শনিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সৈয়দ আবুল হোসেন

হোসেন আবদুল মান্নান

সৈয়দ আবুল হোসেন

তাঁর আকস্মিক প্রয়াণ দেশের রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ এবং সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে এক শোকাবহ অবস্থা তৈরি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে বিষয়টি সহজেই অনুধাবন করা যায়। ইতোমধ্যে প্রায় সর্বস্তরব্যাপী শোকবার্তায় তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়েছে। রাজনীতি নয়। তিনি রাজনীতির মানুষ ছিলেন বলেও আমি মনে করিনি। তিনি ছিলেন অভিজাত ব্যবসায়ী, বরেণ্য সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী তথা গুণী শিক্ষাবিদ। একজন বিনয়ী, নম্রভদ্র সদাহাস্যোজ্জ্বল মানুষের প্রতিকৃতি।

তাঁকে কখনো বিষণ্নবদন, রুষ্ট, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, অবসাদক্লিষ্ট অবস্থায় প্রত্যক্ষ করেছেন দেশে এমন কেউ কি আছেন? আমার সংশয় আছে, তাঁর শত্রুরাও বোধকরি এমনটা দেখেননি। সচিবালয়ে চাকরি করতে গিয়ে নব্বই দশকের গোড়া থেকে তাঁকে কাছে দেখে বারবার মুগ্ধ হয়েছি। তাঁর চেহারার দ্যুতি এবং জ্যোতি সহসা যে কারও নজর কেড়ে নিয়েছে। এক সময় সচিবালয়ে জনশ্রুতি ছিল সাঁকোর আবুল হোসেনের কাজ ফেলে রাখার কোনো অবকাশ নেই। কারণ তিনি একজন অধস্তন শ্রেণির কর্মচারী থেকে সর্বোচ্চ আধিকারিকের সঙ্গে একই ভাষা এবং স্বরে কথা বলতেন। কোনো ভেদাভেদের বালাই ছিল না। এমনকি এক সময়ের প্রতিমন্ত্রী পরবর্তীতে পূর্ণ মন্ত্রীর চেয়ারে উপবিষ্ট থেকেও সবার সঙ্গে অপরিবর্তিত ও নমনীয় আচরণ করে গেছেন। মনে পড়ে, সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দুবারই তিনি তাঁর মেয়াদ উত্তীর্ণ করতে পারেননি। এটা ছিল নিতান্তই দুর্ভাগ্যজনক। দুবারই তিনি সরাসরি দায়ী না হয়েও দায় মাথায় নিয়ে সরে যান। এটাও এ দেশের বিদ্যমান সংস্কৃতিতে সচরাচর দেখা যায় না।

২. প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে আমি এবং আমার সময়ে তাঁকে দেখেছি একজন অজাতশত্রু বিরল ব্যক্তিত্ব হিসেবে। আমি জানি, আমার মতো অসংখ্য কর্মচারী একই মন্তব্য করবেন। তিনি প্রায় সবার কাছেই আপন এবং অভিভাবকতুল্য জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন।

১৯৯৬ সালে তিনি মাত্র স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। সচিবালয়ের করিডরে হঠাৎ মুখোমুখি হলাম। তিনি সহাস্যে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি এখনো কি পূর্ততে আছেন’?

আমি বললাম, এখনো আছি তবে মনে হয় অন্যত্র চলে যেতে হবে।

বললেন, আসুন আমার সঙ্গে।

তিনি আমাকে ১৯৬৫ ব্যাচের একজন সিএসপি সচিবের কাছে নিয়ে গেলেন। সচিবকে বললেন, ‘তাঁকে আপনি পিএস নিতে পারেন। তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে।’ সচিব খানিকটা বিব্রত হলেও তখন প্রকাশ করেননি। কারণ সচিবকেও তিনি তাঁর নিজের মন্ত্রণালয়ে পদায়নে সহযোগিতা করেছেন। সেটা খুব সুখকর অভিজ্ঞতা না হলেও, পিএস হিসেবে আমি কাজ করেছি বছর দেড়েকের মতো। কিছুদিন পরে ব্যক্তিগত পাসপোর্ট ব্যবহারের দায়ে প্রতিমন্ত্রীর আসন থেকে তিনিও আকস্মিক কক্ষচ্যুত হয়ে পড়েন।

৩. তিনি সরকারের প্রতিমন্ত্রী। আমি সচিবের একান্ত সচিব। একই মন্ত্রণালয়ে চাকরি। মাঝে মধ্যে একতলা ওপর থেকে বলতেন, ‘সচিব মহোদয় আছেন’?

জ্বি স্যার আছেন।

আমি আসব।

আসুন প্লিজ।

তিনি সচিবের কক্ষে এসে দাফতরিক কথা বলে যেতেন। বের হওয়ার পথে আমাকে বলতেন, ‘জানেন তো মুরুব্বি মানুষ একতলা ওপরে উঠতে কষ্ট হয়’। তাই আমিই চলে আসি। একজন মানুষ হিসেবে তাঁর সম্পর্কে আর কিছু বলার আছে কি?

৪. একদিন সচিবালয় থেকে বের হয়ে সোজা কার্জন হল বরাবর হেঁটে যাচ্ছি। আমার বাসা আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টারে। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আমার গাড়ি ছিল না। খুব দ্রুত হাঁটছিলাম। সে সময়ে বন্ধুসমেত প্রায়ই পদব্রজে বাড়ি ফিরতাম। শিক্ষা ভবন সংলগ্ন ট্রাফিক সিগন্যাল থেকেই তিনি আমাকে লক্ষ্য করলেন। আমি ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ ফ্ল্যাগসহ একটা গাড়ি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে, গ্লাস নামিয়ে তিনি বললেন, ওঠেন।

বললাম, সরি স্যার, আমি আজিমপুরে থাকি। আপনার জন্য উল্টো রাস্তা হবে। না, উঠুন। আজিমপুরেই ড্রপ দেব।

শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো। সেদিন প্রতিমন্ত্রীর গাড়িতে লিফট নিয়ে বাসায় পৌঁছি।

৫. আমার পোস্টিং তখন সচিবালয়ের বাইরে। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। সচিবালয়ের এক সভা থেকে বের হতেই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ। উচ্চৈঃস্বরে হাসি দিয়ে বললেন, ‘কেমন আছেন, আসুন আমার রুমে’। আমি যথারীতি তাঁকে অনুসরণ করে কক্ষে গেলাম। তিনি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। খানিককাল আপ্যায়নের পর ড্রয়ার থেকে বের করলেন ছোট্ট একটা প্যাকেট। আমি বললাম, স্যার এটা কী! বললেন, আপনার নয়, এটা আপনার স্ত্রীর জন্য। জানলাম, একটা শাড়ি। মসলিনের মতো সরু ও হালকা। চায়না থেকে এনেছেন। বাসায় গিয়ে স্ত্রীর হাতে দিয়ে ঘটনা বললে সেও অবাক বিস্মিত হয়ে উঠেছিল!

৬. মাত্র কদিন আগে ফেসবুক থেকে পড়েছিলাম, মাদারীপুরের কোনো প্রবীণ শিক্ষকের মৃত্যুতে তাঁর লিখিত শোকবাণী। এটা বিগত কয়েক বছর ধরে লক্ষ্য করেছি, তিনি স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ের পরিচিত কোনো ব্যক্তির তিরোধানে তাৎক্ষণিকভাবে শোক প্রকাশ করেছেন এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সংযোগ করে দিয়েছেন। অন্য কারও ক্ষেত্রে এভাবে শোক জানাতেও বড় বেশি দেখা যায় না। আজ ভাবছি, আমি কি কখনো তাঁর কোনো কাজে লেগেছিলাম? মনে করতে পারছি না। তবে ২০২০ সালের করোনাকালে আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পরে তিনি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব পদে আমাকে দেখতে এসে সস্ত্রীক লন্ডন যাওয়ার সহযোগিতা চেয়েছিলেন। আমি সাধ্যাতীত চেষ্টা করেছিলাম। উল্লেখ্য, তিনি আমার স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতেও লিখিত শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন। অক্লেশে আমার সব পারিবারিক নিমন্ত্রণও রক্ষা করেছেন। পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে নানাজনের নানা মত, মিডিয়ার সার্বক্ষণিক নজরদারিতে তখনো তাঁকে খুব বেশি উদ্বিগ্ন বা বিচলিত হতে দেখিনি। অবশেষে কানাডার আদালত থেকে বিষয়টি খোলাসা করা হলে তিনি সমগ্র জাতির কাছে তাঁর নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন। চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে একুশের বইমেলায় বের হয় তাঁর বই ‘পদ্মা সেতু সততার বিজয়গাঁথা’। এ বইয়ে তিনি তাঁর সব ভূমিকার কথা অকপটে বলে গেছেন। বইটির মলাটের পেছনের কভার পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে-

‘বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগকে সবাই বড় করে দেখল। আমার এবং বাংলাদেশের অবস্থানকে বাঙালি হয়েও বেশির ভাগ বাঙালি বুদ্ধিজীবী আমলে নিল না। এটি আমাদের সাদা চামড়া প্রীতি আর পুঁজিবাদ-পূজার পরিচয়কে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। সাদা চামড়ার লোক যেন কোনো অপরাধ করতে পারে না।’

৭. সৈয়দ আবুল হোসেন চারবার সংসদ সদস্য ছিলেন। শিক্ষা বিস্তারে অবদানের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন। দেশের অন্যতম প্রধান শিক্ষাবান্ধব ব্যক্তিত্ব, দানবীর, ধার্মিক, সৃজন-মনীষী সৈয়দ আবুল হোসেনের চিরবিদায় হলো। তাঁর অকাল প্রয়াত হওয়াটা কেউ মেনে নিতে পারছি না। তবুও আমাদের ইহলৌকিকতার অবসান অনিবার্য বিধায় এক সময় সবাই মেনে নিই। মেনে নিতে হয়। তাঁর জন্য মানুষের অনিঃশেষ ভালোবাসা অনেক দিন বেঁচে থাকবে।

লেখক : গল্পকার ও প্রাবন্ধিক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর