রবিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

মুক্তিমন্ত্রের অমিত শক্তি

ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া

মুক্তিমন্ত্রের অমিত শক্তি

মুক্ত হওয়ার আর যুক্ত হওয়ার আকুতি মানুষের আজন্ম। কিন্তু দোলনা থেকে গোর অবধি মানুষ থাকে নানান বন্ধনে আবদ্ধ। Man is born free and everywhere he is in chains. এ শেকল ব্যাষ্টিক ও সামষ্টিক সকল পর্যায়েই হতে পারে। তবে মানুষ আনন্দের সঙ্গে বন্ধনেও জড়ায়। প্রেমের বন্ধন, সন্তানের বন্ধন, দেশপ্রেমের বন্ধন, কর্তব্যের বন্ধন, ভাবের বন্ধন, মিত্রতার বন্ধন, আত্মিক বন্ধন, আর্থিক বন্ধন, চিত্ত ও বিত্তের বন্ধন। সে বন্ধনের মাঝেই সে আস্বাদন করে অনাবিল মুক্তির স্বাদ। বন্ধন যতক্ষণ মুক্তি অস্বীকার করে না, আহত করে না, মুক্তির রাজ্য জবরদখল করে না, সে রাজ্যে অনধিকার প্রবেশ করে না; ততক্ষণ সে বন্ধনে পরমানন্দ। এ বন্ধন স্বতঃস্ফূর্ততার। তাই বন্ধনের মাধ্যমে মানুষ নিজেকে যুক্ত করে অন্যের সঙ্গে। আর এভাবে যুক্ত হয়েই মুক্তির স্বাদ ভোগ করে সামষ্টিক পর্যায়ে।

একে একে মিলে একতা হয়, জনে জনে মিলে জনতা। জনতা একতার একাগ্র বন্ধনে আবদ্ধ থাকলেই সিদ্ধ হয় যথার্থ মুক্তির বাসনা। বিভক্ত জাতি না পায় সমৃদ্ধি, না পায় মুক্তি। মুক্তির জন্য চাই সুদৃঢ় বন্ধন, ঐকান্তিক ঐক্য। ‘মুক্তি যেখানে বন্ধনকে অস্বীকার করে সেখানে তা উন্মত্ততা, বন্ধন যেখানে মুক্তিকে মানে না সেখানে তা উৎপীড়ন।’ মুক্ত হতে আর মুক্তি দিতে চাই চরম আত্মত্যাগ, পরমতসহিষ্ণুতা, মর্জির সংযম। ভোগের বিপরীতে করতে হয় ত্যাগের লালন। পরের হিত সাধনের মহিমাকে করতে হয় উচ্চকিত। অনুশীলন করতে হয় সাম্য ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির। আর তখনই মুক্তি হয় অর্থবহ। তখনই স্বাধীনতা পায় হৃদস্পন্দন। মুক্তি মেলে আলোয় আলোয়। বর্ণালি স্বর্ণশোভার দ্যুতিচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয় মুক্তি। মুক্তিমন্ত্রের কি অপরিমেয় শক্তি, কি অনির্বচনীয় মাহাত্ম্য, কি অন্তর্নিহিত গভীর আবেদন সে বিষয়ে একটা স্পেনীয় গল্পের ভাবানুবাদ থেকে দেখুন। পরবর্তী কিস্তিতে জালালুদ্দিন রুমির ‘মসনবি’ থেকে একই ধাঁচের আরেকটি কাহিনি বলার ইচ্ছা থাকল।

গল্পের লেখক পেদ্রো পাবলো স্যাক্রিস্তান। জন্ম ১৯৭৩ সালে, মাদ্রিদে। শিশুতোষ গল্প লেখক হেসেবে সুখ্যাতি কুড়িয়েছেন বিশ্বসাহিত্য বোদ্ধাদের। গল্পের নাম ‘বর্ণবর্জিত বাঘ’।

একদা এক দেশে ছিল এক বাঘ। চিড়িয়াখানায় পিঞ্জরবন্দি হওয়ার আগে এর গায়ের রং ছিল চোখধাঁধানো। গা ভর্তি ছিল তেলতেলে, ঝকঝকে ইয়া মোটা মোটা সাদা-কালো ডোরাকাটা। সেই ডোরাকাটা তেজি বাঘের হাল এখন বড়ই বেহাল। গায়ে রঙের বাহার নেই। কেমন ফিকে-তামাটে হয়ে গেছে। যেন পাংশু-পাণ্ডুর-বিবর্ণ। রঙের আকর্ষণে ছিটেফোঁটাও নেই সারা শরীরে। দেহটা যেন আদ্যিকালের সাদা-কালো ছায়াছবির ঝাপসা চালচিত্র। কিংবা বিবর্ণ চিত্রপট। এর এমন অস্বাভাবিক বিবর্ণতাই যেন একে ওই তল্লাটে বিখ্যাত করে তুলেছে। নামিদামি আঁকিয়েরা আসছে দূরদূরান্ত থেকে। চিত্রশিল্পীরা দিচ্ছে নানান নিদান। পটু পটু পটুয়ারা রংতুলি-বুরুশ নিয়ে ভিড় জমাচ্ছে চিড়িয়াখানা এলাকায়। সবারই ঐকান্তিক চেষ্টা, কী করে বাঘের হারানো রং পুনরুদ্ধার করা যায়। সবাই এসে নানা কায়দায় নানা বর্ণের রং মাখে বাঘের গায়ে। ডোরাকাটার চেষ্টা চালায় শৈল্পিক দক্ষতায়। কিন্তু না, ফল শূন্য। বাঘের গায়ে কোনো রংই টিকছে না। পাকা রংও স্থায়ী হচ্ছে না এর লোমশ শরীরে। ফোঁটায় ফোঁটায় গলে পড়ে যায় গায়ে লেপ্টে দেওয়া সব রং। ক্ষয়ে ক্ষয়ে গড়িয়ে পড়ছে রঙের ধারা। কি মুশকিল! সবই নিষ্ফল চেষ্টা।

সবশেষে এলো এক আজব পটুয়া। খেপাটে রুক্ষ মূর্তি। পাগলাটে হাবভাব। এসেছেন অকূলপাথার পাড়ি দিয়ে। অদ্ভুত আঁকিয়ে। খোশমেজাজে তুলি-বুরুশ নিয়ে হাজির চিড়িয়াখানায়। যথারীতি খুলে দেওয়া হলো বাঘের খাঁচার দরজা। গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পটুয়া ঢুকে যায় বাঘের খাঁচায়। হাবভাবে বোঝা যাচ্ছে, সে-ই পারবে বাঘের গায়ে ডোরা কাটতে। কারণ বাঘের গা থেকে এ পটুয়ার মাখানো রং চুইয়ে পড়ে যাওয়ার কোনোই আশঙ্কা নেই। কেন? কারণটা পরিষ্কার। এ পটুয়া তার বুরুশে বাস্তবে কোনো রংই মাখায়নি। শুকনো বুরুশটাকে এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে বাঘের গায়ের এপাশ-ওপাশে বুলিয়ে দিচ্ছে। যেন বাতাসের গায়ে রঙের ডোরাকাটা চলছে। তার এ আজব ও অভিনব অঙ্কনের নমুনা দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে উৎসুক দর্শনার্থী। ওলন্দাজ পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রশিল্পী ভ্যান গগের অনুকরণে এই শিল্পীর ব্যঙ্গাত্মক নাম রাখা হয়েছে ভ্যান কফ। কারণ রংহারা পাংশু বাঘকে রংহীন তুলি দিয়ে বর্ণিল করে তোলার এমন মজাদার শিল্পকর্ম এর আগে ওরা কখনো দেখেনি।

যাই হোক। পটুয়ার পটুতা চলতে থাকে। সে বাঘের আরও কাছাকাছি ঘেঁষে। কানের কাছে মুখ রাখে সতর্কতার সঙ্গে। ফিসফিস করে কিছু একটা বলে। মনে হলো, বাঘটাও গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে পটুয়ার কানপড়া। এরপর রংবিহীন শুকনো বুরুশটা বাঘের গায়ের ওপর থেকে নিচের দিকে আবার চালাতে থাকে ডোরাকাটার ভঙ্গিতে। আরে, কি আজব কাণ্ড! সবাই তাজ্জব বনে যায়। বাঘের পাণ্ডুর-ফ্যাকাশে চামড়ার ওপর জাগতে শুরু করেছে রঙের চিকচিকে চমক। সবাই হতবাক। একি জাদুমন্ত্র? এরপর পটুয়া আবার বাঘের কানে কানে ফিসফিস করে কিছু বলে। এর বাদে আবার হাওয়ায় বুরুশ চালায়। এবার বাঘের চামড়ায় ফুটে ওঠা রঙের বাহার আরও উজ্জ্বল, আরও জ্বলজ্বলে, আরও চকচকে লাগছে। পটু পটুয়া আবার বাঘের কানে কানে কথা বলে। এবারের কানাকানিটা আগের চেয়ে খানিকটা দীর্ঘ সময় ধরেই চলে। এরপর সে তার বায়বীয় চিত্রকর্মটা যেন খানিকটা বিন্যস্ত করে নেয়। তুলির আঁচড়গুলোকে শেষবারের মতো ঠিকঠাক করে নিয়ে যেন অঙ্কন কাজের সমাপ্তি টানবে। হ্যাঁ, ফলাফল অবিশ্বাস্য। এখন বাঘের গায়ের রং পরিপূর্ণ প্রাণবন্ত। ঝকঝকে রঙের নজরকাড়া গভীর ডোরাকাটা বাঘটা যেন শার্দূল শাবক। এমন মস্ত রঙের চকচকে বাহার তাবৎ দুনিয়ার কোনো বাঘের গায়ে দেখা যাবে না, দর্শনার্থীরা হলফ করে বলে।

যাক। বাঘ তার হারানো রঙ ফিরে পায়। কিন্তু সবাই কৌতূহলী! কী ওই পটুয়ার আসল জাদু? এমন তাজ্জব কাণ্ডের আসল রহস্যটা কী? সবাই পটুয়াকে চেপে ধরে, অনুরোধ করে বিনয়ী ভঙ্গিতে, এর ভেদটা তাদের জানাতেই হবে। অগত্যা পটুয়া ব্যাখ্যা করে। ‘আমার তুলি-বুরুশ মূর্তমান করে বাস্তব, চিত্রায়িত করে বাস্তব জীবনের প্রাণস্পন্দন। তাই এ চিত্রকর্মের জন্য কোনো বস্তুগত রঙের দরকার হয় না। মনের অন্তর্গত রংই একে জাগিয়ে তোলে। আমি বাঘের শরীরটাকে যে অতুল্য -অনন্য রঙে রাঙিয়ে তুলেছি তা আসলে একটা বাক্য, যা আমি বাঘের কানে ফিসফিস করে বলেছি। সেই জাদুমন্ত্রবলেই বর্ণিল হয়ে উঠেছে বাঘটা।’

কী সেই অমিত শক্তিধর অমিয় বাণী? আপনারা ভাববেন, নাকি পটুয়া যে রহস্য ভেদ করেছে তা আমিই আপনাদের বলে দেব?

পটুয়া বাঘের কানে বারবার ফিসফিস করে বলে যাচ্ছিল, ‘শোনো! অতি শিগগিরই তুমি এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাচ্ছ, এই নিশ্চিত খবরটাই আমি তোমাকে দিতে এসেছি।’

লেখক : প্রাবন্ধিক

সর্বশেষ খবর