রবিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ মর্যাদা ও কিছু কথা

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান লিটু

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ মর্যাদা ও কিছু কথা

বাংলাদেশের প্রাচীনতম ও শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল জ্ঞান সৃজন ও সঞ্চারণে ব্যাপৃত নয়, বরং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টির পেছনে এর অবদান অনস্বীকার্য। দেশবিভাগ-পরবর্তী বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সম্মিলিত প্রয়াস অগ্রগণ্য। এ বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালি জাতিকে একটি পতাকাই কেবল দেয়নি, এ পতাকার মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য সমাজ রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির যে কোনো অন্যায়-অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আঁতুড়ঘর হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন। তিনি জানতেন এ বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে অসামান্য অবদান রেখেছে। তাই তো তিনি সুযোগ পেলেই ছুটে আসতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি স্বাধীন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য যখন জায়গার দরকার হয়েছিল তখন নিজের দুই-তৃতীয়াংশ জমিও দান করে দিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে এবং বিশেষ মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বিশেষ সমাবর্তনে তিনি এ ঘোষণা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন যা বাস্তবে রূপ পায়নি ঘাতকদের নৃশংসতায়। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের এখনই মুখ্য সময়। ২৯ অক্টোবর, ২০২৩-এর বিশেষ সমাবর্তনে বঙ্গবন্ধুকে মরণোত্তর ডক্টর অব লজ উপাধিতে ভূষিত করা হবে। এ সমাবর্তনের বক্তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বঙ্গবন্ধুর মতো এ বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদাদানের বিষয়ে একমত। তবে এখনো তা বাস্তবে রূপ পায়নি। অথচ বিশেষ মর্যাদাদানের বিষয়টি জটিল কিছু নয়। এমনকি এর জন্য যে সরকারকে খুব বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে তা-ও নয়। বিশেষ মর্যাদাদানের জন্য সরকারের একটি একক নির্বাহী আদেশই যথেষ্ট।

বর্তমানে বাংলাদেশে ৫৪টি পাবলিক, ১১২টি প্রাইভেট ও তিনটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতিগঠনে যে অবদান রেখেছে সেদিক বিবেচনায় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে এটাকে না মিলিয়ে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণ করাই হবে যথার্থ। বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদা দান নতুন কোনো বিষয় নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের লিডিং ইউনিভার্সিটিগুলোকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করেছে। মালয়েশিয়ার পাঁচটি, ফিনল্যান্ডের দুটি, লিথুয়ানিয়ার একটি, সিঙ্গাপুরের একটিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের লিডিং ইউনিভার্সিটিকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করেছে। এর ফলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদাদানের জন্য সরকার এ প্রতিষ্ঠানটিকে দেশের কি এডুকেশন ইনস্টলেশন (KEI) হিসেবে ঘোষণা করতে পারে এবং এর শিক্ষকদের EIP (Educational Important Person)- এর মর্যাদা প্রদান করতে পারে; যা CIP (বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি)-এর মতো সমান মর্যাদা হবে। এ ঘোষণার মধ্য দিয়েই আদতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু বেতন না বাড়িয়েও ইআইপি ঘোষণার মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সম্মান নিশ্চিত করা যেতে পারে। একটা কথা বলতেই হয়, সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হচ্ছেন। কম বেতনকাঠামো জেনেও তাঁরা প্যাশনের জায়গা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হচ্ছেন অনেক বড় বড় সুযোগ পরিহার করে। কিন্তু যখন নিম্ন্ন সামাজিক মর্যাদা পান, তখন তা তাঁদের হতাশ করে। অথচ সরকারের একটি মাত্র ঘোষণাই পারে মেধাবী শিক্ষকদের সেই হতাশা দূর করে দিতে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদা প্রদানের ক্ষেত্রে কিছু সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করাও জরুরি। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গবেষণা বরাদ্দ বৃদ্ধি করা জরুরি। শিখন-শেখানো ও গবেষণা তথা ‘ফিলোসফার কিং’ হিসেবে শিক্ষকরা নির্ভার থেকে রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য জ্ঞানীয় পরিকাঠামো গঠনে নিরলসভাবে যেন কাজ করতে পারেন সেজন্য গবেষণা করার উপকরণ ও সম্পদের সংকট দূরীভূত করা প্রয়োজন। এজন্য শিক্ষকদের মাসিক শিক্ষা উপকরণ ভাতা ও বার্ষিক গবেষণা ভাতা চালু করা প্রয়োজন। প্রতি বছর নিজ নিজ বিষয়ে বিশ্বের প্রধানতম কনফারেন্সে অংশগ্রহণের জন্য সমুদয় ফি ও ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন তবে শর্ত থাকবে পেপার প্রেজেন্ট করা। উচ্চ র‌্যাংকিং জার্নালে প্রতি বছর মৌলিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের সমুদয় ব্যয় বহন করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। ভালো গবেষণার জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করাও দরকার। প্রাধিকারভুক্তদের বা ভিআইপিদের মতো ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে একজন গবেষণা সহকারী নিয়োগ ও বেতন-ভাতাদির ব্যবস্থা করার বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখা প্রয়োজন। বিশেষ মযার্দার অধীনে শিক্ষকরা বিশেষ পাসপোর্ট সুবিধা, বিদেশে বাংলাদেশি মিশন থেকে প্রটোকল পাওয়া, সহজ শর্তে গৃহনির্মাণে বা গাড়ি কেনায় সুদমুক্ত অর্থঋণ পাওয়া অর্থাৎ প্রাধিকারভুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের মতো সুযোগসুবিধা ভোগ করার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। বিদ্যমান বেতনকাঠামো ঠিক রেখে এসব সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি করতে সরকারের যে খুব বেশি অর্থের প্রয়োজন তা কিন্তু নয়। তাই বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যে বিশেষ মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা সেই বিশেষ মর্যাদার ঘোষণা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখবেন এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সহকারী প্রক্টর

সর্বশেষ খবর