শুক্রবার, ৩ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড ছিল একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা

ওয়ালিউর রহমান

বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড ছিল একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা

আজ ৩ নভেম্বর, জেলহত্যা দিবস। বাংলাদেশের ইতিহাসে দুটি ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। যার মধ্যে একটি ১৫ আগস্ট, অন্যটি ৩ নভেম্বর জেলহত্যার ঘটনা। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দ্বিতীয় কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয় এ দিনে। এ ঘটনাগুলো কারা ঘটিয়েছে তা সবাই জানে। অনেক হত্যাকারীর বিচার হয়েছে, আবার কিছু আসামি বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে আছে। তাদের ফিরিয়ে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সরকার।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। নবগঠিত এই সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর নির্দেশ মোতাবেক জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মুহাম্মদ মনসুর আলী এবং আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। গণতন্ত্র ও বাঙালি জাতির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন এই চার নেতা। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।

আমরা যেসব বাঙালি বিদেশে দায়িত্বরত ছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করি এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অবদান রাখি। তাদের সহযোগিতা ও সঠিক দিকনির্দেশনা ছাড়া একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে আরও কত লোকের প্রাণ বিসর্জন যেত তা কে জানে।

নরপিশাচরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আশঙ্কা করছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে এদের মধ্যে যে কোনো একজনও যদি বেঁচে থাকেন, তাহলে তাদের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে তখন বিদ্রোহী হন্তারক সেনারা বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না। জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল টপ সিক্রেট। এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা কেউ ভাবতেও পারেনি। কারাগারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় এমন জঘন্য, নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড-পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ইতিহাসের এ নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, স্তম্ভিত হয়েছিল সমগ্র বিশ্ব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড ছিল একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা।

বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারও যাতে না হয় সে জন্য ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ জিয়াউর রহমানের প্ররোচনায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে শাস্তি এড়ানোর ব্যবস্থা প্রদানের জন্য ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ আইন প্রণয়ন করে। এ কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার ২১ বছর বন্ধ ছিল। জেলহত্যার পরদিন তৎকালীন উপ-কারা মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রাখা হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার ঘটনায় প্রথম অনুসন্ধান কমিশন গঠিত হয় ১৯৮০ সালে, যুক্তরাজ্যে। ব্রিটিশ এমপি ও আইনবিদ স্যার টমাস উইলিয়ামসের নেতৃত্বে কমিশনে আরও ছিলেন আয়ারল্যান্ড সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী শন ম্যাকব্রাইড, ব্রিটিশ এমপি ও আইনবিদ জেফরি টমাস এবং ব্রিটিশ আইনবিদ, মানবাধিকারকর্মী ও পরিবেশবাদী আইনবিদ অবরি রোজ। তবে অনুসন্ধানের কাজে এ কমিশনকে বাংলাদেশে ভিসা দেয়নি জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকার। যার কারণে উদ্যোগটি সফল হতে পারেনি। এর মধ্য দিয়ে এটি স্পষ্ট হয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার সঙ্গে জড়িতদের প্রতি সামরিক সরকারের সরাসরি সমর্থন ছিল। তারা চায়নি এ হত্যার কোনো তদন্ত হোক বা বিচার হোক।

ওই অনুসন্ধান কমিশনের প্রতিবেদনটি শেখ মুজিব মার্ডার ইনকোয়ারি : প্রিলিমিনারি রিপোর্ট অব দ্য কমিশন অব ইনকোয়ারি শিরোনামে পুস্তিকা লন্ডনের র‌্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশন্স থেকে ১৯৮২ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয়। এর মুখবন্ধ লিখেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই দীর্ঘ ২১ বছর জিয়াউর রহমান ও সামরিক শাসন এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত বিএনপি সরকার এ কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে দেয়নি এবং হত্যাকারীদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেলহত্যা মামলার প্রক্রিয়ার কাজও শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য গঠিত জাতীয় আন্তর্জাতিক টাস্কফোর্সের সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ শুরু করি। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম এবং বিদেশি অনেক বাধাবিপত্তি কাটিয়ে অনেকের বিচারিক রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়েছে।

বিভিন্ন চ্যানেল, গোয়েন্দা সংস্থা এবং ইন্টারপোলের মাধ্যমে পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা সত্ত্বেও যেসব রাষ্ট্রে খুনিরা আত্মগোপনে আছে ওইসব রাষ্ট্রের সহযোগিতার অভাবে এবং তাদের আইনি জটিলতার কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচারিক রায় এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি।

সবচেয়ে দুঃখজনক যে, আজকে এই শতাব্দীতে যেখানে আমরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছি, দেশে-বিদেশে পৃথিবীতে বিভিন্ন রকমের প্রচার চালাচ্ছি সেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে দুটি বড় গণতন্ত্রের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার দুজন খুনি আসামিকে প্রশ্রয় দিয়েছে। এ এম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং এনএইচএমবি নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছে। এতে শুধু কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্তিমিত হয়নি বরং সমগ্র পৃথিবীর গণতন্ত্রকে একটা নির্মম আঘাত দিয়েছে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র ইতোমধ্যে ৫২ বছর অতিক্রম করেছে। ১৯৭৫ সালের পর থেকে দীর্ঘ সময় খুনিরাই দেশ শাসন করেছে। তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার অনেক তথ্য গায়েব করে দিয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পেছনে সে সময়ের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতিও ছিল। অনেকবার জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি উঠলেও এর বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার নেপথ্যের ঘটনা স্পষ্ট হতে হলে এবং হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কারা ছিল-সমাজে এবং রাষ্ট্রে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে তদন্ত কমিশন গঠন করা জরুরি। এ কাজে প্রয়োজন বিস্তারিত গবেষণা ও কঠোর সত্যনিষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি। যদিও কাজটি সহজ না, কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সত্যিকার ইতিহাসটা জানানো দরকার। ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বর যে ক্ষতি হয়েছে তার পূরণ কোনো দিন সম্ভব নয়। কিন্তু জাতিকে সম্পূর্ণরূপে কলঙ্কমুক্ত করার জন্য তদন্ত কমিশন গঠন এবং এর সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে খুনিদের মুখোশ উন্মোচন করে বিচারকার্য সম্পাদন করা দরকার।

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত

সর্বশেষ খবর