ছিল- ‘রাষ্ট্র নিপীড়ক যন্ত্র। তোমরা ব্যবসাকে গুরুত্ব দিবে।’ অনেকে মনে করেন, ইহুদিদের ব্যবসাকে গুরুত্ব দেওয়ার পিছনে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা রয়েছে। ইহুদিরা যেখানেই গেছে সেখানেই তাদের বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হতে দেখা যায়। কিন্তু সেই অর্থ জনহিতকর কাজে ব্যয় না হওয়ায় স্থানীয়দের সঙ্গে এক প্রকার দূরত্ব তৈরি হয়। জার্মান, রাশিয়াসহ অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশে তাদের প্রতি আক্রোশের পিছনে এই জনবিচ্ছিন্নতাকে দায়ী করা যায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কঠিন শর্তাবলি ও ধর্মীয় আচার-আচরণ তথা জন্মসূত্রে ইহুদি হতে হয় বলে এই ধর্মের বিস্তার ঘটেনি (যা অনেকটা হিন্দু ধর্মের মতো)। উনিশ শতকের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত প্রথম জায়নবাদী কংগ্রেসে কয়েকজন ইহুদি বুদ্ধিজীবী আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমরা শত শত বছর ধরে একটি দেশে বসবাস করেও স্থানীয়দের আপন হতে পারিনি। সে জন্য আমাদের উচিত হবে, যে দেশ থেকে আমাদের উৎপত্তি ঘটেছে সে দেশে চলে যাওয়া।’ ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের সুযোগে তারা ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে এবং পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশের ম্যান্ডেট ও লিগ অব ন্যাশনের অনুমোদনে জেরুজালেম এলাকায় তারা আলাদাভাবে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা শুরু করে। ১৯২১ সালে সেখানে ইহুদি সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ হাজার। অভিবাসীদের কারণে সে সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৭২ লাখ। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে ইহুদিদের সংখ্যা মাত্র ১ কোটি ২৫ লাখ। কথিত আছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চালায় সমগ্র বিশ্বকে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরিচালনা করছে ইহুদি ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবীরা। বিশ্বে বিজ্ঞানে এ পর্যন্ত যত আবিষ্কার হয়েছে তার চল্লিশ ভাগের দাবিদার এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে থাকার পরেও ফিলিস্তিনিদের বেলায় কেন যে তার জায়নবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছে, আবার কেন যে তারা দীর্ঘ দেড় হাজার পর পূর্ব পুরুষদের জন্মস্থানে ফিরে এলো, তা এখন গবেষণার বিষয়। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের বক্তব্য হলো, ‘আমরাই এখানকার পুরাতন ও স্থায়ী অধিবাসী। ইহুদিরা বহিরাগত।’ বর্তমান হামাস দাবি করছে ইহুদিদের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন ধর্মীয় কারণে নয়। কিন্তু তাদের দলীয় আদর্শে রয়েছে ইহুদিদের উচ্ছেদ করে সেখানে বৃহত্তর ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের কথা। ধর্মীয় রাষ্ট্র ইরান বহু আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, ‘পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ইহুদি নামক রাষ্ট্রের নাম মুছে ফেলতে হবে।’ মধ্যপ্রাচ্যের সংকট প্রসঙ্গে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর বক্তব্যও ধর্মনিরপেক্ষ নয়। বাংলাদেশের বড় দলগুলোর শীর্ষ নেতারা বহুবার বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনি জাতির পক্ষে মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’ গত ৭ অক্টোবর ’২৩ তারিখে হামাসের নেতৃত্বে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো একই সঙ্গে ইসরায়েলের ভূখন্ডে প্রায় ৫ হাজার রকেট নিক্ষেপ করে। এতে ১ হাজার ৪০০-এর বেশি ইসরায়েলি নিহত হয়। অন্যদিকে ইসরায়েলের আক্রমণে ৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহতের সংখ্যা এর বহুগুণ। সর্বশেষ গাজায় আল আহলি আরব হাসপাতালে রকেট আক্রমণটি বড়ই মর্মান্তিক। ওই হামলায় তাৎক্ষণিকভাবে ৮০০ জনের মৃত্যু ঘটেছে বলে জানা গেছে। হামাস দাবি করছে, তাদের হাতে প্রায় ২৫০ জন ইসরায়েলি আটক আছে। লেবানন থেকে শিয়াপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ (আল্লাহর দল) ইসরায়েলের দিকে রকেট নিক্ষেপ শুরু করেছে। এ অবস্থায় যদি রাশিয়ার সমর্থনে ইরান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আরব দেশে তেলসম্পদ আবিষ্কৃৃত হওয়ার আগে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো দেশ দখলের চিন্তা করেনি। তারা এখন তেলসম্পদ দখলে রাখার স্বার্থে এক হাতে ধর্মীয় উগ্রবাদের জন্ম দিচ্ছে আর অন্য হাতে সেটি দমনের নামে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা খেলছে। একই উদ্দেশ্যে তারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। তবে বাস্তবতার নিরিখে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ও জাতিসংঘের সমর্থন এবং ১৬২টি দেশের স্বীকৃতিকে অস্বীকার করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া আত্মঘাতী হবে।  সে জন্য আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোকে ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইন দুই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করে সমাধানের রাস্তা বের করতে হবে। ফিলিস্তিনিদের মনে রাখা দরকার, তারা যদি ভূমিযুদ্ধে হামাসের গোঁয়ার্তুমি অনুযায়ী ধর্মকে সামনে নিয়ে আসে তাহলে সাম্রাজ্যবাদের পাতানো ফাঁদে পা দেওয়া হবে; অন্যদিকে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষেও যুক্তি তৈরি হয়ে যাবে।

লেখক : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক

সর্বশেষ খবর