বুধবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিবাহে যৌতুক গ্রহণ নিকৃষ্ট

মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী

বিবাহে যৌতুক গ্রহণ নিকৃষ্ট

বিবাহের এই পবিত্র বন্ধনকে কলঙ্কিত করেছে যৌতুক প্রথা। এই যৌতুক প্রথা সমাজে এখন এতটাই প্রতিষ্ঠিত যে, যৌতুক ছাড়া বিয়ের কল্পনা করাও যেন বৃথা। সমাজ এটাকে ভীষণভাবে গ্রহণ করেছে। প্রতিটি মেয়ের জন্মলগ্ন থেকেই কন্যাদায়গ্রস্ত গরিব মা-বাবা যৌতুকের করালগ্রাসের নির্মম পরিণতির কথা ভেবে মানসিক দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকতে হয়। একটা সময় ছিল, যৌতুক প্রথা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু এখন এটা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।

উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত, সবার মধ্যেই এটা ছড়িয়ে আছে। এমনকি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিটি মানুষের ভিতরে লোভাতুর দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে আসছে। গণমাধ্যমে প্রতি নিয়তই যৌতুকের দাবিতে নারী-নির্যাতন, নারী হত্যা, আত্মহত্যা ও তালাকের মতো অসংখ্য সংবাদ ছাপা হয়। এই নারী নির্যাতনের অন্যতম একটি কারণ সমাজে প্রতিষ্ঠিত ‘যৌতুক প্রথা’। নারী নির্যাতনকারী যৌতুকলোভী স্বামীর আইনি বিচারে জেল-জরিমানা কিংবা ফাঁসি হয়। এই রায় নারী নির্যাতন দমন ক্ষেত্রে খুব একটা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। এটা সাংস্কৃতিক ও মানসিক ব্যাপার। ফলে চিন্তা-চেতনা ও মননের পরিবর্তন না হলে এই প্রথা বিলুপ্ত হবে না। সুতরাং যৌতুক প্রথা বন্ধ করতে হলে সমাজকে সচেতন হতে হবে এবং এ জন্য দরকার সরকারি ও নাগরিক উদ্যোগ। আইনে বলা আছে, যৌতুক যে দেবে যে গ্রহণ করবে দুজনই সমান অপরাধী। যৌতুককে না বলুন। যৌতুক চাওয়া মানে ভিক্ষা চাওয়া। যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি। যৌতুক দেওয়া নেওয়া ঘৃণিত কাজ। সর্বোপরি মুসলিম হিসাবে যৌতুক নেওয়া হারাম। আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা হারাম সম্পদ ভোগ করিও না। কুকুর এবং শূকরের মাংস খাওয়া যেমন হারাম, তেমনি যৌতুক নেওয়াও মুসলমানের জন্য হারাম। এতে একদিকে যেরকম নারীকে অসম্মান করা হয়, অপরদিকে তার পরিবারের ওপর বর্ণনাতীত মারাত্মক জুলুম করা হয়। বরং ইসলাম একজন নারীকে তার সম্মান দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করে, তার নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের ব্যবস্থা করে, তার উপযুক্ত সম্মানজনক দেনমোহর দিয়ে তাকে বিয়ে করার নির্দেশ দিয়েছে। এক্ষেত্রে কোনোক্রমেই বিয়ের আগে ও পরে কন্যা ও কন্যার পরিবারকে মানসিক, অর্থনৈতিক কোনো ধরনের প্রেসার দেওয়া, চাপ প্রয়োগ করা সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম। এমনকি কন্যাপক্ষকে বিয়ে উপলক্ষে কোনো ধরনের খরচপাতি করারও বাধ্যবাধকতা নেই। বরং সম্পূর্ণ খরচ বরপক্ষকেই বহন করতে হবে। অথচ আমাদের মুসলমান সমাজে সম্পূর্ণরূপে এর উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হয়।

বিয়ের আগে কন্যা পছন্দ করার আগেই যৌতুকের লেনদেন নিয়ে পাকাপোক্ত আলোচনা হয়ে যায়। এমনকী, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও যৌতুকের সামান্য হেরফের হওয়ার কারণে বিয়ের আসর থেকে বর পক্ষ উঠে চলে যায়। ফলে কন্যাপক্ষের পরিবারে হাহাকার, মাতম শুরু হয়ে যায়। ইসলাম শুধু যৌতুক প্রথার বিরোধীই নয়। বরং বিয়ে-শাদির ক্ষেত্রে সব ধরনের অপচয়ের বিপক্ষেও। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, সেই বিয়েই সর্বাধিক বরকতময়, যে বিয়েতে খুব সামান্যই খরচ হয়। রসুল (সা.) নিজে বিয়ে করেছেন সাধারণভাবে, নিজের প্রিয় কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.) আনহাকে বিয়ে দিয়েছেন একইভাবে।

বিয়েতে অপব্যয় পাত্র-পাত্রীর পরিবারের জন্য কষ্টকর পরিণতি ডেকে আনে। সামাজিক সম্মান রক্ষার অজুহাতে অনেকে ঋণ করে মাত্রাতিরিক্ত খরচ করে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। কন্যাদায়গ্রস্ত গরিব পিতা ঋণগ্রস্ত হয়ে মানবেতর জীবনযাপনে নিপতিত হয়। যৌতুককে শোষণ এবং নারী নিগ্রহের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরনের অমানবিক আচরণ সম্পূর্ণ অবৈধ এবং রসুল (সা.) এর সময় কিংবা পরবর্তীতে ইসলামী সমাজে কখনো যৌতুক চালু ছিল বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। যৌতুক প্রথা ইসলামবিরোধী, কোরআন ও হাদিস বিরোধী। তাই সব মুসলমানের জন্য এই গর্হিত কাজ পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। এবং সামাজিকভাবে এই যৌতুক প্রথা প্রতিরোধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা এবং পাপ ও জুলুম থেকে সমাজকে রক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব ও কর্তব্য।

লেখক : ইমাম ও খতিব; কাওলারবাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণখান ঢাকা

সর্বশেষ খবর