বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিরোধী দলের আন্দোলন

মেজর আখতার (অব.)

বিরোধী দলের আন্দোলন

আন্দোলন বলতে সরকারের কর্মকাণ্ড বা খোদ সরকারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি বা জনসমর্থন অর্জনের জন্য সরকারবিরোধী রাজনৈতিক পদক্ষেপকেই বুঝায়। সংবিধানের ৩৭ ধারা মতে জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে

শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়ার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের আছে। তবে এর জন্য সরকার বা পুলিশের কাছ থেকে আলাদা অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সরকার যদি কাউকে কোনো জনসভা করতে না দিতে চায় তাহলে সাময়িকভাবে জনসভা বা শোভাযাত্রা করা সর্বোচ্চ এক মাসের জন্য নিষিদ্ধ করতে পারে। তা ছাড়া কোনো সড়ক বা মহাসড়কে জনসভা বা শোভাযাত্রা কেউ করতে চাইলে স্থানীয় পুলিশকে পূর্ব থেকে অবহিত করে রাখতে হবে যাতে পুলিশ যানবাহন চলাচলে বিকল্প পথের ব্যবস্থা করে রাখতে পারে। কিন্তু জনসভা বা শোভাযাত্রার জন্য পুলিশের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই, তেমনি জনসভা বা শোভাযাত্রার কোনো অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতাও পুলিশের নেই। মনে রাখতে হবে সংবিধানের ৩৭ ধারা মতে একমাত্র সরকার আইনের দ্বারা জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরোপ করতে পারে। কাজেই সংবিধান জনসভা বা শোভাযাত্রার বাধা তিনটি শর্তে অর্থাৎ জনশৃঙ্খলা রক্ষায় অথবা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে এবং যুক্তিসংগত কারণে ছাড়া দিতে পারে না এবং দিতে হলে তা আইনের মাধ্যমে দিতে হবে। পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে যে পুলিশ সরকার নয়। পুলিশ হলো আইন মোতাবেক গঠিত সরকারের একটি বাহিনী যার কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। সরকার বলতে বুঝায় সরকারের নির্বাহী বিভাগের অধীনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিবালয়ের উপসহকারী সচিব পর্যন্ত নির্বাহী ধাপ। বাকি সব সরকারি প্রতিষ্ঠান কিন্তু সরকার নয়। বিরোধী দলগুলো এ আইনগত বিষয়টি আমলে না নিয়ে প্রথম থেকেই পুলিশের অনুমতি নিয়ে জনসভা ও শোভাযাত্রা করতে গিয়ে পুলিশকে মহাপরাক্রমশালী একটি অশুভ শক্তিতে পরিণত করা হয়েছে যা ভাঙতে না পারলে রাজনীতি অনেক বেশি জটিল হয়ে যাবে এবং ক্ষমতাশালীরা নিজেদের অজান্তেই স্বৈরাচারী হয়ে যাবে। কারণ পুলিশের হাতে আইন তুলে দেওয়া হয়েছে তথা গ্রেফতার করার ক্ষমতা পুলিশকে দেওয়া হয়েছে কিন্তু তাদের আইনগত জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হয়নি। এ ধারা অব্যাহত থাকলে পুলিশ সবসময় সরকারের ওপরে সরকার হিসেবে রাষ্ট্রে খবরধারী করে বেড়াবে। এটি ধ্রুব সত্য যে, এ সরকারই শেষ সরকার নয়। কিন্তু পুলিশ থেকে যাবে এবং সুষ্ঠু ধারা গড়ে না উঠলে সব সরকারেরই পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত হবে যা গণতন্ত্রের জন্য চিরস্থায়ী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে।

সংবিধানের ৩৮ ধারা জনগণকে জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করার অধিকার দিয়েছে। তবে তৎসঙ্গে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে যে- (১) নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে, (২) ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে, (৩) রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে এবং (৪) গঠন ও উদ্দেশ্য যদি সংবিধানের পরিপন্থি হয় তাহলে কোনো ব্যক্তির উক্তরূপ সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না। রাজনৈতিক দল করার জন্য আলাদা কোনো বিধান সংবিধানে দেওয়া হয়নি। তবে ৩৮ ধারা মোতাবেক সব শর্ত পালন করে রাজনৈতিক দলগুলো সমিতি বা সংঘ করার আলোকে জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের আওতায় নির্বাচন কমিশন থেকে আলাদাভাবে নিবন্ধিত হতে হয়। কাজেই দেশের সব রাজনৈতিক দলকে সংবিধানের ৩৮ ধারা মাথায় রেখে তাদের সব কর্মকাণ্ড চালাতে হয়। যদি এ ধারার কোনো ব্যত্যয় সরকারবিরোধী কোনো রাজনৈতিক দল করতে যায় তাহলে তাদের বিপাকে পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। তখন বিরোধী দলের সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় সরকারকে অতিরিক্ত সুবিধা সৃষ্টি করে দেয়। সংবিধানের ৩৮ ধারাটি মাথায় না নিয়ে অথবা প্রকাশ্যে এর বিরুদ্ধে গিয়ে অতীতে যারাই রাজনীতি করতে গেছে তারা রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে পারেনি। এমনকি ক্ষমতাসীনরাও সংবিধানের ৩৮ ধারার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে শুধু ক্ষমতাচ্যুতই হয়নি, তারা অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। কাজেই সফল রাজনীতি করতে হলে প্রতি পদে পদে খেয়াল রাখতে হবে ৩৮ ধারার শর্তগুলোকে যাতে কোনো অবস্থাতেই লঙ্ঘিত না হয়।

সংবিধানের ৩৯ এর (১) এ চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হয়েছে কিন্তু (২) এ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদানের সঙ্গে সঙ্গে বাক ও ভাবপ্রকাশ এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা ভোগ করার ওপরে কতগুলো পূর্ব শর্ত আরোপ করে দেওয়া হয়েছে। যদি কেউ এ শর্তগুলো উপেক্ষা করে তার স্বাধীনতা ভোগ করতে চায় তাহলে তার ভোগান্তির মাশুলও তাকে ভোগ করতে হতে পারে। যদি কেউ অতি উৎসাহী হয়ে শর্তগুলোর প্রতি কোনো প্রকার ভ্রুক্ষেপ না করে বাক ও ভাবপ্রকাশ এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা ভোগ করার রোমান্টিকতা দেখাতে যায় তাহলে সরকার বা প্রতিপক্ষের কাছ থেকে মধুর আচরণ না-ও মিলতে পারে! তবে প্রতিপক্ষ বা সরকার দুর্বল হলে ভিন্ন কথা।

সংবিধানের ৬৫ এর (১) ধারা মোতাবেক প্রতি পাঁচ বছরের জন্য ‘জাতীয় সংসদ’ নামে বাংলাদেশের সংসদ-প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যার ওপরে সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়ন-ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে। বর্তমানে যে সংসদ আছে তার মেয়াদ আর বেশি দিন নেই। সম্ভবত ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহেই এ সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তাই মেয়াদ-অবসানের কারণে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদের নির্বাচন হতে হবে। অর্থাৎ সংবিধান মোতাবেক নভেম্বর ২০২৩ সালের প্রথম সপ্তাহ থেকে জানুয়ারি ২০২৪ সালের শেষ সপ্তাহের আগে নির্বাচন হতে হবে। সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন করানোর একমাত্র ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচনী আইন ও নির্বাচনের বৈধতা সম্পর্কে সংবিধানের ১২৫ ধারা মোতাবেক এই সংবিধানে যাহাই বলা হউক না কেন সংবিধানের ১২৪ অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত বা প্রণীত বলিয়া বিবেচিত নির্বাচনী এলাকার সীমা নির্ধারণ, কিংবা অনুরূপ নির্বাচনী এলাকার জন্য আসন-বণ্টন সম্পর্কিত যে কোনো আইনের বৈধতা সম্পর্কে আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না, সংসদ কর্তৃক প্রণীত কোনো আইনের দ্বারা বা অধীন বিধান-অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের নিকট এবং অনুরূপভাবে নির্ধারিত প্রণালিতে নির্বাচনি দরখাস্ত ব্যতীত সংসদের কোনো নির্বাচন সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না এবং কোনো আদালত, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হইয়াছে এইরূপ কোনো নির্বাচনের বিষয়ে, নির্বাচন কমিশনকে যুক্তিসংগত নোটিস ও শুনানির সুযোগ প্রদান না করিয়া, অন্তর্র্বর্তী বা অন্য কোনোরূপে কোনো আদেশ বা নির্দেশ প্রদান করিতে পারিবে না।

সংবিধানের ৭২ এর (১) উপধারা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে সরকারি বিজ্ঞপ্তি-দ্বারা রাষ্ট্রপতি সংসদ ভঙ্গ করিতে পারেন। তা ছাড়া একই ধারার (৩) উপধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ আপনা আপনিই ভাঙিয়া যাইবে। কাজেই যে কোনো বিবেচনায় আগামী সংসদ নির্বাচন ২০২৪ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহের আগে সাংবিধানিকভাবে সম্পন্ন হতে হবে।

সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন যা বর্তমানে যে অবস্থায় সে অবস্থাটাকেই সবাইকে মেনে চলতে হবে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে- সবাই তথা সকল জনগণ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে এবং ঘোষণা দিয়াছে যে যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারে এবং মানব জাতির প্রগতিশীল আশা-আকাক্সক্ষার সহিত সংগতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারে, সেই জন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান সবার পবিত্র কর্তব্য। বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যাহা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত তাই সংবিধানের সকল বিধি-বিধান হুবহু মানিয়া চলিতে বাংলাদেশের জনগণ প্রস্তাবনা অনুযায়ী অঙ্গীকারবদ্ধ।

সংবিধান কোনো ধর্মগ্রন্থ নয় যে এর কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা যাবে না। সংবিধানের বিধান সংশোধনের ক্ষমতা ১৪২ অনুচ্ছেদের (ক) উপঅনুচ্ছেদে খুবই স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে। সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও সংসদের আইন-দ্বারা এই সংবিধানের কোনো বিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণের দ্বারা সংশোধিত হইতে পারিবে। তবে এর জন্য দুটি সুস্পষ্ট শর্ত দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে প্রথমটি হলো “অনুরূপ সংশোধনীর জন্য আনীত কোনো বিলের সম্পূর্ণ শিরোনামায় এই সংবিধানের কোনো বিধান সংশোধন করা হইবে বলিয়া স্পষ্টরূপে উল্লেখ না থাকিলে বিলটি বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা যাইবে না” এবং দ্বিতীয়টি হলো “সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত না হইলে অনুরূপ কোনো বিলে সম্মতিদানের জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইবে না।” তার মানে সরকার ইচ্ছা করলে যে কোনো সময় বর্তমান সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সরকার তা করতে যাবে কেন? হয়তো বিরোধী দল আন্দোলনের মাধ্যমে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করতে পারলে জনগণের চরম অভিপ্রায় অনুযায়ী সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে সরকার বাধ্য হতে পারে। আর যদি বিরোধী দল তাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী সংবিধান পরিবর্তন করতে চায় তাহলে নির্বাচনের মাধ্যমে তাদেরকে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে ক্ষমতায় যেতে হবে।

নির্বাচন ছাড়া গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার কোনো পথ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নেই বলে সচতেন মানুষ মনে করে। লংমার্চ বা মহাযাত্রা করে ক্ষমতা পরিবর্তন সম্ভব যদি বিদেশি কোনো শক্তি প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে। লিবিয়ার দীর্ঘদিনের শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির শাসনের অবসান কীভাবে হয়েছিল তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হয় তাহলে বিদেশি হস্তক্ষেপে কীভাবে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয় তার একটি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। লিবিয়ার বিদ্রোহ শুরু হয় ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তথাকথিত তিউনিসিয়া এবং মিসরে সফল বিদ্রোহ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি থেকে ১১১০ কি.মি উত্তরে বেনগাজি শহরে প্রথমে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং দ্রুত তা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক সুযোগ এবং গাদ্দাফির ৪২ বছরের শাসনের অবসান দাবি করছিল। তথাকথিত প্রতিবাদের জবাব দিতে গাদ্দাফি বল প্রয়োগে উৎসাহিত হন। তিনি লিবিয়ার সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীকে বিদ্রোহ দমনের নির্দেশ দেন। এর ফলে রক্তপাত এবং প্রাণহানি ঘটে, যা তার শাসনের বিরোধিতাকে আরও উসকে দেয়। তারপরে গাদ্দাফির বাহিনী বিদ্রোহ দমন করার জন্য তাদের প্রচেষ্টা জোরদার করার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় লিবিয়ায় মানবিক সংকট নিয়ে ক্রমশ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। মার্চ ২০১১ সালে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৭৩ নম্বর রেজুলিউশন পাস করে, লিবিয়ার ওপর একটি নো-ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠা এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য ‘সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ ব্যবহার করার অনুমোদন দেয়। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যসহ ন্যাটো দেশগুলোর একটি জোট নো-ফ্লাই জোন কার্যকর করতে এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করে দেয়। এ সুযোগে এবং আন্তর্জাতিক বিমান হামলার সাহায্যে গাদ্দাফিবিরোধী বিদ্রোহীরা সরকারি বাহিনীকে কোণঠাসা করতে সামর্থ্য হয়। তারা রাজধানী ত্রিপোলিসহ লিবিয়ার গুরুত্বপূর্ণ শহর ও অঞ্চল দখল করে নেয়। ২০১১ সালের অক্টোবরে, গাদ্দাফির নিজ শহর সির্তে ছিল তার শাসনের শেষ প্রধান দুর্গ। ন্যাটোর সহায়তায় গাদ্দাফি বিরোধী বাহিনী শেষ পর্যন্ত সেই শহরটিও দখল করে নেয়। যুদ্ধে বিদ্রোহী বাহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার পর গাদ্দাফিকে হত্যা করা হয়। তার মৃত্যু তার শাসনের সমাপ্তি চিহ্নিত করে এবং লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখা হয়। গাদ্দাফির পতনের পর, লিবিয়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সংঘাতের একটি নারকীয় সময়ে প্রবেশ করে। বিভিন্ন গোষ্ঠী ক্ষমতা এবং প্রভাবের জন্য তখন লড়াই শুরু করে। ফলে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে যা এখনো বিদ্যমান।

এটা লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে, গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ায় ক্ষমতার শূন্যতা এবং বিভিন্ন দল এবং মিলিশিয়া প্রভাব বিস্তারের সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। গাদ্দাফির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে একটি স্থিতিশীল ও ঐক্যবদ্ধ সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিবিয়া ব্যর্থ হয়েছে। পরিস্থিতি জটিল এবং অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। গাদ্দাফির শাসন আমলে উন্নত ও সমৃদ্ধ লিবিয়া এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। লিবিয়াতে গণতন্ত্র এখনো অধরাই রয়ে গেছে। তবে জনগণ এখন মনে করে গাদ্দাফিই তাদের জন্য ভালো ছিল। তবে এরকম কোনো পরিস্থিতি বাংলাদেশে হলে লাখ লাখ মানুষের জীবনহানি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশীদারি নির্বাচনের জন্য সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে। রাজপথে রক্তাক্ত আন্দোলন করে তা অর্জন করা কখনোই সম্ভব হবে না। জানি না বিশ্ব রাজনীতির চাল কী হবে। তবে যা-ই হোক জনগণ ভালো করেই জানে তা জনগণের কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। জাতি প্রধানমন্ত্রীর দিকে একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে আছে। বিদেশি কোনো ষড়যন্ত্র কাজ না করলে নির্বাচন যথাসময়েই হবে। তবে সমস্যার সমাধান আনবে না। বরং দীর্ঘায়িত করবে। সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে তাই প্রধানমন্ত্রীকেই এগিয়ে আসতে হবে। জনগণের প্রত্যাশা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবকিছু ভুলে গিয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে নির্বাচনের মাঠে নেমে যাবেন। জনগণ প্রধানমন্ত্রীর পাশে থাকবে। জয় হবে জনগণের।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর