বুধবার, ১ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

হামাগুড়ি দিয়ে মেরুদণ্ড খোঁজার মানুষ বাড়ছে

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

হামাগুড়ি দিয়ে মেরুদণ্ড খোঁজার মানুষ বাড়ছে

এক. হাওয়া বদলের সময় খুব পরিচিত কিছু শব্দ, কিছুটা সুবিধাবাদী সুবিধাবাদী ভাব, কিন্তু সেটা বোঝা খুব কঠিন। যেদিকে বৃষ্টি সেদিকে ছাতা, এই তো মানুষের চরিত্র! যেখানে কমেডি হয়ে যায় ট্র্যাজেডি, ট্র্যাজেডি হয়ে যায় কমেডি। অনেকটা এখনকার সিনেমার গল্প, লেখকদের লেখার মতো। সিনেমাটা দেখছি, গল্পটা পড়ছি, কিন্তু যাদের নায়ক-নায়িকা ভেবে ভেবে তাদের জন্য কষ্ট পাচ্ছি, ঠিক শেষটায় এসে টুইস্ট হয়ে গেল। একদম ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে শেষটায় বোঝা গেল যাদের ভিলেন ভেবেছিলাম তারাই ছিল নায়ক, যাদের নায়ক ভেবেছিলাম তারাই ছিল ভিলেন। কোনো কোনো সিনেমা-গল্পের শেষ থাকে না, উপসংহার টানাই কঠিন, কারণ তখনো চিন্তা খুঁজছে কে আসলে নায়ক, কে আসলে ভিলেন ছিল, নাকি নায়ক-ভিলেন কেউ ছিল না, সিনেমাটা সিনেমা ছিল না, গল্পটাই গল্প ছিল না। যেমন শেষটায় চায়ের কাপটা মেঝেতে পরে গেল, মার্বেল পাথরের মোজাইকে গড়িয়ে পড়ল গরম গরম চা। একটা লোক সেটা দেখে কাঁদল, তার কান্না ওই চায়ের ওপর পড়তেই সেটা নদী হয়ে গেল, নদীতে বরফ জমল, তারপর সুনসান নীরবতা, বরফের ওপর একটা আলপিন পড়তেই বরফটা আগ্নেয়গিরি হয়ে গেল, সেখান থেকে বেরিয়ে এলো একটা মুখ, আরেকটা মুখোশ। মুখটা নায়ক, না মুখোশটা নায়ক, নাকি দুটোই ভিলেন? প্রশ্ন নেই, উত্তর নেই। এরপর গল্প শেষ, সিনেমা শেষ। বাইরে বেরিয়ে দর্শকরা বলছেন, খুব ইন্টিলেকচুয়াল সিনেমা, এমন কন্সেপচুয়াল সিনেমা এর আগে বোধহয় পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি হয়নি, কিন্তু সত্যিটা হলো কেউ আসলে কিছুই বোঝেনি। না ছিল ওটা সিনেমা, না ছিল গল্প, না ছিল অভিনয়। যেন ঠোঙায় মোড়ানো ঝালমুড়ি ছিল সেটা, যখন খাচ্ছিলাম তখন খুব রোমাঞ্চ রোমাঞ্চ ভাব জেগেছিল, ভালো ভালো লাগছিল, খাওয়া শেষে ঠোঙাটা ফেলে দিতেই সব শেষ! কথাটা শুনেছিলাম, সত্য মিথ্যা জানি না। একটা তেলাপোকা জলরঙের ওপর পড়েছিল, রং লেগেছিল তার সারা শরীরে, এরপর সেখান থেকে নেমে একটা সাদা কাগজের ওপর এলোমেলোভাবে এদিক-সেদিক হাঁটতে লাগল। সেখানে হিজিবিজি রঙের একটা ছবি তৈরি হলো। একজনের মাথায় বুদ্ধি এলো, সে এ ছবিটা নিলামে তুলবে, ধনীদের বোকা বানাবে। যাই হোক, পৃথিবীর বিখ্যাত একটা চিত্রকর্মের জন্ম হয়েছে বলে লোকটা মোটামুটি ঢাকঢোল পিটিয়ে সারা শহরে জানিয়ে দিল। শহরের বড় বড় ধনীরা সেটা কিনতে এলেন। কিন্তু সত্যি কথা হলো, চিত্রকর্মের হিজিবিজি রংগুলোর কোনো গূঢ় রহস্য আছে কি না তা কেউ জানত না।

বরং না বুঝেই সবাই ছবিটার খুব প্রশংসা করতে লাগল, যে যার মতো নিজের জ্ঞান জাহির করার সুযোগ ছাড়ল না। এরপর নিলামে চড়া দামে একজন ছবিটা কিনে নিল। ছবিটা যে কিনল, সে জিতে গেছে ভেবে মনে মনে মুখ টিপে টিপে হাসল, বোকা মনে হলো তাদেরকে যারা নিলামে দাম হাঁকিয়েও এমন দুর্লভ ছবিটা কিনতে পারল না। আর যে ছবিটা বিক্রি করে পকেট ভরেছিল সে হো হো করে হাসতে হাসতে ভাবল মানুষের মতো বোকা আর পৃথিবীতে নেই। এখানেও টুইস্ট। কাকে ভালো বলব, যে ঠকাল তাকে, নাকি যে ঠকল তাকে। কে নায়ক, কে ভিলেন, তেলাপোকা না জলরং? ফ্ল্যাশ ফ্রিকশন, অতৃপ্তিটা থেকেই গেল।

এক রাজা ঘোষণা করলেন পরীক্ষা হবে, তার রাজ্যে এমন কোনো বীরপুরুষ আছে কি না যে তার বউকে ভয় পায় না। যেমন ঘোষণা, তেমন কাজ। সারা রাজ্যের প্রজারা রাজমহলের সামনে এসে হাজির হলো। রাজা ঘোষণা দিলেন, যারা বউকে ভয় পায় তারা বামপাশে যাবে, যারা ভয় পায় না তারা ডানপাশে যাবে। বামপাশটা মন্ত্রী, উজির, নাজির, প্রজাদের দিয়ে ভরে গেল, ওদের বউরা তো খুশিতে আটখানা। ডানপাশটায় কেউ নেই। রাজা এবার হাসতে হাসতে রানির দিকে তাকাতে তাকাতে বীরপুরুষের মতো ডানপাশে গিয়ে দাঁড়াল। সবাই জয়ধ্বনি দিল, জয় মহারাজের জয়, রানিও খুশিতে গদগদ করতে লাগল। রাজা রানিকে ভয় পায় না আর রানি এটাতে হাসছেন! খুব অদ্ভুত! আসলে ভিতরের বিষয়টা ঠিক অন্যরকম। মন্ত্রী, উজির, নাজির, প্রজা বউকে ভয় পেয়েই বামপাশে গেছে, এতে মিথ্যার কিছু নেই। কিন্তু রানি রাজাকে আগেই সতর্ক করেছিল, রাজা রানিকে ভয় পায় না এটা দেখানোর জন্য যেন ডানপাশে যায়। রানি জানে রাজা তাকে কতটা ভয় পায়, রাজা জানে রানিকে সে কতটা ভয় পায়। রাজা চালায় রাজ্য, রানি চালায় রাজাকে। কে বীরপুরুষ, কে কাপুরুষ, সেটা না বোঝাই ভালো। এটা নিছক গল্প হয়তোবা, এর বেশি কিছু নয়।

দুই. শঙ্খ ঘোষের হামাগুড়ি কবিতার একটা জায়গায় এসে থেমে গেলাম, থমকে গেলাম। একটু ভয় পেলাম, একটু বিব্রত হলাম। নিজের পিঠের দিকটায় হাত দিয়ে পরখ করে দেখলাম উনি যেটা খোঁজার কথা বলছেন সেটা আমার আছে কি না। খুব অদ্ভুত বিষয় হলো; শরীরের অংশটা আমার, অথচ আমি কখনো সেটাকে নিজের চোখে দেখতে পাইনি, পাবও না কোনো দিন, যদি না আমার মাথাটা যে বরাবর আছে, সে বরাবর না থেকে ঠিক ঘুরে বিপরীত দিকে চলে না যায়।

আমি বাদ দিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষ আমার শরীরের সেই অংশটা দেখতে চাইলে দেখতে পাবে। আমি নিজেরটা না দেখতে পেলেও সারা পৃথিবীর মানুষের শরীরের সেই অংশটা দেখতে পাব। দর্শনটা এমন, আমার চোখ আছে কিন্তু সেটা দেখার ক্ষেত্রে আমার চোখটা অন্ধ। আমি নিজের বলে যেটা দাবি করছি সেটা আমার হলেও আমার চোখ সেটা কখনো দেখতে পারছে না। আবার আমার নিজের চোখ দিয়ে আমার চোখকে আমি দেখতে পারছি না। খুব নির্মম এক অসহায়ত্ব, মানুষ নিজেকে মানুষ বলে দাবি করছে অথচ সেই মানুষটাকে নিজের চোখে দেখতে পারছে না। কপালে তখন ভাঁজ, যদিও সে ভাঁজও চোখের ওপরে থাকায় নিজের চোখ সেটা দেখতে পারছে না। তখন একটা রহস্য, আমরা মানুষ, কিন্তু আমার জায়গাটাতে আমি কি মানুষ, কতটা মানুষ? নিজেকে মানুষ বলে দাবি করা যায়, নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রমাণ করা কঠিন। প্রশ্ন হলো হামাগুড়ি দিয়ে যেটা খোঁজা হচ্ছে, সেটা আসলে কী। শঙ্খ ঘোষ যেমনটা বলেছেন,

‘কী খুঁজছেন?’

মিহি স্বরে বললেন তিনি ‘মেরুদণ্ডখানা।’

সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ ঝলকালো ফের। চমকে উঠে দেখি...

একা নয়, বহু বহু জন

একই খোঁজে হামা দিচ্ছে এ-কোণে ও-কোণে ঘরজুড়ে।’

একদম ঠিক, মেরুদণ্ডখানা। খুব পরিচিত একটা শব্দ, কিন্তু এর অর্থটা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। যেখানে কমেডি হয়ে যায় ট্র্যাজেডি, ট্র্যাজেডি হয়ে যায় কমেডি। অনেকটা এখনকার সিনেমার গল্প, লেখকদের লেখার মতো। সিনেমাটা দেখছি, গল্পটা পড়ছি, কিন্তু যাদের নায়ক-নায়িকা ভেবে ভেবে তাদের জন্য কষ্ট পাচ্ছি, ঠিক শেষটায় এসে টুইস্টিং হয়ে গেল। একদম ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে শেষটায় বোঝা গেল যাদের ভিলেন ভেবেছিলাম, তারাই ছিল নায়ক, যাদের নায়ক ভেবেছিলাম তারাই ছিল ভিলেন। কোনো কোনো সিনেমা-গল্পের শেষটায় যেন শেষ নয়, উপসংহার টানাই কঠিন, কারণ তখনো চিন্তা খুঁজছে কে আসলে নায়ক, কে আসলে ভিলেন ছিল, নাকি নায়ক-ভিলেন কেউ ছিল না, সিনেমাটা সিনেমা ছিল না, গল্পটাই গল্প ছিল না। বরং ঠোঙায় মোড়ানো ঝালমুড়ি ছিল, যখন খাচ্ছিলাম তখন খুব রোমাঞ্চ জেগেছিল, ভালো ভালো লাগছিল, খাওয়া শেষে ঠোঙাটা ফেলে দিতেই সব শেষ!

পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা মানুষদের মধ্যে আমি একজন, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না এটা কি মানুষের শরীরের সেই লতাপাতার মতো জড়ানো অংশ, না অন্য কিছু। যখন মনে পড়ল স্কুলজীবনের কমন পড়বে পড়বে বলে ভাবসম্প্রসারণের যে বিষয়টা ভার বা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু সে ভার বা বোঝা এখনো পর্যন্ত মাথা থেকে নামানো যায়নি বরং সেটাতেই এখনো হাবুডুবু খাচ্ছি তেমন একটা বিষয়, তখন একটু উদাস হলাম। ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ এ বিষয়টা আর কি। যেখানে শিক্ষা দেখছি, এর মেরুদণ্ডটা দেখছি না।

স্টিফেন হকিংসের কথা মনে পড়ে গেল। হুইল চেয়ারে বসা পৃথিবীর বুদ্ধিমান মানুষদের একজন। মোটর নিউরন ডিজিস নামে স্নায়ুতন্ত্রের একটা রোগে ভুগেছিলেন আমৃত্যু, যেখানে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ অকেজো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেরুদণ্ড ও আক্রান্ত হয়েছিল। আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের ভাষায়, মেরুদণ্ড ভেঙে পড়েছিল তার, অথচ মানুষটা ভেঙে পড়েননি।

ব্যক্তিত্বটাও ছিল অসাধারণ। নিজের মতো করে ভেবেছেন, কারও ভাবনার কাছে বিক্রি হয়ে যাননি। মানেটা খুব সহজ, মেরুদণ্ড কোনো বিষয় না। বিষয়টা হচ্ছে নিজের ব্যক্তিত্বে, নিজের চিন্তার স্বাধীনতায়, নিজের স্বকীয়তায়, নিজের বিবেকের দায়বদ্ধতায়। মানুষ বিক্রি হলে মানুষের মেরুদণ্ডটাই ভেঙে যায়। যেমন প্রতিদিন মানুষ বিক্রি হচ্ছে টাকার কাছে, মানুষের কাছে, লোভের কাছে, শক্তির কাছে, ঠুনকো ভালোবাসা-আনুগত্যের নামে দাসত্বের কাছে।

চারপাশে তাকিয়ে দেখছি, চেনা চেনা জনপদ, অচেনা অচেনা মুখ, যেখানে মানুষ নেই, প্রাণ আছে, আনন্দ নেই। সেখানে মানুষের জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে কেঁচো, আরশোলা, জেলিমাছ, তারামাছ, অক্টোপাস, শামুক, ঝিনুক, জোঁকের মতো মেরুদণ্ডহীন প্রাণীরা। জোঁক খুব কাপুরুষ, যে সন্তর্পণে রক্ত খায়, যেমন রক্ত খায় হামাগুড়ি দেওয়া একসময়ের মানুষেরা। একসময়ের মানুষ, যারা এক দিন মানুষ ছিল, এখন নিজেদের বিক্রি করেছে।

বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন বলেছিলেন, ‘কিছু মানুষকে ৭৫ বছরে দাফন করা হলেও তারা আসলে মারা গিয়েছিল ২৫ বছর বয়সেই।’ ভাবছি শরীরটা দেখে যাদের মানুষ ভেবেছিলাম, এখন ভাবছি তাদের শরীরটা আছে, মানুষটা নেই, ছিল না কখনো। মেরুদণ্ড পিঠে থাকে না, মানুষের মস্তিষ্কে থাকে।

লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট ও শিক্ষক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

সর্বশেষ খবর