মঙ্গলবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

শিশুদের প্রতি নবীজি (সা.)-এর ভালোবাসা

নূর মুহাম্মদ রাহমানী

শিশুদের প্রতি নবীজি (সা.)-এর ভালোবাসা

শিশুরা জান্নাতি ফুল। নবীজি এ ফুলকলিদের ভালোবাসতেন। তিনি তাদের ভালোবাসার শুধু নির্দেশনা দিয়ে ক্ষান্ত হননি; বরং তিনি নিজে শিশুদের ভালোবেসে উম্মতকে শিখিয়েছেন। তিনি শিশুদের পেলে জড়িয়ে ধরতেন। কোলে নিতেন। চুম্বন করতেন। প্রখর রোদে যেতে বারণ করতেন। সফরে বের হলে বাহনে তাদের সামনে-পেছনে বসিয়ে কতটুকু পথ সামনে নিয়ে যেতেন তারপর তাদের বিদায় দিতেন। তাদের প্রতি কঠোর হতেন না। উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে তাদের থেকে কাজ নিতেন। পুরস্কারের লোভ দেখাতেন। নিচে শিশুদের প্রতি নবীজির ভালোবাসার কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো।

১. মসজিদে নিয়ে যাওয়া : আজকাল মসজিদে শিশুরা একটু দুষ্টুমি করলে অনেকে তাদের কঠিন ধমকা-ধমকি করে। এমনকি কেউ কেউ তাদের মসজিদ থেকে বেরও করে দেয়, অথচ নবীজি (সা.) শিশুদের মসজিদে নিয়ে যেতেন। কন্যা জয়নব (রা.) মারা গেলে তার কন্যা উমামাকে তিনি মাঝেমধ্যেই নামাজে নিয়ে যেতেন। আবু কাতাদা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) আবুল আস ইবনে রবির ঔরসজাত কন্যা উমামাকে (রসুলুল্লাহর কন্যা জয়নবের গর্ভজাত মেয়ে) কাঁধের ওপর রেখে নামাজ পড়ছেন। তিনি যখন রুকুতে যাচ্ছেন তখন তাকে (কাঁধ থেকে) নামিয়ে রাখছেন, আবার সিজদা থেকে ওঠার পর পুনরায় কাঁধে উঠিয়ে নিচ্ছেন। বুখারি। ২. শিক্ষাদান : নবী (সা.) শিশুদের শিক্ষাদীক্ষা এবং জীবন গঠনের প্রতি যত্নবান ছিলেন। তাই তাদের প্রতি অত্যধিক ভালোবাসা ও দরদ থাকা সত্ত্বেও অভিভাবকদের তিনি প্রয়োজনে শাসন করতেও গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর হলে নামাজের নির্দেশ কর, ১০ বছরে উপনীত হলে (তারপরও নামাজ না পড়লে) প্রহার কর এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দাও।’ মুসনাদে আহমদ। ৩. শিশুদের সঙ্গে মিথ্যা বলতে সতর্কবাণী : আমরা অনেক সময় শিশুদের সঙ্গে অনর্থক প্রতারণা করি। এটা-ওটা দেব বলে কাছে ডেকে নিয়ে আসি। তারপর আর তাকে কিছু দিই না। এতে শিশুর ওপর খারাপ প্রভাব পড়ে। নবীজি এমন করাকে খুব খারাপভাবে দেখতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমের (রা.) বলেন, এক দিন রসুল (সা.) আমাদের ঘরে বসা অবস্থায় আমার মা আমাকে ডেকে বললেন, আস, আমি তোমাকে কিছু দেব। রসুল (সা.) আমার মাকে বললেন, তুমি তাকে কী দেবে? আমার মা বললেন, তাকে খেজুর দেব। অতঃপর রসুল (সা.) তাকে বললেন, সাবধান! যদি তাকে তুমি কিছু না দিতে তাহলে তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যা লেখা হয়ে যেত।’ আবু দাউদ। ৪. অধিকার নিশ্চিত করা : বর্তমানে সবাই সবার নিজের অধিকার নিয়ে ব্যস্ত। অন্যের অধিকার আদায় করতে বড়ই নারাজ। নবীজি (সা.) শুধু বড়দের অধিকার আদায় করতে তালিম দিয়েছেন এমন নয়; বরং তিনি ছোটদের অধিকার আদায়ের প্রতিও সম্পূর্ণ সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন। তিনি শিশুদের সম্মান করতেন। তাদের অধিকার নিশ্চিত করতেন। সাহল ইবনে সাদ (রা.) বলেন, নবীজি (সা.)-এর কাছে পেয়ালা নিয়ে আসা হলো। তিনি এর থেকে পান করলেন। তার ডানে ছিল বয়সে ছোট একটি শিশু। আর বামে ছিল বয়সে বড় একজন ব্যক্তি। নবী (সা.) বললেন, বাছা! বড়জনকে (আগে) দেওয়ার ব্যাপারে তুমি কি আমায় অনুমতি দিচ্ছ? শিশুটি বলল, হে আল্লাহর রসুল, আমি আপনার থেকে কাউকে প্রাধান্য দিতে চাই না। তারপর নবীজি শিশুটিকেই (আগে) দিলেন।’ বুখারি। হাদিস শাস্ত্রবিদদের মতে, শিশুটি ছিল আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)। ৫. সমবেদনা জ্ঞাপন করা : নবীজি (সা.) শিশুদের অনুভূতির মূল্যায়ন করতেন। তাদের আনন্দে আনন্দিত হতেন। তাদের ব্যথায় ব্যথিত হতেন। আনাস ইবনে মালেক (রা.)-এর ছোট ভাইয়ের নোগায়ের নামে একটি পাখি ছিল। সে একে নিয়ে খেলা করত। পাখিটি মারা যাওয়ায় সে কষ্ট পায়। নবীজি জানতে পেরে তাকে দরদমাখা কণ্ঠে সান্ত¡না দিয়ে বললেন, হে আবু উমায়ের, তোমার নোগায়েরের কী হয়েছে?’ বুখারি। ৬. নবজাতকের সঙ্গে আচরণ : সাহাবায়ে কেরাম তাদের নবজাতক সন্তানদের নবীজি (সা.)-এর কাছে নিয়ে আসতেন। তিনি নবজাতককে চুম্বন করতেন। খেজুর দিয়ে তাহনিক করে দিতেন। বুকের সঙ্গে জড়াতেন এবং তাদের জন্য বরকতের দোয়া করে দিতেন। আবু মুসা আশআরি (রা.)-এর প্রথম সন্তান হলে নবীজি এমনটা করেছিলেন। নবীজির দাওয়াত, জিহাদ ও ইবাদত কোনো কিছুই শিশুদের সঙ্গে এ হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণের প্রতিবন্ধক হতো না। আল্লাহ আমাদের সবাইকে শিশুদের ভালোবাসার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : শিক্ষাসচিব ও সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ

সর্বশেষ খবর