শনিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ইসরায়েল ইউক্রেন যুদ্ধে দ্বিমুখী নীতি

ড. মঞ্জুরে খোদা

জাতিসংঘের তথ্য বলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ১৪ হাজার থেকে ১৪ হাজার ৪০০ জন। রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেন অভিযানের পর থেকে নয়, বরং ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন তাদের ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে দোনেৎস্ক পুনর্দখল করে নেয় তখন থেকে। তার মানে ৯ বছরে নিহত হয়েছে ১৪ হাজার। তার মধ্যে সাধারণ নাগরিক ছিলেন ৩ হাজার। বাকিরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সৈনিক-নাগরিক। সেই হিসেবে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে গড়ে প্রতিবছর নিহত হয়েছে ১ হাজার ৫৫৬ জন, প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছে প্রায় চারজন। আর ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের ১৮ দিনের যুদ্ধে-আক্রমণে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৫ হাজার ৯৯১ জন ও আহত ১৫ হাজার ফিলিস্তিনি। এদের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার শিশু ও ১ হাজার নারী, বাকিরা হামাস সদস্য বা যোদ্ধা। এই যুদ্ধে নিহতের ৪০ শতাংশই শিশু এবং ৩০ শতাংশ নারী! সব মিলে যুদ্ধে নিহত ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু যারা মূলত বেসামরিক নাগরিক। বিষয়টা কি এমন যে নারী-শিশুদের হত্যার মাধ্যমে গাজার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে? অন্যদিকে ইসরায়েলের নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৪০০ জন। নিহতের সংখ্যা অনুযায়ী গাজার যুদ্ধে গড়ে প্রতিদিন ৩৯৯ জন্য নিহত হচ্ছেন। অর্থাৎ ইউক্রেন যুদ্ধের ১০০ গুণ অধিক মানুষ ইসরায়েল আক্রমণে নিহত হচ্ছেন।

এ তো গেল ইসরায়েলের খুনের খতিয়ান। আর কী ধরনের বর্বরতা চলছে তা একনজর দেখে নেওয়া যাক। ১. গাজার ২৩ লাখ অধিবাসীর ১৪ লাখই বাস্তচ্যুত হয়েছে যা ১৯৪৮-এর নাকবার পরে ঘটেনি ২. তাদের ৩০ ভাগ ঘরবাড়ি-স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে ৩. ১১ লাখ গাজাবাসীকে জীবন বাঁচাতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে যেতে বলা ছিল অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতা। উপরন্তু নিরাপদ স্থানে ছুটতে থাকা মানুষের ওপরও হামলা করা হয়েছে ৪. জাতিসংঘের শরণার্থী শিবিরে হামলা করেও নারী-শিশুদের হত্যা করা হয়েছে ৫. ধর্মীয় উপাসনালয় মসজিদ-গির্জা ধ্বংস করা হয়েছে ৬. নিষ্ঠুরতম কাজ একটি হাসপাতালকে সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যেখানে ৮০০ জন খুন হয়েছেন ৭. নির্বিচারে আবাসিক এলাকায় হামলা করেছে। যে কারণে সাধারণ নাগরিকের মৃত্যুর সংখ্যা এত ব্যাপক ৮. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ৯. খাবার পানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে ১০. মানবিক ত্রাণ তৎপরতায় বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে ১১. আহত, পঙ্গুদের চিকিৎসার ব্যবস্থা খুব অপ্রতুল। জিনিসপত্র সরবরাহে বাধা দান। যুদ্ধেরও একটা নিয়ম আছে। জেনেভা সনদসহ বিভিন্ন চুক্তি ও আন্তর্জাতিক আইনে এসব নিয়মকানুনের কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- ১. বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা করা যাবে না ২. কোনো অবকাঠামোতে হামলা করা যাবে না ৩. জীবন বাঁচাতে অসুস্থ-আহতদের অবশ্যই সেবা দিতে হবে ৪. জ্বালানি উৎসতে আক্রমণ যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে ৫. মানবিক ত্রাণ তৎপরতা বাধাগ্রস্ত করা যাবে না ইত্যাদি। গাজা যুদ্ধে ইসরায়েল যে বর্বরতা প্রদর্শন করছে তা যুদ্ধের কোনো নিয়মনীতি, আইনের তোয়াক্কা না করেই করছে। প্রতি মুহূর্তে সেখানে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সবাই সেই অভিযোগ আনছে। কিন্তু মার্কিন ও পশ্চিমা শক্তি এ ক্ষেত্রে সীমাহীন নীরব বরং ইসরায়েলকে আরও হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে মদদ জুগিয়ে যাচ্ছে।

হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আসিসি) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ কী? তিনি নাকি ইউক্রেন থেকে শিশুদের ধরে অবৈধভাবে রাশিয়ায় নিয়ে গেছেন। তাদের অভিযোগ, পুতিন শিশুদের ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের নাগরিকত্ব দিয়েছেন। সেটা যদি যুদ্ধাপরাধ হয় তাহলে যারা শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করেছে সেটা তাহলে কী মাত্রার যুদ্ধাপরাধ একটু ভাবুন! হাজার হাজার শিশু হত্যার মাধ্যমে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু পুতিনের চেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধ করেছে, তাঁর গ্রেফতারি পরোয়ানা কোথায়? ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপ, আমেরিকা-কানাডাসহ অন্যান্য দেশ শরণার্থীদের জন্য তাদের দরজা উন্মুক্ত করে বিশ্বকে তাদের মানবতার চেহারা দেখাল কিন্তু ফিলিস্তিনিদের জন্য তাদের সব দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিল। শুধু তাই নয়, যারা তাদের সাহায্য করবে তাদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হলো। এ কেমন দ্বিমুখী নীতি তাদের?

পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম রাতদিন রাশিয়ার ইউক্রেনে বর্বরতা, যুদ্ধাপরাধ নিয়ে কথা বললেও তাদের তুলনায় বহুগুণ বেশি ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে কোনো কথা বলছে না। ব্রিটেনের সামরিক বিভাগই এ মাসে এক্সে এ কথা স্বীকার করেছে, রাশিয়া ইউক্রেনে তাদের সামর্থ্যরে সীমিত সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছে। তারপরও বলতে হবে পুতিনেরই সব দোষ, পশ্চিমারা নিরাপরাধ। প্রত্যেক হামাস সদস্যের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে, তাদের নির্মূলের নামে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। অথচ ইউক্রেনের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে পশ্চিমা শক্তি ও তাদের মিডিয়া সর্বদা উচ্চকিত ছিল ও আছে। বরং ভুল ও মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে বিশ্বকে বিভ্রান্ত করছে। মার্কিন ও পশ্চিমা শক্তি রাশিয়ার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে রেখেছে। অন্যদিকে ইসরায়েয়েলের জন্য অর্থ, অস্ত্র, তথ্য, সৈন্য সব ধরনের সহযোগিতা করছে। যুগ যুগ ধরে চলা ইসরায়েলের অন্যায়-অপরাধের প্রতিবাদ ও দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমি উদ্ধার এখানে অন্যায় ও সন্ত্রাস কিন্তু ইউক্রেনের জন্য তা খুব ঠিক। বরং ইউক্রেন ছিল রাশিয়ার অংশ সে কথা কি তারা অস্বীকার করতে পারবে? বড়ই অদ্ভুত পশ্চিমাদের পক্ষপাত ও যুক্তিবোধ।

লেখক : সমন্বয়ক, ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, কানাডা

সর্বশেষ খবর