বুধবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

শিল্পায়নের অপার সম্ভাবনা

মো. খসরু চৌধুরী সিআইপি

শিল্পায়নের অপার সম্ভাবনা

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেলের (বঙ্গবন্ধু টানেল) যানবাহন চলাচলের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। এখন টানেলের ভিতরে-বাইরে নিরাপত্তার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। টানেলের নিরাপত্তায়  ১০০টির বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধু টানেল যান চলাচলের জন্য চালু হলে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। এ টানেলকে দেশের যোগাযোগ খাতে দ্বিতীয় বিপ্লব মনে করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বৃহত্তর চট্টগ্রামে শিল্পায়ন, অর্থনীতি, পর্যটনসহ অন্যান্য খাতে নতুন মাত্রা যোগ হবে। টানেলের মাধ্যমে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর ও মহেশখালীর সঙ্গে যুক্ত হবে পুরো দেশ। এরই মধ্যে দেশের বাণিজ্যিক হাব হিসেবে মহেশখালীকে গড়ে তুলতে তৈরি করা হয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং প্রকল্প। নির্মাণাধীনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, এলপিজি টার্মিনাল, অয়েল টার্মিনাল, গ্যাস ট্রান্সমিশন, অয়েল রিফাইনারি, এনার্জি ও ফুড স্টোরেজ, ট্যুরিজম, এমব্যাংকমেন্ট ও ওয়াটারফ্রন্ট ইকোনমিক জোন। এ মেগা প্রকল্পগুলোয় বিভিন্ন এলাকা থেকে পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য প্রতিদিন চলাচল করবে শত শত গাড়ি; যা বঙ্গবন্ধু টানেল ব্যবহার করবে।

এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, টানেল পুরোদমে চালু হলে প্রতিদিন গড়ে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি চলাচল করবে। বছরে সে সংখ্যা দাঁড়াবে ৬৩ লাখে। ২০২৫ সালে টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে; যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী যানবাহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল চালু হলে চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক কর্মকা- বাড়বে ব্যাপক হারে, যা সরাসরি প্রভাব ফেলবে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। টানেলের কারণে পর্যটন নগরী কক্সবাজার, পার্বত্য জেলা বান্দরবান এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে পুরো দেশের সেতুবন্ধ তৈরি হবে। মহেশখালীর মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী দেশের অন্যতম বৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, এলপিজি টার্মিনাল, অয়েল টার্মিনাল, গ্যাস ট্রান্সমিশন, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং প্রকল্প, অয়েল রিফাইনারি, এনার্জি ও ফুড স্টোরেজ, ট্যুরিজম, এমব্যাংকমেন্ট ও ওয়াটারফ্রন্ট ইকোনমিক জোনের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে। আনোয়ারা উপজেলায় গড়ে ওঠা কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইপিজেড, সিইপিজেডে আরও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে সাশ্রয় হবে সময় ও অর্থ। টানেলের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। পর্যটনশিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশে এটি ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান। বাড়বে রপ্তানি।  বঙ্গবন্ধু টানেলটির মধ্য দিয়ে মেগা প্রকল্পগুলোর সুবিধা সংযোগ হয়ে সমগ্র চট্টগ্রামের জীবনমান বদলে যাবে। টানেলটি উদ্বোধন হলে প্রায় ৩৩ হাজার একর ভূমির ওপর মিরসরাইয়ে নির্মাণাধীন স্পেশাল ইকোনমিক জোন, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল, চায়না ইপিজেড ও মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্রবন্দর সংযোগ ও কক্সবাজার এবং তিন পার্বত্য জেলার পর্যটন সম্ভাবনা বেশ জোরালো হবে। দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়বে, বাড়বে জীবনযাত্রার মান। কর্ণফুলী নদীর ওপর এই টানেল জীবনযাত্রা ও যোগাযোগ বিস্তৃতির ক্ষেত্রে অভাবনীয় ভূমিকা রাখবে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার হয়ে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে পারে এটি। স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে এর অবদান হবে উল্লেখ করার মতো। টানেলটির প্রভাব সুদূরপ্রসারী। শিল্পায়ন ও এশিয়ান হাইওয়ের সংযোগ এই টানেলটি বহুমুখী অগ্রগতির সেতুবন্ধ ঘটাবে। বঙ্গবন্ধু টানেলকে ঘিরে এরই মধ্যে বিনিয়োগের নব উদ্যম তৎপরতা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে নতুন শিল্প সম্ভাবনা। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে একের পর এক। শিল্পের কাঁচামাল পরিবহনেও এটি আনবে নতুন যুগ। দেশের অর্থনীতির ‘গেটওয়ে’ হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর একদিকে, অন্যদিকে ডিপ সি পোর্ট সংযুক্ত হয়ে ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন গতি আনবে এটি। দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার-টেকনাফ পর্যন্ত জনজীবনে সুফল বিস্তৃত হবে নিঃসন্দেহে। টানেলের কারণে মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিনিয়োগের বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। টানেল ব্যবহার করে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ সারা দেশের কারখানার পণ্য কক্সবাজারের মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরে আনা-নেওয়া করা যাবে দ্রুত সময়ে। চট্টগ্রাম শহর এড়িয়ে যোগাযোগ-সুবিধার কারণে শিল্প-কারখানার কাঁচামাল যেমন সহজে আনা-নেওয়া করা যাবে, তেমনি প্রস্তুত-পণ্যও সারা দেশে খুব সহজে নেওয়া যাবে টানেলের মাধ্যমে। টানেলের কারণে শুধু অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিস্তৃতে হবে না, একই সঙ্গে পর্যটনশিল্পেরও বিকাশ ঘটবে। টানেল চালু হলে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকা- ব্যাপকহারে বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ছাড়াও পর্যটন নগর কক্সবাজার এবং পার্বত্য জেলা বান্দরবানের সেতুবন্ধ তৈরি করবে। কর্ণফুলী নদীর ওপারে কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইপিজেড, সিইপিজেড, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। বাড়বে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ।  সাশ্রয় হবে অর্থ ও সময়ের। সর্বোপরি পর্যটনশিল্পের বিকাশ ও শিল্পায়নের অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে টানেল। গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক নগর চট্টগ্রাম হবে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’। দুই পারের জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন হবে।

লেখক : পরিচালক, বিজিএমইএ

সর্বশেষ খবর