সোমবার, ৬ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

মেট্রোরেল আলো ছড়াল কাশবনের কোলে

অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরী

মেট্রোরেল আলো ছড়াল কাশবনের কোলে

সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে নানান আবর্তন-বিবর্তনে বদলেছে পৃথিবী, বদলেছে এ গ্রহে বসবাসকারী মানুষের জীবনধারা। বিজ্ঞানের বহুমুখী আবিষ্কার জীবনকে করেছে সহজ, সুন্দর আর সাবলীল। উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশও আজ আর পিছিয়ে নেই।  তিলোত্তমা ঢাকা নগরীর যেদিকেই যতদূর দৃষ্টি যায় প্রযুক্তির নিত্যনতুন শিল্পিত সৌন্দর্যে মন ভরে যায়। জলে, স্থলে, যাতায়াত ব্যবস্থায়, আকাশসীমায়, ভূগর্ভস্থ টানেলে, মেট্রোরেলের নির্মাণকাজে অভাবিত নব নব সংযোজন বাংলাদেশের মর্যাদাকে বিশ্বদরবারে রূপকথার গল্পের মতো নিমিষেই রূপান্তরিত উন্নত দেশের রোল মডেলে স্থাপন করেছে। আর এ রূপান্তরের মহান কারিগর বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। বলছি মেট্রোরেলের কথা। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর থেকেই পরিচিত-অপরিচিত অনেকের মুখেই শুনেছি মেট্রোরেলে ভ্রমণ করার শিহরণ জাগানো গল্প। ভাবিনি আমি কখনো ভ্রমণ করতে পারব! একটা কারণ তো রয়েছেই! সেটা হলো সাফোকেশন ফোবিয়া। বিষয়টি হাস্যকর হলেও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। আগারগাঁও স্টেশনে পৌঁছেই বেড়েছে ভীতি একই সঙ্গে এক্সাইটমেন্ট। বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর নাছিমা আপাসহ অগ্রজ অনুজ সহকর্মীরা অভয়বাণী শোনাতে লাগলেন অনবরত। সহযোগী অধ্যাপক এথিনা শক্ত করে আমার হাতটা ধরে বললেন, আপা চলেন তো! কিচ্ছু হবে না। আমরা আছি না। ওদিকে দোতলা স্টেশনে উঠে লোকজনের ভিড়ভাট্টা দেখে আমার ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। সময় গড়াচ্ছে আর আমি সংকুচিত হতে হতে নিজের হার্টবিট অনুভব করতে লাগলাম তীব্রভাবে। অনুজ সহকর্মী ছোটভাই ফজলে আমিন ইতোমধ্যে টিকিট কেটে ফেলেছে। অগত্যা দুরুদুরু বক্ষে এসকেলেটর সহযোগে তৃতীয় তলায় মেট্রোরেলের জন্য অপেক্ষা। বন্ধু মাহফুজা, ফরিদা আপা, লায়লা আপা, আতিকা, জেসমিন, শাপলাসহ সবার বিশেষ মনোযোগ তখন আমার দিকে। ফজলের নির্দেশনায় প্ল্যাটফরমের যথাস্থানে গিয়ে দাঁড়িয়েছি; মিনিটখানেকের মধ্যে শ্রবণসহিষ্ণু একটা আওয়াজ তুলে দ্রুতই ট্রেন এসে প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে মুহূর্তেই দরজাগুলো খুলে দিল। না বলার সুযোগ পেলাম না। মনে হলো অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে গিয়ে না জানি এবার কোন কান্ড ঘটিয়ে ফেলি। বসার আসনগুলো আগেই ফিলআপ থাকায় আমরা একঝাঁক ভ্রমণপিপাসু একসঙ্গে থাকার চেষ্টা করতে করতেই ট্রেন ছেড়ে দিয়ে এক মিনিটের মাথায় পরবর্তী স্টেশনের অডিওবার্তা শুনিয়ে থেমে যথারীতি আবার সদর দরজা খুলে গেল। থেমে যাওয়ার এ বিশেষ ব্যবস্থা দেখে আমার জানে পানি পেল আর ভয়ও কেটে গেল। সবার সঙ্গে একযোগে আনন্দভ্রমণে শামিল হয়ে পটাপট কয়েকটা স্ন্যাপশটে অংশ নিলাম। এবার সবাই খুশি, আর আমিও। যোগাযোগ ব্যবস্থায় মেট্রোরেলের অপূর্ব নন্দন শোভনীয় সংযোজন যেন বাঙালি জাতির জন্য নজিরবিহীন আশীর্বাদ, মেট্রোরেল এক মহাপরিকল্পনার আনন্দ সংবাদ। সব মিলিয়ে দিয়াবাড়ী স্টেশনে পৌঁছাতে ১৮ মিনিট সময় লেগেছে। অভাবনীয় বিস্ময়কর এক নব সংযোজন এই রেল। যানজটবিহীন শূন্যের রথে মেট্রো চোখের পলকে পথের সীমানা ছাড়িয়ে মাইলকে মাইল পেরিয়ে যাচ্ছে এঁকেবেঁকে। আমাদের আয়রন লেডি প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আবারও কৃতজ্ঞতা। দিয়াবাড়ী স্টেশনে নেমে বাহারি সব রেস্টুরেন্ট চোখে পড়ল। দুপুর গড়িয়ে বিকাল, ক্ষুধার্ত চোখে খাবারের খোঁজ করছি সবাই। ইতোমধ্যেই জেনে গেলাম সহযোগী অধ্যাপক নাহিদ সুলতানা এথিনা তাঁর কন্যা ছোট্ট নুরেনের ভালো রেজাল্ট উপলক্ষে তিনি আমাদের খাওয়াবেন মর্মে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই পূর্বপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফজলে খুঁজে খুঁজে কাশবনের মাঝে ‘উডনেস্ট’-এ আয়োজন সম্পন্ন করেছে। মূল রাস্তা থেকে ডানদিকে নেমে মাটির রাস্তা দিয়ে ফজলের নির্দেশনায় উডনেস্টে চলে এলাম। পথের দুই ধারে বুনোফুল আর দীঘলদেহি কাশফুলের ঘ্রাণে যেন মন ভরে উঠল। ওদিকে কাশবনের মতো বিচ্ছিন্ন দ্বীপে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সবুজঘেরা ছোট্ট রেস্টুরেন্টটা বিকালের স্নিগ্ধ আলোয় মায়া ছড়াল। আমরা কিছুক্ষণ ক্লিক ক্লিকে ব্যস্ত সময় পার করে ভূরিভোজনে রসনা বিলাসে মনোযোগ দিলাম। ধন্যবাদ এথিনাকে। নুরেন মনির জন্য আদর ও দোয়া রইল। 

ধূসর শুভ্র মোলায়েম কাশবনের আকর্ষণ উপেক্ষা করার উপায় নেই। শেষ বিকালের লালিমাময় প্রকৃতি আর কাশবন একাকার। কাশবন যেন এক মায়াময় ভ্রান্তিবিলাস। দূর থেকে দেখা কাশফুলের সৌন্দর্য টেনে নেয় আরও কাছে, কাছে গেলে সেই অনুভবে লুকোচুরি বাড়ে, বাড়ে কুহেলিকা। তবুও জুড়ি নেই বিস্তীর্ণ মাঠে অগুনতি লকলকে শুভ্র কাশের পেলব মেঘের মতো মাথা দোলানোর মোহচ্ছায়ায় আবিষ্ট করার। সবাই মিলে যে যার মতো করে ছবিও নিয়েছি, হেসেছি, আনন্দে মেতেছি। দিয়াবাড়ী এলাকায় বিভক্ত সেক্টর সংলগ্ন বিন্যস্ত মসৃণ রাস্তা আর সারি সারি গগনচুম্বী রাজউক নির্মিত নান্দনিক ফ্ল্যাট যেন সম্প্রসারিত আধুনিক ঢাকার বার্তা বহন করছে। পথের দুই ধারে উন্মুক্ত ফুলফলাদির ঘন সবুজ নার্সারি পথিকের দৃষ্টিকে করেছে বিভোর। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এলে বৌবাজারে বাহারি বৌদের স্থানীয় সবজি ফলের পসরা সাজিয়ে বসা বাজার দেখতে নিয়ে গেল ফজলে। ঘুরে ঘুরে গ্রাম্যমেলার স্বাদ নিয়েছি, বাজার না করলেও বৌদের কেনাবেচা দেখেছি; দেখেছি ওদের উজ্জ্বল মুখে বেলা শেষের আলো। ঢাকায় ফেরার তাগাদা অনুভব করছিলাম কিন্তু বেচারি ফজলে এত কষ্ট করে এত আয়োজন করেছে, ওর বাসায় এককাপ চা না খেলে পুরো আনন্দটাই মাটি হয়ে যেত।  ছোট বোন নীলা, মিসেস ফজলে মিষ্টি মেয়ে এ্যানি, খালুজান, সিনিয়র ফুপির আতিথিয়েতা মনে রাখার মতো। কিউট নীলার আফসোসের দুধ চা হবে অন্য কোনো দিন, আবার সবাই মিলে। নো টেনশন আপু। এবার মজা করে আনন্দে ফিরেছি আবারও মেট্রোরেলের যাত্রী হয়ে। ক্লান্তিহারা আনন্দধারা নিত্যই চলুক নদীর মতো গতিহারা...।

লেখক : দর্শন বিভাগ ও সম্পাদক, শিক্ষক পরিষদ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

সর্বশেষ খবর