ঘটনাবহুল একটি সপ্তাহ পার হলো। কথা ছিল ২৮ অক্টোবর শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ করবে বিএনপি। না সেই সমাবেশ শেষ পর্যন্ত আর শান্তিপূর্ণ হয়নি। হঠাৎ তাণ্ডবে তছনছ হয়ে গেছে বিএনপির মহাসমাবেশ। কথা ছিল জামায়াতকে রাজধানীর কোথাও সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না। সে কথাও ধোপে টিকেনি। পূর্ণ শক্তিমত্তা নিয়ে জামায়াত বিপুল কর্মী-সমর্থকের উপস্থিতিতে যথাযথভাবে সমাবেশ করেছে এবং বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পেশ করে নির্বিঘ্নেই ঘরে ফিরে গেছে। সেখানে টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট, ফাঁকা গুলি কিংবা সাউন্ড গ্রেনেড ফোটেনি। কথা ছিল বিএনপির সমমনা দলগুলো একই সঙ্গে রাজধানীতে সমাবেশ করে যুগপৎ চাপ প্রয়োগ করবে সরকারের ওপর। বাস্তবে তাদের অস্তিত্ব তেমনটা টের পাওয়া যায়নি। বিরোধী দলগুলোর প্রতি হালের আলোচিত ছাত্রনেতা ভিপি নূর আবেদন করেছিলেন তারা যেন রাজধানীতে তাদের অবস্থানে অনড় থাকে। সে কথাও রাখা হয়নি। আসলে কথা না রাখাই যেন এ যুগের প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে যে কথা না রাখার বিষয় আজ বারবার মনে উঁকি দিচ্ছে তার সূত্রপাত অনেক আগে।
আজ থেকে ৩৩ বছর আগের কথা। ১৯৯০ সাল। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখল করে গোটা মধ্যপ্রাচ্য তথা বিশ্বব্যাপী হইচই বাধিয়ে দিয়েছেন, যেমনটা এখন বেধেছে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও প্রথমবারের মতো অস্ত্র হাতে দেশ ছেড়ে সৌদি আরব গিয়েছিল সাদ্দামের সম্ভাব্য দখল থেকে মক্কা-মদিনা রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব নিয়ে। অন্যদিকে বাংলাদেশে তখন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পতন আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে। আন্দোলনরত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দল, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দল ও বামপন্থিদের ৫ দল মিলে এরশাদ-পরবর্তী সরকার ব্যবস্থা কীরূপ হবে, তার একটি রূপরেখা প্রণয়ন করেছিল। ১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর ওই তিনটি জোট আলাদা আলাদা সমাবেশে রূপরেখা তুলে ধরে। এর ১৫ দিনের মাথায় এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। এ ঘটনার পর কেটেছে ৩৩ বছর। এই ৩৩ বছরে বিএনপি দুই মেয়াদের কিছু বেশি সময় ও আওয়ামী লীগ তিন মেয়াদে দেশ পরিচালনা করেছে। মাঝে কিছু সময় দেশ শাসিত হয়েছে সেনাসমর্থিত সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সেই রূপরেখার প্রায় পুরোটাই আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়ায় যৌবনে পড়া সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতার সুরে বলতেই হয় “কেউ কথা রাখেনি, ৩৩ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি”। ওই রূপরেখার মৌলবাদ, স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ছিল। সব গণতান্ত্রিক দল মিলে তৈরি সেই রূপরেখা যদি একটি নতুন সামাজিক চুক্তি কিংবা জাতীয় সনদ কিংবা সংবিধানের অংশ হতো, তাহলে ৩৩ বছরে আমরা কোথায় থাকতাম? এই রূপরেখায় জাতীয় সংসদের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে ভোটারদের ইচ্ছামতো ভোট দেওয়ার বিধান নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। হত্যা, অভ্যুত্থান, ষড়যন্ত্রের রাজনীতির অবসান, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ‘সার্বভৌম সংসদ’ প্রতিষ্ঠা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মৌলিক অধিকার পরিপন্থি আইন রহিত করার ব্যবস্থা ইত্যাদি নানা অঙ্গীকার করে আশার আলো জ্বালিয়ে ছিল ওই রূপরেখা। সে সময় অভিন্ন অঙ্গীকার করে বলা হয়েছিল ‘...আমরা তিনটি জোটের নেতৃবৃন্দ সুষ্ঠুভাবে অবাধ ও নিরক্ষেপ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের নিম্নবর্ণিত অভিন্ন অঙ্গীকার পালনের জন্য আমাদের সব কর্মী ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’ তিন নম্বর ধারায় বলা হয়েছিল, ‘আমাদের তিনটি জোটভুক্ত দলসমূহ ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা এবং অপর দলের দেশপ্রেম ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কটাক্ষ করা থেকে বিরত থাকব। আমাদের জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলসমূহ সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় প্রদান করবে না এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণা সমবেতভাবে প্রতিরোধ করবে।’ চার নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘নির্বাচনী কার্যক্রমে সর্বতোভাবে সংঘাত পরিহার করার জন্য তিনটি রাজনৈতিক জোটভুক্ত দলসমূহ অঙ্গীকার করছে। সে জন্য এরশাদের স্বৈরাচারী সরকারের চিহ্নিত সহযোগী ও অবৈধ অস্ত্রধারীদের আমাদের জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলসমূহে স্থান না দেওয়ার জন্য আমাদের ইতিপূর্বে প্রদত্ত ঘোষণা কঠোরভাবে কার্যকর করা হবে। ভোটাররা যাতে স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে এবং ভোট কেন্দ্রে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকে সে বিষয়ে আমাদের তিনটি জোটভুক্ত দলসমূহ সতর্ক দৃষ্টি রাখবে।’ ৩৩ বছর পর এই নভেম্বরে আমাদের প্রিয় নেতারা সেই রূপরেখাটা একবার কি পড়ে দেখবেন? যদি লজ্জা লাগে, খুঁজে না পান বা সময় না মিলে, তবে সুনীলের কবিতার কয়েকটা লাইন অন্তত পড়তে পারেন, যেখানে লেখা “... তারপর কত চন্দ্রভুক অমাবস্যা চলে গেল, কিন্তু সেই বোষ্টুমি আর এলো না, পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায় আছি। ...কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখে না!”
ক্রিকেট বোর্ডের এক কর্তা বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাদের আমি বিশ্বকাপ দেখাতে নিয়ে যাব
সেখানে সাকিবরা দেখ কেমন করে ট্রফি জিতে!
কর্তা, আমরা আর কত বড় হব? আমাদের মাথা এই ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর আমাদের বিশ্বকাপ দেখাবেন?
৩৩ নয়, ৭৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনে আগুন জ্বলছে। ফিলিস্তিনের ওপর যেসব ভয়ংকর কনটেন্ট বা ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে, তা নিয়ে চরম বিতর্ক চলছে বন্ধু মহলে। কেউ বলে বিশ্ব জনমত বিশেষত মুসলমানদের সংগঠিত করতে এমন বীভৎসতার কথা সবার জানা উচিত। আবার অন্যদিকে এমন দৃশ্য দেখে দুর্বল চিত্তের মানুষ আরও অসুস্থ হবে কিংবা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এমন নারকীয়তাকে স্বাভাবিক বা ইতিহাসের অংশ মনে করলে আখেরে ক্ষতি হবে, এমনটাও ভাবছেন কেউ কেউ। তবে আমেরিকা চাইলে ফিলিস্তিনের সব হত্যাকাণ্ড জায়েজ আর ইউক্রেনে সব নাজায়েজ, এ থেকে আমাদের শেখার মতো অনেক কিছু আছে।
ফিলিস্তিনের গাজা থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার দূরে ঢাকায় হয়ে গেল গাঁজাখুরি আরেক কাণ্ড। নেশার জন্য গাঁজা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইতিহাসের অংশ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নওগাঁ অঞ্চল। নওগাঁ থেকে ৬৬ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বদিকে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলা। এই উল্লাপাড়ার এক ভদ্রলোক দীর্ঘদিন আমেরিকায় থাকেন। একদল উল্লুক মস্তিষ্কের মানুষ হঠাৎ করে উল্লাপাড়ার এই ভদ্রলোককে গাঁজাখুরি কায়দায় সাজালেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা। ২৮ তারিখের মর্মান্তিক পুলিশ ও রাজনৈতিক কর্মী হত্যা, হাসপাতালে আক্রমণ, গাড়ি ও পুলিশ বক্সে আগুন, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ভাঙচুরের মতো চেনা রাজনৈতিক সহিংসতার পুনরাবৃত্তিতে দেশবাসী যখন অচেনা ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত ও উৎকণ্ঠিত, ঠিক তখন উল্লুক মস্তিষ্কের কিছু মানুষের এমন হঠাৎ উদয় এবং উল্লাপাড়ার অচেনা মানুষটিকে উপস্থাপন সবার মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করে। পরে এই সাজানো নাটক নিয়ে যা জানা গেল, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। বিএনপির অফিসে রানা প্লাজা-খ্যাত এবং ইনসাফ পার্টির ভোজে যোগ দেওয়া এক জেনারেলের এমন উপদ্রব কার উৎসাহে হলো জানা গেল না। ইশরাকের মতো স্মার্ট ও শিক্ষিত মানুষটি কেন এই সাজানো উপদেষ্টার পাশে বসলেন, তাও জানা গেল না। বিএনপির কে বা কারা এমন কাণ্ড ঘটাল কিংবা কাঁচা কাজ করল, সে প্রশ্নের উত্তর মিলে না। আর বিএনপিকে হাসিরপাত্র বানাতে যদি অন্য কেউ এমন নাটক সাজিয়ে থাকে, তবে বলতেই হবে ভবিষ্যতে দলটিকে আরও বিপদে পড়তে হতে পারে। কদিন আগে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কেনা মশা নিধনের ওষুধ জায়েজ করতে মি. লি. শিয়াং নামক এক ব্যক্তিকে বিশেষজ্ঞ সাজিয়ে সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা হয়েছিল। পরে চীনের প্রকৃত ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের পাঠানো প্রতিবাদ লিপিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ওই ব্যক্তি ছিলেন ভুয়া বা সাজানো বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নয়। ওই ন্যক্কারজনক ঘটনার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন আরেকটা ঘটনা আমাদের কতিপয় রাজনৈতিক নেতার দৈন্যতা ও দুর্নীতি যে কোনো তলানিতে পৌঁছেছে, তা প্রমাণ করে। তাই চেনা অতীত, অচেনা অতিথি আর অজানা ভবিষ্যৎ নিয়ে সপ্তাহজুড়ে আশঙ্কার মাঝে ছিল সাধারণ মানুষ। তার ওপর দ্রব্যমূল্যের পাগলা হাওয়া বারবার কথা না রাখার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে সাধারণ মানুষকে।
সপ্তাহজুড়ে অস্থিরতার মাঝেও আশার আলো জ্বেলেছে ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’। কর্ণফুলী নদীর তল দিয়ে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র টানেলটি আমাদের সক্ষমতা ও এগিয়ে যাওয়ার নিদর্শন। ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকলেও টানেলের শেষের আলোকে অমিত সম্ভাবনার জীবন্ত প্রতীক বিবেচনা করা হয়। টানেল শেষের আলো নিয়ে পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই বহু প্রবাদ বা বচন রয়েছে। ইংরেজ সংগীত শিল্পী রে ফ্ল্যাক, অ্যান্ড্রু লোয়েড বেব্বের, উইলিয়াম রে প্রমুখ এ নিয়ে বহু আশা-জাগানিয়া গান গেয়েছেন। আবার অনেকে টানেল শেষের আলোকে দ্রুত এগিয়ে আশা ট্রেনের আলোর সঙ্গে তুলনা করে অন্ধকার টানেলে বা বিপদকালে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। আমেরিকায় জন্ম নেওয়া জেমস ব্রাঞ্চ ক্যাবেল বাহান্নটি বইয়ের লেখক ছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে ফ্যান্টাসি, সায়েন্স ফিকশন, উপন্যাস, কৌতুক, ছোটগল্পের সংগ্রহ, প্রবন্ধ এবং কবিতা। তার মতে আশাবাদী মানুষ টানেল শেষে দিনের আলো দেখে। আর সতর্ক মানুষেরা ট্রেনের আলোও হতে পারে, এই ভেবে টানেলে সতর্ক থাকে। বিশ্ব ও দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সর্ব মহলের সতর্ক থাকার বিকল্প নেই।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
email: [email protected]