মঙ্গলবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

দুই রাজনৈতিক দলের রসায়ন

মোশাররফ হোসেন মুসা

দুই রাজনৈতিক দলের রসায়ন

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের অনুপাত কাছাকাছি। তাদের শ্রেণি চরিত্রেও তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তবে আওয়ামী লীগের রয়েছে কর্মীনির্ভরতা, আর বিএনপির ভোটারনির্ভরতা। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির রয়েছে এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ইতিহাস। সে জন্য দুই দলের আন্দোলনকে প্যারালাল করা ঠিক হবে না। ১৯৯১ সালে বিএনপি ও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে প্রমাণ করে তারা ভোটের দিক থেকে কেউ কারোর চেয়ে কম নয়। আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে ও ২০১৮ সালে বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছে। বিএনপি ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন করে কেন যে সফল হতে পারছে না-তা এখন প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটারদের ওপর জরিপ করলে দেখা যাবে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারই দলীয় কিন্তু বিএনপির সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট হলো পপুলার ভোট তথা ভাসমান ভোট। পপুলার ভোটাররা সরাসরি কোনো দল করে না; তবে তাদের দলীয় কর্মীতে রূপান্তরিত করা যায়। বিএনপির জন্ম ১৯৭৮ সালে। সে হিসাবে বিএনপির বয়স প্রায় ৪৫ বছর (ক্ষমতায় ছিল ১৬ বছর)। এ দীর্ঘ সময়ে সমর্থকদের দলীয় কর্মীতে রূপান্তরিত করতে না পারাটা চরম অযোগ্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ১৯৭৫ সালে পটপরিবর্তনের পর সমগ্র দেশে আওয়ামী লীগবিরোধী একটি সস্তা সেন্টিমেন্ট গড়ে উঠেছিল। সেই সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে জিয়াউর রহমান প্রথমে ‘জাগদল’ পরে বিএনপি নামক দল গড়ে তোলেন। বিএনপিতে চীনাপন্থি ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টিসহ স্বাধীনতাবিরোধীরা জড়ো হয়। চীনাপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি ভোট বিশ্বাস করে না। ফলে তাদের ভোটের কোনো ঐতিহ্য নেই (এদের কুপ্ররোচনায় মওলানা ভাসানী ’৭০ সালের নির্বাচন বর্জন করেন)। তারা মাথায় অন্য চিন্তা রেখে বিএনপিতে যোগ দেয়। বিএনপিকে একটি গণতান্ত্রিক দলে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে তাদের কোনো অবদান দেখা যায় না। বর্তমান বিএনপিতে যারা আছেন তাদের অধিকাংশই সেই ধারারই অনুসারী। তাছাড়া বিএনপির সঙ্গে যারা জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করছেন তারা নির্বাচনকে নীতি নয়, কৌশল মনে করে। গণতান্ত্রিক দল মানেই নির্বাচন বিশ্বাস করা। নির্বাচনি ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করে একজন সমর্থক দলীয় কর্মীতে রূপান্তরিত হয়। তাছাড়া বর্তমান বিএনপিতে নেতৃত্বের সংকট প্রকট। খালেদা জিয়া অসুস্থ, তারেক জিয়া ও তার স্ত্রী জোবাইদা রহমান দেশের বাইরে। মাঠ থেকে উঠে আসা কোনো নেতাকে দীর্ঘ সময় ধরে কেন্দ্রে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় না। আবদুল মান্নান ভূঁইয়া (প্রথমে যুগ্ম মহাসচিব, পরে মহাসচিব) এবং মির্জা ফখরুল ইসলাম কিছুটা ব্যতিক্রম। আবদুল মান্নান ভূঁইয়া যখন মহাসচিব ছিলেন তখন বিএনপি একটি শক্তিশালী দল হিসেবে মর্যাদা পায়। অনেকে মনে করেন, বর্তমান মহাসচিব স্বাধীনভাবে নেতৃত্ব দিতে পারছেন না বলে দলটি শক্ত অবস্থানে যেতে পারছে না। বিএনপির জন্ম ঘটেছে মধ্য ডানপন্থি অবস্থান থেকে। কিন্তু দলটিতে আদর্শিক দুর্বলতা থাকায় নেতা-কর্মীরা মধ্য ডানপন্থি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়।

দলটি এরশাদবিরোধী আন্দোলন করে জনগণের কাছ থেকে এক ধরনের বৈধতা আদায় করে নেয়। কিন্তু পরবর্তীতে সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা না করে ডানপন্থার দিকে ঝুঁকতে থাকে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ইসলামী জাতীয়তাবাদের মিশ্রণ ঘটায় জামায়াতে ইসলামী লাভবান হয়েছে বেশি (ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ কখনো গণতন্ত্র নিয়ে আসে না)। তাদের দাবি ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ আওয়ামী লীগের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের চেয়ে বেশি আধুনিক। তাদের ১৯ দফার শেষ দফায় লেখা আছে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ করা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করা। কিন্তু বাস্তবে তাদের শাসনামলে পাহাড়ি আদিবাসীসহ সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয়েছে বেশি।

২০১৪ সালের আন্দোলনের সময় ভারতের বিজেপির তৎকালীন সভাপতি অমিত শাহের টেলিফোন নাটক এবং গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা নাটক প্রমাণ করে দলটি নিজেদের নেতা-কর্মীদের ওপর আস্থাশীল নয় বরং পুরোপুরি বৈদেশিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। কোনো নির্বাচনই তারা বয়কট করে না। তারা যখন বিরোধী দলে থাকে তখন তৃণমূল পর্যায়ে কাউন্সিল করে দলকে সংগঠিত করার চেষ্টা করে। দেশের সব স্তরে তাদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে। তাছাড়া এ দলটিতে শেখ হাসিনার একক নেতৃত্ব রয়েছে। তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার ইতোমধ্যে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করেছে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে। আওয়ামী লীগ কখনো বলে না তারা বাকশাল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে। তারা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিত্য-নতুন কর্মসূচি হাতে নেয়। যেমন- নারীর ক্ষমতায়ন, আশ্রয়ণ প্রকল্প, একটি বাড়ি একটি খামার, কমিউনিটি ক্লিনিক ও শিশু বিকাশ, সামাজিক নিরাপত্তা, আমার গ্রাম-আমার শহর, ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ, সর্বজনীন পেনশন ভাতা ইত্যাদি। তারপরও আওয়ামী লীগের স্বার্থে সর্বোপরি দেশের স্বার্থে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার। একটি দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে নেতা-কর্মীদের স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধিসহ সন্ত্রাস-দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। এ দেশে বড় দুটি দল ওয়েস্ট মিনিস্টার ধাঁচের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। কিন্তু দল দুটির দীর্ঘ শাসনে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পাওয়ায় রাজনীতি কলুষিত হয়ে পড়েছে। তার স্পষ্ট ছাপ শিক্ষা, চিকিৎসা, পুলিশ বিভাগসহ সর্বত্র লক্ষণীয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৪০.৮৬% ভোট পেয়ে ১৯৩টি আসন এবং আওয়ামী লীগ ৪০.২১% ভোট পেয়ে মাত্র ৬২টি আসন লাভ করে। সে জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না তুলে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের দাবি তোলা অধিক যুক্তিযুক্ত। তাহলে গণতন্ত্রের নামে ব্যক্তির স্বৈরশাসনের কোনো সুযোগ থাকবে না। জনৈক মনীষী বলেছেন, মানুষের ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক, ভুলটাকে মেনে নেওয়া সংস্কৃতি আর ভুলটাকে শোধরানোটা প্রগতি।

লেখক : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক

সর্বশেষ খবর