মঙ্গলবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আমলার ভালোমন্দ

আফরোজা পারভীন

আমলার ভালোমন্দ

সম্প্রতি দুটি অনুষ্ঠানে দুজন প্রশাসনের কর্মকর্তার দেখা পেলাম। যাদের আমজনতা বিশেষ করে যারা পছন্দ করেন না তারা ‘আমলা’ বলতেই ভালোবাসেন। এবং বলেন খুবই নাক সিটকে বিরক্তির সঙ্গে। যেন আমলা মানেই খারাপ কিছু, পরিত্যাজ্য কিছু। এ দুজনই নারী কর্মকর্র্তা। দুজন একদম বিপরীত। একজন অনুষ্ঠানে এলেন। অনুষ্ঠানস্থলের সবাই এমনকি এলাকাবাসী তার অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি আসামাত্রই হাততালি শুরু হলো। তিনি স্টেজে উঠলেন, সৌজন্য বিনিময় করলেন, পুরোটা সময় রইলেন, বক্তৃতা করলেন। বক্তৃতার মাঝে তিনি বললেন, এলাকাবাসীর জন্য তার দরজা খোলা। যে কোনো সমস্যা নিয়ে বিনা দ্বিধায় যেন তারা তার কাছে যান। অনুষ্ঠান শেষে সবাই তার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। তার নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে এলাকাবাসী কতটা উপকৃত হচ্ছেন তা বললেন। এটাও জানালেন, যে কোনো লোক সহজেই যে কোনো সমস্যা নিয়ে এ কর্মকর্তার কাছে যেতে পারেন। তিনি তার আওতার মধ্যে থাকলে সহযোগিতা তো করেনই না থাকলেও অন্যকে বলে সাহায্য করার চেষ্টা করেন। সবার কথায় বুঝতে পারলাম তিনি কতটা জনবান্ধব। খুব ভালো লাগল। আমি তাকে বিপুল প্রশংসা করলাম। বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে যে তিনি এলাকার মানুষের সহায় হতে পেরেছেন, তাদের একজন হতে পেরেছেন এ জন্য ধন্যবাদ দিলাম। পরদিন আরেকজন এলেন। তিনি এলেন সময়ের অনেকটা পরে। খুবই বিরক্ত। তার চোখ-মুখ আচার-আচরণে ফেটে পড়ছে বিরক্তি। তিনি সেটা চেপেও রাখলেন না। টেলিফোনে একে ওকে বলতে লাগলেন, ‘আজ একটা ছুটির দিন। একটু বিশ্রাম নেব তার উপায় নেই। এই ফালতু অনুষ্ঠানে আমাকে আসতে হলো।’ তার বিরক্তি আশপাশের সবাই বুঝল। কেউ কেউ প্রকাশও করে ফেলল। তিনি কারও সঙ্গে কথা বললেন না। যেন বিরাট কিছু তিনি একটা। অথচ ওই মঞ্চে সেদিন যারা ছিলেন কেউই পদমর্যাদায় তার চেয়ে কম না। বক্তৃতাকালে তিনি একজন ছাড়া কাউকে সম্বোধন করলেন না। অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কহীন কিছু কথা বলে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই চলে গেলেন। তিনি যাবেন বলে অনুষ্ঠানের সূচি ওলটপালট করে তাকে বক্তব্য দিতে বলা হলো। এই যে দুজনের কথা বললাম দুজনের মধ্যে কত পার্থক্য! অথচ দুজনই প্রশাসনের কর্মকর্তা। বরং প্রথমজন দ্বিতীয়জনের চেয়ে জুনিয়র। কিন্তু তার জনসম্পৃক্তি আর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। আর দ্বিতীয়জন যে জনবান্ধব নন তা অল্প সময়েই বোঝা গেল।

প্রশাসনের চাকরির কোনো বাঁধাধরা সময় নেই। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের চাকরি সার্বক্ষণিক। যে কোনো প্রয়োজনে যে কোনো সময় তাদের ডাক পড়তে পারে। যেতে হতে পারে। তাদের কাজেরও কোনো বাঁধাধরা সংজ্ঞা নেই। এলাকার সব কর্মকান্ডের সঙ্গেই তারা যুক্ত থাকেন। তাই বন্ধের দিন বলে তাদের কিছু নেই। সম্প্রতি মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে অনেক আলোচনা। তাদের দুর্নীতি অদক্ষতা ক্ষমতার অপব্যবহার নারীলিপ্সার খবর আমরা প্রায় প্রতিদিনই পাচ্ছি এবং লজ্জিত হচ্ছি। এসব অভিযোগের কতটা সত্যি তা আমি জানি না। কিন্তু কথা হচ্ছে এসব অভিযোগ উঠবে কেন? মাঠের কর্মকর্তাদের হতে হবে দূরদর্শী, সাবধানে সতর্কতার সঙ্গে চলতে হবে তাদের। যেন তাদের আচার-আচরণ নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত না হয়। তারা কীভাবে চলবেন কী করবেন না করবেন সে বিষয়ে ‘আচরণ বিধিমালা’ আছে। আচরণ বিধিতে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া আছে তারা কী করতে পারেন আর কী করতে পারেন না। তাদের কাজকর্মের স্খলন ও শাস্তির বিধানও আছে ‘শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালায়’। শুধু আচরণ বিধিমালাটা মেনে চললেই সরকারি কর্মকর্তাদের কোনো ভুল করার কথা না। চাকরিতে ঢোকার পর থেকেই অনেক রকম প্রশিক্ষণ তারা গ্রহণ করেন। সেখানেও সবিস্তারে আলোচনা করা হয় কী তাদের করা উচিত কী করা উচিত না। তারপর প্রতিটি মানুষের তো বিবেক আর সাধারণ জ্ঞান আছে। তারা ভালো ছাত্র। বিসিএস পাস করে অনেক ধাপ পেরিয়ে এ চাকরিতে প্রবেশ করেন। প্রশাসন অনেক কিছু হারিয়েছে। চলে গেছে অনেক ক্ষমতা। হারাতে হারাতে আর তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই। তারপরও সামাজিক দৃষ্টিতে এটা একটা সম্মানজনক চাকরি। এ চাকরি পাননি বলে অনেকের অন্তর্জ্বালা আছে। যাদের এ জ্বালা আছে তারাই কথায় কথায় আমলাদের খুঁত ধরে, তাদের দক্ষতা যোগ্যতা নিয়ে কথা বলে। তাদের দুর্নীতি আর নারীলিপ্সার লম্বা লম্বা ফিরিস্তি দেয়। অথচ এদের একাংশ দিন-রাত আমলাদের তোষামোদী করে, তাদের পেছনে ঘোরে। নামকরা আমলাদের সঙ্গে পরিচয় আছে এ কথা বলে গর্ববোধ করে।

এ দ্বিচারী চরিত্র অনেকের আছে। এদের নিয়ে আমি ভাবি না। আমি ভাবি সেই আমলাদের নিয়ে যাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়। অতি সম্প্রতি দুজন আমলার নারী কেলেঙ্কারির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। ডিসি সাহেবরা এগুলো কী করছেন? তারা কী জানেন না তাদের দিকে অসংখ্য চোখ একযোগে তাকিয়ে থাকে! এলাকার উন্নয়নের জন্য ভালো অফিসার জ্ঞান করে তাদের পদায়ন করা হয়। কোনো নারীর সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার জন্য নয়। সরকার তাদের বেতন দেয় এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা উন্নয়ন সুরক্ষিত রাখার জন্য। তার রিপু তৃপ্তির জন্য নয়। তিনি নিজেই যদি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন আর সরকারের বোঝা হন তাহলে এমন কর্মকর্তা দিয়ে সরকার কী করবে! কিছুদিন আগে একজন মহিলা ইউএনও সাহেবের স্ত্রী দাবি করে সন্তানসহ তার অফিসের সামনে বসে ছিল। এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব চেষ্টা করেও এ ঘটনার সমাধান করতে পারেননি। দুজন কর্মকর্তা রাজনৈতিক মঞ্চে গিয়ে কোনো একটি দলের পক্ষে প্রকাশ্যে ভোট চেয়েছেন। এগুলো কি সরকারি কর্মকর্তার কাজ! তারা কি রাজনীতি করতে এসেছেন! তাহলে রাজনৈতিক দলে নাম লেখালেই পারতেন। আরেকজন তার বউ পরকীয়া করছে সন্দেহ করে হাসপাতালে ঢুকে দলীয় ক্যাডার দিয়ে স্ত্রীর সন্দেহভাজন প্রেমিককে পিটিয়েছে। এ নিয়ে দেশব্যাপী ঢিঢি ছিছি। এ কেমন কথা! যে মুহূর্তে আপনি চাকরিতে ঢুকলেন সেই মুহূর্ত থেকে আপনার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। আপনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। আপনার একমাত্র কাজ জনসেবা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের কোনো কোনো কর্মকর্তা ছাত্রজীবনে করা রাজনীতির সুফল হিসেবে ভালো ভালো পোস্টিং পাচ্ছেন। আর তিনি যে কোনো একটি দলে ছিলেন সেটা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। তাই দলীয় ক্যাডারের মতো আচরণ করছেন। ভাবছেন চুরি ডাকাতি স্বেচ্ছাচার চরিত্রহীনতা যাই-ই করেন না কেন পার পেয়ে যাবেন। বাস্তবে কিন্তু সেটা হয় না। জনরায় জনদাবিকে উপেক্ষা কেউ করতে পারে না। আপনারা কেউ পরিষদের বাগানের গাছ নষ্ট করায় ছাগল আটকে জরিমানা করছেন, কেউ মাস্ক না পরায় কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখছেন আবার কেউ রাতে মোবাইল কোর্ট বসাচ্ছেন। এসব কী? আপনারা কী প্রশাসনের ঐতিহ্য ভুলে গেছেন! অথচ এ প্রশাসনের কিছু অফিসারের কীর্তিতে মুখ উজ্জ্বল হয়। আমার বেশ মনে পড়ছে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ইউএনও শেখ জোবায়ের আহমেদের কথা। তিনি পদোন্নতি পেয়ে উপজেলা ছাড়ার সময় অশীতিপর বৃদ্ধসহ এলাকাবাসী কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন। একজন মধ্যবয়সী নারী কাঁদতে কাঁদতে স্থানীয় ভাষায় যা বলেছিলেন তার মানে, ‘ইউএনও চলে যাচ্ছে, এখন আমাকে কে দেখবে।’ একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বুক চাপড়ে কেঁদেছিলেন। তাকে চৌমুহনী বাজারে দোকান করে দিয়েছিলেন ইউএনও সাহেব। ফুল ছিটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তাকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন বহুদূর পর্যন্ত। এসব গল্প পড়লে আনন্দে বুক স্ফীত হয়ে ওঠে। জোবায়ের এক্সট্রা কিছু করেননি। নিজের কাজটুকু আন্তরিকতার সঙ্গে করেছেন। তিনি জনবান্ধব ছিলেন। এলাকার মানুষ যে কোনো প্রয়োজনে সহজে তার কাছে আসতে পারত। তিনি শুনতেন, সাহায্য করতে চেষ্টা করতেন। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলা ইউএনও সুমন দাস আর নওগাঁর রানীনগর উপজেলার ইউএনও শাহাদাত হুসেইনের বিদায় বেলায়ও ঘটেছিল একই ঘটনা। এমন ঘটনা আরও আছে।

করোনা মোকাবিলায় অসামান্য সাফল্য দেখিয়েছিলেন মাঠ প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তা। পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া ফেরদৌসসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার নাম তখন ছিল সবার মুখে মুখে। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে গেছেন। খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। ঘূর্ণিঝড়, আম্ফান, বন্যা, অগ্নিকান্ডসহ যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রাণ বাজি রেখে কাজ করেছেন। তবে দুঃখের কথা এটাই যে, তারা ভালো কাজ করলে প্রশংসা তেমন হয় না। খারাপ কাজ করলে তা মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। পুরো চাপটা এসে পড়ে গোটা প্রশাসনের ওপর। তাদের লেখাপড়া সততা চরিত্র নিয়ে যেসব কথা হয় তা উল্লেখ করার মতো নয়। এমন কথাও শুনি যে, বাংলাদেশ না হলে নাকি এসব কর্মকর্তারা কেরানিও হতে পারত না। যারা এসব কথা বলেন তারা যে বাংলাদেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন সেটাও বোঝেন না। অথচ ঘুষ-দুর্নীতি চরিত্রহীনতা অদক্ষতা সব চাকরিতেই আছে। তাদেরগুলো দেখা হয় সহানুভূতির সঙ্গে, যেন এটাই স্বাভাবিক। আর প্রশাসনে কিছু হলেই গেল গেল রব ওঠে।

প্রশাসনে এখন নানা দল মত আর বর্ণের সমন্বয়। সব নাও যেন এসে ভিড়েছে একই ঘাটে। কোটা আর অপশনের সুযোগে এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ক্যাডারের লোকজন। তারা ডিসি হচ্ছেন, কমিশনার সচিব হচ্ছেন। এত লোক এক জায়গায় জড়ো হলে কিছু বিশৃঙ্খলা হওয়ার সম্ভাবনা থাকেই। সবার প্রশিক্ষণ, পড়াশোনা একরকম নয়। সব চাকরির ধরনও এক নয়। অন্য চাকরি থেকে হঠাৎ করে এ চাকরিতে এসে মানিয়ে নেওয়াও কঠিন। তার মানে এই নয় যে, খোদ প্রশাসনের যারা তারা সবাই দক্ষ, কর্মঠ, সৎ!  তারপরও বলব মাঠ প্রশাসনে যাদের নিযুক্ত করা হয় তাদের একটু দেখেশুনে আগের রেকর্ড যাচাই করে পদায়ন করা জরুরি। নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িত একজন কর্মকর্তার আগেও এ ধরনের কাজের রেকর্ড রয়েছে। তারপরও তিনি কী করে এ পদায়ন পান! এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মনে রাখা দরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে কখনো জনগণের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। মানুষের কাছে যেতে হবে, তাদের অভাব অভিযোগ শুনতে হবে, সমাধানের পথনির্দেশ দিতে হবে। ১০টা-৫টা অফিস করার মানসিকতায় যারা চাকরি নিয়েছেন এ চাকরি তাদের জন্য নয়। এ চাকরি জনবান্ধবদের জন্য। যেমন একজনের কথা আমি শুরুতে লিখেছি। পুরো এলাকাবাসী যার অপেক্ষায় থাকেন। যাদের হারিয়ে এলাকাবাসী কাঁদেন!

লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক, সাবেক যুগ্মসচিব

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর