রবিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

যে বিপ্লব ঘটানো হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নে

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

যে বিপ্লব ঘটানো হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নে

১১ অক্টোবর ব্রাসেলস নগরীতে অবস্থিত ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের সমর্থনে অভাবনীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইতঃপূর্বে বিগত সেপ্টেম্বর মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বাংলাদেশবিরোধী একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছিল। সেই অর্থে বলা যায় যে, ১১ অক্টোবরের সিদ্ধান্ত ছিল বহুলাংশে উল্টোমুখী, তথ্যসমৃদ্ধ এবং যৌক্তিকতায় ভরপুর।

বেশ কয়েক মাস ধরেই যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের অন্যতম সহসভাপতি, প্রবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মোজাম্মেল আলি, যিনি লন্ডনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা স্টাডি সার্কেলের সভাপতি, ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের আসল রূপ এবং ধ্বংসাত্মক অভিলাষ উন্মোচন করার দায়িত্বে ব্যস্ত রয়েছেন। বহুবার লন্ডন থেকে ব্রাসেলসে ভ্রমণ করে তিনি বেশ কয়েক দফা ইউরোপীয় কয়েকজন এমপির সঙ্গে নিবিড় বৈঠক করে তাদের অনেককেই বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একাধিক ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী বিকৃত এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করছে। এসব ইউরোপীয় এমপির অন্যতম হচ্ছেন ম্যাক্সিমিলিয়ান ক্রাহ। ইউরোপীয় এমপিরা বিভিন্ন মতধারার ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীভুক্ত। এমনই একটি গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছেন প্রভাবশালী এমপি ম্যাক্সিমিলিয়ান ক্রাহ। তিনি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বেশ কয়েকটি কমিটির সদস্য এবং একটির চেয়ারম্যান। বহু আলোচনা এবং লবিংয়ের পর অবশেষে এমপি ম্যাক্সিমিলিয়ান ক্রাহ নিশ্চিত হন যে ঘোলা পানি পরিশুদ্ধ করার জন্য একটি আলোচনা সভা ডাকা প্রয়োজন এবং সেই উদ্দেশ্যে তিনি এবং সৈয়দ মোজাম্মেল আলির যৌথ উদ্যোগে ১১ অক্টোবরে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দফতরে। কঠোর নিরাপত্তার কারণে আলোচনার হলে ৪০ জনের বেশি লোককে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি, যা ছিল আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রণের ভিত্তিতে। সভার সহ-উদ্যোক্তা সৈয়দ মোজাম্মেল আলি ছাড়াও আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাট্রিক্সের আইনি পরামর্শদাতা ড. রায়হান রশিদ। সৈয়দ মোজাম্মেলের টিমকে সহায়তা প্রদানে ছিলেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির যুক্তরাজ্য শাখার জামাল খান এবং যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা আবদুল আহাদ চৌধুরী।

আলোচনাকলে ম্যাক্সিমিলিয়ান ক্রাহ হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেন প্রকাশ্যেই এ উক্তি করে যে, বাংলাদেশের সুশীলগণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং পশ্চিমা দেশগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে পয়সা পেয়ে থাকেন বিধায় তাদের আনুগত্য অর্থ প্রদানকারীদের প্রতি। সভা শেষে প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটির ভাষ্য বাংলায় অনুবাদ করে নিচে প্রকাশ করা হলো।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তির শিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণার প্রতিযোগিতা’, আজ ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ইউরো এমপি ম্যাক্সিমিলিয়ান ক্রাহ এবং লন্ডনভিত্তিক স্টাডি সার্কেলের যৌথ প্রযোজনায় যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে বিভিন্ন পারদর্শিতার ব্যক্তিবর্গ আলোচনায় অংশ নেন। এতে প্রতিপাদ্য প্রশ্ন ছিল কীভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিকৃত তথ্য প্রচারের চলমান অপতৎপরতা বন্ধ করা যায়। এ ভ্রান্তিভিত্তিক অপপ্রচারের কারণে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে বিকৃত করে দেখানো হচ্ছে। এরই ফলশ্রুতিতে বিশেষ করে ‘অধিকারের’ মামলার ব্যাপারে গত সেপ্টেম্বরে ইউরোপীয় পার্লামেন্টেই একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

অদ্যকার আলোচনা প্যানেলে ছিলেন ইউরো এমপি ম্যাক্সিমিলিয়ান ক্রাহ, রাজনীতি-বিশ্লেষক ক্রিচ ব্ল্যাকবার্ন, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ রশিদ রায়হান বিন এবং লন্ডনস্থ স্টাডি সার্কেলের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোজাম্মেল আলি।

ব্ল্যাকবার্ন সাহেব বলেন, গণমাধ্যমগুলোর উচিত বিষয়টিকে বাস্তবভিত্তিক দৃষ্টি দিয়ে তদন্তে আনা। এ ব্যাপারে এনজিওগুলো কতটা বস্তুনিষ্ঠ তথ্য দিচ্ছে তার ওপর নজর রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

ড. ম্যাক্সিমিলিয়ান ক্রাহ তাঁর ভাষণে বলেন, প্রায় সব এনজিওরই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। এদের অনেকেরই বিকৃত তথ্য প্রচার কার্যক্রমে সম্পৃক্ততা থাকতে পারে, বিকৃত তথ্য প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টায়। মোজাম্মেল আলি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং উন্নয়ন অগ্রযাত্রার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে বলেন, অতীতের কোনো সরকারই জনগণের মঙ্গলের জন্য এত বেশি মনোযোগী ছিল না।

রশিদ রায়হান বিন বাংলাদেশে চলমান মামলাগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত আইনি বিধানগুলোর উল্লেখ করে বলেন, কিছু কিছু আলোচিত মামলায় এমন সাবধানতা অবলম্বন প্রয়োজন যাতে মামলাগুলো দেশি-বিদেশি বিভ্রান্তিকর তথ্যের শিকারে পরিণত না হয়।

আলোচনায় বিভিন্ন বক্তার মন্তব্যগুলো পর্যালোচনার আলোকে নিম্নবর্ণিত কথাগুলো বলা যায়, বিশেষ করে সম্মেলনের পর সংবাদমাধ্যম ইইউ টুডের সঙ্গে কথা বলে জার্মান এমপি ম্যাক্সিমিলিয়ান ক্রাহ যে মন্তব্য করেছেন তার ভিত্তিতে। গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশবিরোধী যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল তার উদ্ধৃতি দিয়ে ম্যাক্সিমিলিয়ান ক্রাহ বলেন, আমি সব সময়ই এর বিপক্ষে ছিলাম। সাধারণত এ প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে আমি সত্যিই খুব সন্দিহান থাকি। কারণ এগুলো ঠিকমতো যাচাই-বাছাই (ক্রসচেক) করা হয় না। আর বর্তমানে এসব অভিযোগ আসছে এনজিওদের কাছ থেকে।

তিনি এসব এনজিওকে ভুয়া বলে এদের প্রতিবেদন দেশের আইনি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার একটি অপচেষ্টা বলেও উল্লেখ করেন।

ম্যাক্সিমিলিয়ান ক্রাহ আরও বলেন, তারা সাধারণত এসব বিষয়ে যত্ন নেয় না। আমি এগুলো অন্তত দুবার চেক করার চেষ্টা করি। আমি দূতাবাসগুলোকে তাদের যুক্তি দেওয়ার সুযোগ দিই, এগুলোর সত্যতা যাচাই-বাছাইয়ের চেষ্টা করি।

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ভুল তথ্য উপস্থাপনা সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছে বলে আমার ধারণা। এর আগে একজন এনজিওকর্মী পুলিশি সহিংসতার বিষয়ে একটি ভ্রান্ত বিবৃতি দিয়েছিলেন যার কারণে একটি দাঙ্গা হওয়ার দারুণ ঝুঁকি ছিল। এ ধরনের ভুল তথ্য প্রচার ইউরোপেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমরা ইউরোপে যে আচরণের বিচার করব সেই আচরণের জন্য আমরা বাংলাদেশি অপতথ্য প্রচারকারীদের ওপরও দোষারোপ করব।

কিছু ভুয়া ও প্রতারণামূলক এনজিও নিয়মিত মানবাধিকার সম্পর্কিত বিকৃত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এরা প্রায়শই আইনি প্রক্রিয়াকে দুর্বল করার অভিপ্রায়ে অবিশ্বস্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দ্বারা অর্থায়নপ্রাপ্ত বা নির্দেশিত হয়।

সাম্প্রতিক কাতারগেট কেলেঙ্কারির মতো তারা সুসংগঠিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও যুক্ত বলে অনেক বিশ্লেষকের ধারণা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈদেশিক নীতিকে প্রভাবিত করার অভিপ্রায়ে এসব এনজিওকে বিদেশি সংস্থার দ্বারা নিয়োগ বা অর্থায়ন করা হয় বলেও ম্যাক্সিমিলিয়ান উল্লেখ করেন। ইইউ প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে এ সমস্যার সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে।

কীভাবে এ বিষয়টি মোকাবিলা করতে হবে, ইইউ টুডের এমন প্রশ্নের জবাবে ম্যাক্সিমিলিয়ান ক্রাহ বলেন, ‘অবশ্যই যখন ভুল তথ্য আসবে তখন আরও সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তবে এসব এনজিওর শক্তির পুরো কাঠামোর ওপর সবার আগে ফোকাস করতে হবে।

মানবাধিকার বিষয়কে বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু বলে মন্তব্য করে এমপি মি. ক্রাহ বলেন, সারা বিশ্বে পশ্চিমা পররাষ্ট্রনীতির স্বার্থকে উন্নীত করার জন্য ‘মানবাধিকার’ বর্তমানে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। খুবই স্পর্শকাতর মানবাধিকার ইস্যুগুলো নিয়ে বর্তমানে এনজিওগুলোও অনেক তৎপর। কারণ এ ইস্যু দিয়েই বর্তমান পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো তাদের পররাষ্ট্রনীতি সারা বিশ্বের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের অবশ্যই এই আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় এনজিওর কাঠামোগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ আমরা দেশি রাজনীতিতে বিদেশি প্রভাবকে আমন্ত্রণ জানাতে চাই না।

ক্রাহকে প্রশ্ন করা হয়, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এ রেজুলেশন বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে তিনি মনে করেন কি না। জবাবে তিনি বলেন, আমরা আমাদের বাণিজ্য সম্পর্ককে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ রেজুলেশন, যার কোনো আইন প্রণয়ন ক্ষমতাও নেই, সেটি এমন কোনো হুমকি হবে না বলেই তিনি মনে করেন।

এ ছাড়া ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন অক্সফোর্ড ম্যাট্রিক্সের আইনি পরামর্শদাতা ড. রায়হান রশিদ (ডিফিল, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়)। ড. রশিদও এ প্রস্তাবটিকে সমানভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং এ রেজুলেশনে প্রচুর ভুল তথ্য রয়েছে বলেই মন্তব্য করেছিলেন।

ড. রায়হান রশিদ এ ব্যাপারে বলেন, অবশ্যই সংসদ সদস্যরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি গল্প শোনার পরে যেমনটা বোঝার কথা তেমনই বুঝেছেন। কারণ অত্যন্ত স্পর্শকাতর এ বিষয়ে আসল ঘটনার কথা তাদের সম্পূর্ণরূপে জানানো হয়নি।

তাহলে এ ঘটনা কীভাবে ঘটতে পারে জানতে চাইলে ড. রশিদ বলেন, এই পুরো ঘটনাটি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘দেশে তখন হেফাজতে ইসলাম’ নামক তালেবানবাদী জঙ্গি বিদ্রোহী দলের তাণ্ডব চলছিল। দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংসের দিকেই তারা অগ্রসর হচ্ছিল। তাই তাদের থামাতে তাদের বিরুদ্ধে ক্র্যাকডাউন হলেও তা ছিল উন্মুক্ত এবং বিবিসিসহ কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাংবাদিকের উপস্থিতিতেই এ ধরনের ইসলামী জঙ্গিদের শুধু ছত্রভঙ্গ করতেই এ ক্র্যাকডাউন চালিয়েছিল পুলিশ।

কিন্তু পরদিন, অধিকার (একটি বাংলাদেশভিত্তিক এনজিও) বানানো এক গল্প নিয়ে আসে যে ৬৩ জন নিখোঁজ হয়েছে। হেফাজত (মাদরাসার শিক্ষক ও ছাত্রদের একটি অতি ডানপন্থি ইসলামিক অ্যাডভোকেসি গ্রুপ) তো ২০ হাজার লোকের মতো বড় সংখ্যা সামনে নিয়ে এসেছিল। হেফাজতের মতামতের ভিত্তিতে, অধিকার বলছিল যে ক্র্যাকডাউনের কারণে নাকি ৬৩ জন নিখোঁজ হয়েছে।

ড. রশিদ ব্যক্তিগতভাবে নিজেও একজন মানবাধিকারকর্মী। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে তাঁকেও এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল কয়েক দিন পর যারা নিখোঁজ বলে দাবি করা হয়েছে তারা সবাই বহাল তবিয়তেই আছে। বর্তমানে মিডিয়া বা মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ভুল তথ্যের ফায়দা লুটছে এবং তারা তাদের এ মিথ্যা দাবিগুলো আজও প্রত্যাখ্যান করেনি।

‘অধিকার’ নামক সংস্থাটি সরকারের কাছে কোনো বিশেষ দাবি করেছে কি না, এ মর্মে প্রশ্ন করা হলে ড. রশিদ জানান, ‘যখন তারা এ মিথ্যা তথ্যটি নিয়ে এসেছিল, তারা তদন্তের দাবি করেছিল। একটি দেশে, এমনকি একটি তালেবানি অভ্যুত্থান বা অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রচেষ্টা করলেও ৬৩ জন লোক নিখোঁজ হওয়ার দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ না থাকায় সে দাবি গ্রহণযোগ্য নয়।

তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমিসহ সবাই তদন্ত চেয়েছি। কিন্তু তারপর এটির আসল রহস্য উন্মোচন হয়ে যায়। অধিকারের সমস্যা হচ্ছে যে তারা তাদের গল্পটি সংশোধন করেনি বরং তারা আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং অন্যান্য বন্ধুত্বপূর্ণ মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মধ্যে এ গল্পের পুনরাবৃত্তি করেছিল শুধুই নিজেদের স্বার্থে। আর আন্তর্জাতিক এ সংস্থাগুলোর বাংলাদেশে কোনো কার্যালয়ও নেই। তাদের সক্রিয় কোনো অনুসন্ধানী ব্যবস্থাও নেই, তাই তারা অধিকারের সংস্করণের ওপর নির্ভর করছে। সুতরাং অধিকারের গল্পটিই বারবার পুনর্ব্যবহৃত হয়েছে।

‘অধিকার’ তালেবানের সঙ্গে যুক্ত কি না বা এ-সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ আছে কি না জানতে চাইলে ড. রশিদ বলেন, আমার মনে হয় অধিকারের সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খানের জন্যই এর গুরুত্ব বেশি ছিল। তিনি একজন মানবাধিকারকর্মী হলেও বিএনপি শাসনামলে তিনি একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলও ছিলেন। আমি জানি না তাঁর মনে বা তাঁর সংগঠনের মধ্যে কী চলছে বা তাঁদের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল কি না।

২০১৩ সালে হেফাজতের লক্ষ্য কী ছিল জিজ্ঞেস করা হলে ড. রশিদ হেফাজতের ১৩টি দাবির কথা উল্লেখ করেন, যা থেকে পরিষ্কার যে, হেফাজত বাংলাদেশে তালেবানি শাসনব্যবস্থার প্রচলন করতে চেয়েছিল।

এই এনজিও এবং হেফাজতের মধ্যে কোনো সংযোগ আছে কি না জিজ্ঞেস করা হলে ড. রশিদ বলেন, ২০১৩ সালে, এ ইসলামপন্থি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটির (হেফাজত) মাদরাসা থেকে আসা ছাত্রদের বিশাল সমর্থনের ভিত্তি ছিল। তারা আসলে একটি ইসলামিক স্টেট বা বলা যায় একটি তালেবান-স্টাইল ইসলামিক স্টেটের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল। আর তাদের দাবিগুলো ছিল হুবহু তালেবানের আদেশের মতোই- নারী সম্পর্কে, শিক্ষা সম্পর্কে, সবকিছু সম্পর্কে। তারা ছিল তালেবানদের একটি কার্বন কপি।

দুর্ভাগ্যবশত, অন্যান্য ইসলামিক বড় বড় স্কলারদের কাছ থেকেও তাদের অনেক সমর্থন ছিল, যারা রাস্তায় নেমেছিল এবং মূলত তারা তখন এক রকম ধ্বংসাত্মক পথেই এগোচ্ছিল। এ সময় সরকার গণমাধ্যমের উপস্থিতিতে এসব গ্রুপকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু ছত্রভঙ্গ হওয়ার পর হঠাৎ করেই তারা ২০ হাজার লোক নিখোঁজ হওয়ার কথা রটিয়ে দেয়। পরবর্তীতে ২০ হাজার নয়, ৬৩ জন দাবি করা হয়। এর ভিত্তিতেই অধিকার দাবি করে ৬৩ জন নিখোঁজ হয়েছে।

অধিকার একটি মানবাধিকার সংস্থা যার নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) শাসনামলে থাকা একজন অ্যাটর্নি জেনারেল। তাই সম্ভবত একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এখানে থাকতে পারে বলেই ড. রশিদ মনে করেন।

ভবিষ্যতে এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা প্রতিরোধে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কী করা উচিত? জিজ্ঞেস করা হলে ড. রশিদ ইইউ টুডেকে বলেন, ‘ইউরোপীয় পার্লামেন্টের উচিত তাদের নিজস্ব হোমওয়ার্ক করা। প্রতিটি সংসদ সদস্যেরই তাদের সহযোগী ও গবেষকদের একটি পুরো দল থাকে। আমি মনে করি তারা অন্য কারও চেয়ে অনেক বেশি সজ্জিত। সাধারণ মানুষ নয় তাদের আসলে নিজেদেরই ক্রসচেক করা উচিত।

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সোর্স থেকে শুনে-জেনে তারপর ইউরোপীয় পার্লামেন্টের উচিত নিজের মন তৈরি করা। কারণ এ ভুল তথ্যের ব্যবহার মানবাধিকারের জন্য সহায়ক কিছু নয়। সূত্র : ইইউ টুডে

ইইউ টুডেতে ইউরো এমপি ম্যাক্সিমিলিয়ান ক্রাহ এবং অক্সফোর্ড স্কলার ড. রায়হান রশিদের বক্তব্য এবং ১১ অক্টোবরের আলোচনা সভা শেষে প্রকাশ করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে এটি পরিষ্কার যে সেপ্টেম্বরে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল তার কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল না, এটি করা হয়েছিল ভ্রান্ত এবং বিকৃত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে, যেটি প্রদান করেছিল কিছু স্বার্থান্বেষী এনজিও। ১১ অক্টোবরের সিদ্ধান্তকে একটি ইতিবাচক বিপ্লব বলা ভুল হবে না। ইউরো এমপিদের মন জয় করে এ সম্মেলনে রাজি করানোর জন্য সৈয়দ মোজাম্মেল আলিকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

সর্বশেষ খবর