বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

মন্ত্রীর সঙ্গে সারা দিন

হোসেন আবদুল মান্নান

মন্ত্রীর সঙ্গে সারা দিন

অনেকদিন বাদে ঢাকার বাইরে একটা অসাধারণ দিন কাটালাম। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণাংশের জাতীয় ও প্রাকৃতিক লীলাময়, বিশ্বঐতিহ্যের আধার, সবুজ পুণ্যভূমি সুন্দরবনের পুরোটা ঘুরে এলাম। নাগরিক হিসেবে নিজের দেশকে বা নিজের অহংকারগুলোকে চোখে না দেখার ব্যর্থতা অপরিসীম এবং অসহনীয়। সুদীর্ঘ কালের সরকারি চাকরি জীবনে নানাভাবে নানা দেশে ভ্রমণের সুযোগ হলেও আমার মাতৃভূমিকে আমি কতটা পরখ করে দেখার চেষ্টা করেছি? নিজের প্রতি এ প্রশ্ন, আমার বরাবরই ছিল এবং আছে। দক্ষিণ বাংলার সঙ্গে সংযুক্তকারী আজকের পদ্মা সেতু তথা আধুনিক সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার অকল্পনীয় উন্নয়ন যেন আমাদের ছোট্ট দেশটাকে আর একধাপ ক্ষুদ্রতর করে দিয়েছে। এটা কি অকল্পনীয় নয় যে, সকালে ঢাকা থেকে যাত্রা করে সুন্দরবন এবং আরও একাধিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে মধ্যরাতে এই ব্যস্ত রাজধানীতে ফিরে আসা! সম্ভব-অসম্ভবের কথা নয়, বাস্তবে তা-ই হলো।

২. সুন্দরবন সংলগ্ন জনপদ দাকোপে গিয়ে চাকরিকালের একটা অপ্রিয় কথা মনে পড়ে যায়। ২০০১ সালের দিকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে সেখানে আমাদের এক বন্ধু ও সহকর্মীর পদায়ন হয়। এমন দুর্গম অপছন্দের স্টেশনে তার বদলির আদেশ পেয়ে বেচারা যারপরনাই কষ্ট ও লজ্জাবোধ করছিল। শত চেষ্টা তদবির করেও কিছু করতে পারছিল না। তার মন খারাপের শেষ নেই। এমন পরিস্থিতিতে সচিবালয়ে হঠাৎ করে সাক্ষাৎ হলো তারই আরেক বন্ধুর সঙ্গে। সে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, দোস্ত কী আর করা, চলে যাও, তোমার একটা ভালো খবর হলো, ‘তুমি যত দিন সেখানে থাকবে তোমার কোনো দিন সেলাইন ক্রয় করতে হবে না’। তার সেই মন্তব্য সে দিন বন্ধুটিকে অগ্নিতে ঘৃত বর্ষণের মতো বেদনার্ত করেছিল।

৩. দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপজেলা দাকোপে পরিকল্পনামন্ত্রীর সরকারি সফরে অপ্রত্যাশিতভাবে আমিও সফরসঙ্গী হলাম। ওখানকার অবহেলিত তৃণমূলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ও চাহিদার কথা বিবেচনা করে সশরীরে মন্ত্রীর এমন সফর। তাদের দাবি, শত শত একর তিন ফসলি জমির ক্ষতি করে পশুর নদীর ড্রেজিং না করা, আর লাউডোব-বানীশান্তা ফেরি সার্ভিসের উদ্বোধন করা। এর সঙ্গে জুড়িয়ে দেওয়া হলো জনসভা। স্থান করা হলো বানীশান্তা ইউনিয়নে। যে বানীশান্তার নাম শুনলে ব্রিটিশ আমল থেকেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে কেবল জীবিকার জন্য স্বদেশীয় বারবনিতাদের এক নিষিদ্ধ বা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের কাহিনি। ইংরেজ, ফরাসি, ডাচ্, ওলন্দাজসহ সব বেনিয়ার ছোট্ট একটা প্রবেশ দ্বার ছিল এ চালনা বন্দরের তীরবর্তী বানীশান্তা। জেনেছি, এখনো এদের উত্তরাধিকারীগণ বহাল তবিয়তে আছে, তবে পরিবর্তিত জীবনের অন্য অবলম্বন নিয়ে। সেখানকার স্থানীয় সংসদ সদস্য (নমিনেটেড) অ্যাড. গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার এবং আয়োজকদের বদান্যতায় আমারও সুযোগ হলো সভায় অংশ নেওয়ার। মনে হচ্ছিল, কার্তিকের শুরুতে থোকা থোকা সবুজ ফসলের মাঠের ওপর রদ্রৌজ্জ্বল হৈমন্তী আকাশের নীলাভ ছায়া পড়ে আছে। একই সঙ্গে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দুর্গোৎসবের ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে সময়টা বেশ জমজমাট ও সাজ-সাজ আমেজে ভরা ছিল। আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী এক সময়ের অসামান্য একজন মানবিক আমলা ও বর্তমান সংসদ সদস্য। একেবারে খেটে-খাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষের সঙ্গে প্রাণ উজাড় করে মিশতে জানেন তিনি। যাকে বলা যায়, বিবেকবান, সৎ, নিরহংকার, সজ্জন এক সাদামনের মানুষের প্রতিকৃতি। সামনে উপবিষ্ট নারীপুরুষের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘আপনারা ভাত-কাপড়, ঘরবাড়ি, বিদ্যুৎ, নিরাপত্তা চান, নাকি গণতন্ত্র চান। গণতন্ত্র কি খাওয়া যায়? সবাই সমস্বরে জবাব দিলেন, আমরা শান্তিতে বাঁচতে চাই, খাবারের নিশ্চয়তা চাই। যা দেখা যায় না, তা আমাদের দরকার নাই। গণতন্ত্রের ধরন নিয়ে আলাপ-আলোচনায় আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এটা কখনো দৃশ্যমান নয়।

৪. জুমাবার বলে দ্রুত গতিতে সভার কাজ শেষ করা হলো। দাকোপে মসজিদের খোঁজ নিতে গিয়ে পথ হারিয়ে অনুজপ্রতিম সিভিল সার্ভেন্ট খুলনার সুযোগ্য পুলিশ সুপার সাইদুরকে নিয়ে প্রায় পুরো এলাকাটা প্রদক্ষিণ করে ফেলি। গ্রামীণ রাস্তার দুই পাশে আমন ধানের গায়ে বাতাসের নিরন্তর খেলার নয়নাভিরাম দৃশ্যে মন ভরে যায়। অবশেষে মন্ত্রীকে নিয়েই জুমার নামাজ আদায় সম্ভব হলো।

বিলম্বিত মধ্যাহ্নভোজের পরে আমাদের সুন্দরবন দর্শনের পালা শুরু হলো। একটা আস্ত বিকালকে চোখের আলোয় নিয়ে মন্ত্রীর স্পিডবোটের ভিতর স্ব-স্ব আমরা আসন গ্রহণ করি। উপজেলা, জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাও সঙ্গী হয়েছেন। স্পিডবোট থেকেই আমরা সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্যকে উপভোগ করছিলাম। দুই পাশের গাছপালা কিছু বন্য ও জলজ প্রাণীর অবাধ বিচরণ মুগ্ধ হয়ে দেখি। এক দিকে সুন্দরবন অন্যদিকে বানীশান্তা, বাজোয়া, কৈলাশগঞ্জ, সুতারখালি, কামারখালি ইত্যাদি ইউনিয়নে কিছু স্থানীয় জনবসতির উপস্থিতি লক্ষ্য করেছি। দেড় ঘণ্টার বিরতিহীন ভ্রমণ। আমরা দেশমাতৃকার মনুষ্য বসতির শেষ প্রান্তের কালাবগি এলাকায় পৌঁছে গেলাম। ডানদিকে বিস্তৃত জলরাশি। দিগন্ত রেখার শূন্যস্থানে অস্তাচলে যাচ্ছে দিনের আলো। গাঢ় হয়ে আসছে সন্ধ্যা। মন্ত্রীসহ সবাই ডাঙায় পা রাখলাম। স্নেহভাজন জেলাপ্রশাসক, খুলনা মন্ত্রীকে অভিবাদন জানিয়ে জায়গাটি সম্পর্কে একটু ব্রিফ করেন। চোখের সামনে হঠাৎ একঝাঁক বনের হরিণ দৌড়ে পালিয়ে যায়। এরা বন্য হরিণ, বনেই সুন্দর। তবে বন বিভাগের কাছ থেকে জানা যায়, এখানে অহরহ বাঘেরও আনাগোনা আছে। শুনে আনন্দিত হওয়ার বদলে সবাই খানিকটা শঙ্কিতবোধও করছিলাম। ওয়াচটাওয়ারের নিচে সবাই চা খেলাম। এবার মন্ত্রীর ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। দেখতে দেখতে একই চ্যানেলে প্রায় একই সময়ে আমরা দাকোপের সেই পুরনো ‘চালনা বন্দরে’ ফিরে আসি। ফেরার পথে মন্ত্রীর গাড়ি আগলে দাঁড়াল স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। তাই পুজোর বর্ণালি আয়োজনে তাঁর পদচিহ্ন রাখতে হলো। সঙ্গে আমরাও শারদীয় পূজার প্রসাদ গ্রহণ করলাম।

৫. রাত তখন প্রায় ৯টা বাজতে চলেছে। আমরা তখনো চালনা পৌরসভা এলাকায়। অথচ আমাদের রাতেই ঢাকায় ফিরতে হবে। মন্ত্রীর সম্মতিতে তাঁর গাড়ির ডান পাশে আমি উঠে বসলাম। দীর্ঘ পথের রাতের যাত্রী আমরা। গাড়ি খুলনা-বাগেরহাট-গোপালগঞ্জ-ভাঙ্গা হয়ে পদ্মা সেতু এবং ঢাকায় যাচ্ছি। আমরা নানা প্রসঙ্গে কথা বলে চলেছি। আমাদের সঙ্গী দুয়েকটি গাড়ি পেছন থেকে অনুসরণ করছে। মনে পড়ে, ২০১৫ সালেও একবার আজকের মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর গাড়িতে করে কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফিরে ছিলাম। তিনি তখন অর্থ প্রতিমন্ত্রী আর আমি সরকারের যুগ্মসচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আমরা একই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। কিশোরগঞ্জ আমার নিজ জেলা। কিন্তু মন্ত্রীর অসংখ্য স্মৃতিজাগানিয়া কর্মস্থল। তিনি সেখানকার এসডিও এবং পরে প্রথম জেলা প্রশাসক। পরবর্তীতে তিনি ময়মনসিংহ এবং চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে কাজ করেছিলেন। মাঠ প্রশাসনের চাকরিতে তিনি ছিলেন আমাদের কাছে একজন অভিজ্ঞ, জনপ্রিয় ও আইকনিক কর্মকর্তা।

৬. ফেরার পথেও হাইওয়ে রেস্তোরাঁ ‘সাম্পানে’ অল্প সময়ের জন্য থামতে হলো। এটা গোপালগঞ্জ জেলার অদূরে অবস্থিত। আকস্মিকভাবে সেখানে এর স্বত্বাধিকারীর সঙ্গেও পরিচয় হলো।

পুনরায় গাড়িতে বসলাম। এবার একজন প্রাক্তন সহকর্মী হিসেবে আমার প্রগাঢ় কৌতূহল থেকে যত প্রসঙ্গ-অপ্রসঙ্গের অবতারণা করেছি, মন্ত্রী জবাব দিয়েছেন অকপটে এবং নিঃসংকোচে। আলোচনায় চলে আসে, হাওরাঞ্চলে তাঁর বেড়ে ওঠা, শিক্ষাজীবন, বিমান দুর্ঘটনা থেকে একা এবং একজনের বেঁচে থাকার কাহিনি, পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা, পরে এসডিও, ডিসি ইত্যাদি নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে চাকরি করা, পরিবার, রাজনীতিতে আসা, অনেক দিনের মন্ত্রিত্ব, ব্যাচমেটদের সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগ। দারুণ স্বতঃস্ফূর্ততার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে তিনি সবই বলেছেন। আমি বারবার বিমোহিত চাহনিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম, এম এ মান্নান নামে আমাদেরও একজন মন্ত্রী আছেন। যাঁকে নিয়ে সর্বত্র বুক স্ফীত করে গর্ব করা যায়। রাত ৯টা থেকে প্রায় দেড়টা অবধি আমি শুনলাম, আর বিস্মিত হলাম। বলা যায়, চমকিত এবং পুলকিত হওয়ার মতো বিচিত্রতায় ভরপুর একজন বর্ণাঢ্য মানুষের জীবনকালের সরল গল্পে আমি মোহাচ্ছন্ন ছিলাম সারাক্ষণ।

লেখক : গল্পকার ও কলামিস্ট

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর