বুধবার, ৮ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

’৭২-এর সংবিধান নস্যাৎকারীরাই নৈরাজ্যের স্রষ্টা

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

’৭২-এর সংবিধান নস্যাৎকারীরাই নৈরাজ্যের স্রষ্টা

বাংলাদেশ সরকার ৪ নভেম্বরকে সংবিধান দিবস হিসেবে উল্লেখ করেছেন, কারণ ১৯৭২-এর সেই দিনটিতেই গণপরিষদে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল। উক্ত বছর নভেম্বর মাসের পূর্বেই ঘোষণা করা হলো, সে মাসেরই ৪ তারিখ ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদে বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান উপস্থাপন করবেন। খবরটি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, পণ্ডিত ব্যক্তি এবং বিজ্ঞজনেরা বেশ অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, এটা কি সম্ভব? ৯ মাসেরও কম সময়ে একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের সংবিধান রচনা কী হতে পারে? বিস্ময়েরই কথা, কেননা যেখানে ড. আম্বেরকারের মতো বিশ্বনন্দিত সংবিধান বিশেষজ্ঞর নেতৃত্বে ভারতের সংবিধান প্রণয়ন করতে লেগেছিল আড়াই বছর, পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান করতে লেগেছিল ৯ বছর, সেখানে ৯ মাসে কী করে একটি দেশের সংবিধান হতে পারে? অনেকে এটাও সন্দেহ করেছিলেন যে, বাংলাদেশের সংবিধান হয়তো পাকিস্তানের সংবিধানেরই অনুরূপ একটি গোঁজামিলের শাসনতন্ত্র হবে। ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের জনক এ ধরনের সংবিধান প্রদান করবেন সেটি জানার জন্য ঢাকা শহর লোকায়িত হয়েছিলেন বহু ঝানু বিদেশি সাংবাদিক, যাদের অনেকেই ছিলেন আইন বিশেষজ্ঞও। অবশেষে বঙ্গবন্ধু তাঁর খসড়া উপস্থাপন এবং ভাষণ দেওয়ার পর সবার মুখে একই কথা, বাংলাদেশের জাতির জনক তো এক তুলনাহীন, অভাবনীয় মহাপুরুষ, প্রজ্ঞায় তিনি স্বর্গের বরপ্রাপ্ত। দেশে-বিদেশে সবাই মিলিত সুরে বললেন, “এই যে এক অচিন্তনীয় সৃষ্টি, এই সংবিধান তো এক অর্থে তুলনার ঊর্ধ্বে।” এটি বলারই কথা, কেননা অনেক অর্থেই সংবিধানটির নমুনা বিরল। সংবিধানে প্রচ্ছন্ন ভাষায় উল্লেখ করা হলো, জনগণই সব ক্ষমতার মালিক। জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা এমন স্পষ্ট ভাষায় আর কোনো সংবিধানে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের কালজয়ী প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের দ্বারা জনগণের সরকার, কিন্তু সে দেশের সংবিধানে জনগণকে ক্ষমতার মালিক করার এমন স্পষ্ট কোনো কথা নেই।

বাংলাদেশের সংবিধানের অনেক বৈশিষ্ট্যের অন্যতমটি হচ্ছে- এর তৃতীয় অংশে ২০টি বিধান যাতে মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করা হয়েছে। এসব অধিকার যাতে প্রতিটি মানুষ প্রয়োজনে আদালতের আশ্রয় নিয়ে বাস্তবায়িত করতে পারেন তারও ব্যবস্থা করা হয়েছে হাই কোর্টে ১০২ অনুচ্ছেদে মুদ্রিত জুডিশিয়াল রিভিউ পদ্ধতির মাধ্যমে। এসব অধিকারের সব নাগরিকদের মধ্যে সীমিত থাকলেও একটি অধিকার, যথা আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, নাগরিকত্ব নির্বিশেষে বাংলাদেশে অবস্থানরত সব মানুষের বেলায় প্রযোজ্য করা হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশসমূহে এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সেসব প্রয়োজনীয় সীমাবদ্ধতাসহ সব নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা রয়েছে ’৭২-এর সংবিধানে। সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে উল্লিখিত মৌলিক অধিকারসমূহে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ গৃহীত সর্বজনীন মানবাধিকারের সবকটি বিধানই রয়েছে। এসব বিধান সংবিধানের মৌলিক স্তম্ভ বলে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে এগুলো মুছে ফেলার সুযোগ নেই।

’৭২-এর সংবিধানের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো- স্পষ্ট মুদ্রণ দ্বারা ধর্মনিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা। পৃথিবীর অনেক দেশেই ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে থাকে বাস্তবতায়। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে যে ভাষায় ধর্মনিরপেক্ষতার নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে, তা সত্যিই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। বলা হয়েছে, সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার বিলোপ করা হবে। আরও উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে মর্যাদা দান করবে না, কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার ওপর উৎপীড়ন করা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার মতবাদ মধ্যযুগের ইউরোপীয় তত্ত্ব থেকে আলাদা। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে ধর্মহীনতার আশ্রয় নেননি, বরং সব ধর্মে বিশ্বাসী মানুষকে অবাধে নিজ নিজ ধর্ম চর্চার অধিকারের কথা বলেছেন। বলেছেন, রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান করবে না, ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য চলবে না। ভারতেরও আদি সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ছিল না। ১৯৭৬ সালে তাদের সংবিধানের ৪২তম সংশোধনের মাধ্যমে এই তত্ত্ব সংযোজন করা হয়।

আমাদের সংবিধানের আর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কতগুলো মৌলিক রাষ্ট্রীয় নীতিমালার কথা। এগুলো জুডিশিয়াল রিভিউর আওতাভুক্ত না হলেও আদালত বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা করতে এসব নীতিমালা অনুসরণ করে থাকেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, স্বাস্থ্যসেবা, অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রদানের কথা, জাতীয় জীবনে নারীদের অধিকারের কথা, জাতীয় সংস্কৃতির কথা। নাগরিকদের প্রতি সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্বের কথা উল্লেখ করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপনিবেশ যুগীয় মনিবসুলভ ভাবধারা উচ্ছেদ করে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, সরকারি কর্মকর্তারা জনগণের মনিব নন, বরং তাদের সেবা প্রদানকারী।

বিখ্যাত ফরাসি পণ্ডিত মনটেস্কোর ভাষ্য অনুযায়ী একটি রাষ্ট্রের তিন ধরনের ক্ষমতা একক কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত থাকলে সেখানে নৈরাজ্য বিরাজ করতে বাধ্য আর সেই ধারণা অনুসরণ করেই সৃষ্টি হয়েছে ক্ষমতার বিভাজন তত্ত্ব। বাংলাদেশের সংবিধানে ক্ষমতার বিভাজনের আদর্শ অনুসরণ করা হয়েছে, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ অর্থাৎ প্রশাসন অঙ্গ, আইন প্রণয়ন অঙ্গ এবং বিচার অঙ্গের অধিক্ষেত্র চিহ্নিত এবং নির্ধারিত করা হয়েছে, যার ফলে অতীব প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র ছাড়া একটি অঙ্গ অন্য অঙ্গের অধিক্ষেত্রে কর্তৃত্ব চালাতে পারে না। বাংলাদেশের সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারকদের স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা করা হয়েছে যাতে প্রশাসন, এমনকি রাষ্ট্রপতিও বিচারপতিদের অপসারণ করতে না পারেন। নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাও রয়েছে হাই কোর্টের ওপর। সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ দ্বারা আপিল বিভাগকে পূর্ণাঙ্গ ন্যায়বিচারের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে, যার ফলে কোনো ব্যক্তি ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য আইনের কোনো বিধানের আওতায় নিজেকে না আনতে পারলেও আপিল বিভাগ তার বিশেষ ক্ষমতাবলে সেই ব্যক্তিকে ন্যায়বিচার প্রদান করতে পারেন। ১০৫ অনুচ্ছেদে রয়েছে রায় প্রদান করা হয়ে গেছে, রিভিউর মাধ্যমে এমন মামলার পুনর্বিচার।

এহেন ঈর্ষণীয় সংবিধান হায়েনাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়া-মোশতাক চক্র বন্দুকের জোরে, সংবিধানবহির্ভূতভাবে ক্ষমতা দখল করে, ১৯৭২ সালের সেই পবিত্র এবং অনন্য সাধারণ সংবিধানকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাসহ বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ মুছে ফেলে। জিয়া গংদের সামরিক স্বৈরশাসন এবং পরবর্তী জিয়া অনুসারীরা জিয়া কর্তৃক সংবিধানে যেসব ঘৃণ্য পরিবর্তন ঘটিয়েছিল, পঞ্চম এবং সপ্তম সংশোধনী মামলা রায় দ্বারা সেগুলো বাতিল করা হয়। সাংবিধানিক অর্থে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ উল্লিখিত দুই মামলার রায়ে জিয়া এবং এরশাদের সামরিক ফরমান দ্বারা সংবিধানে যেসব অনাকাক্সিক্ষত পরিবর্তন ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাময় বৈশিষ্ট্যসমূহ মুছে ফেলে একে ধর্মান্ধ রূপ দেওয়া হয়েছিল সেগুলো থেকে সংবিধানকে মুক্ত করা হয়েছে। নিশ্চিত করা হয়েছে যে, এই পন্থায় ক্ষমতা দখল রাষ্ট্রদ্রোহিতার নামান্তর এবং ভবিষ্যতে কোনো উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ এ ধরনের অপপ্রয়াস চালালে তাকে চরম দণ্ড পেতে হবে। একাত্তরে পরাজিতদের বংশধররা আজ দেশে যে নৈরাজ্য চালাচ্ছে তার সূত্রপাত ’৭২-এর পবিত্র সংবিধান নস্যাৎ করার মাধ্যমে।

সংবিধানে প্রতিফলিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনের প্রত্যাশার চিত্র। শৈশবকাল থেকেই তিনি বেড়ে উঠেছেন গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং বৈষম্যবিরোধী মানুষ হিসেবে। বয়োপ্রাপ্তির পর তাঁর মনে গভীরভাবে আসন গেড়েছিল আইনের শাসনের তত্ত্ব। উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আইনবিশারদ ব্যারিস্টার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাহচর্যে তিনি আইন বিষয়ে অনেকাংশেই দক্ষতা লাভ করে সাংবিধানিক এবং আইনের শাসনের প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগী হয়ে পড়েছিলেন। পাকিস্তানি দিনগুলোতেও, বিশেষ করে আইয়ুবি যুগের স্বৈরশাসনকালে, তিনি গণতান্ত্রিক অধিকার এবং আইনের শাসন আদায়ের জন্য গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যে কারণে তাকে বহু বছর কারাবরণ করতে হয়েছিল।

সংবিধান যেন বিশ্বনন্দিত হয় তা নিশ্চিত করার জন্য তিনি গণপরিষদের ৩৪ জন আইন বিশেষজ্ঞ সদস্য সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। এই ৩৪ জনের হাতে খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি প্রতিনিয়ত তাদের নির্দেশনা প্রদান করতেন সংবিধানে যেন কাক্সিক্ষত আইনের শাসন, গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং রাষ্ট্রীয় মূল নীতিসমূহ প্রতিফলিত হয়। তিনি বিশ্বের বহু দেশের সংবিধান এবং জাতিসংঘ প্রণীত মানবিক অধিকার সংবলিত নির্দেশনাসমূহ আনয়ন করে উক্ত ৩৪ জন সদস্যকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেসব সংবিধান এর কোন কোন বিষয়সমূহ আমাদের সংবিধানে স্থান পাবে। আরও নির্দেশ দিয়েছিলেন জাতিসংঘ প্রণীত মানবাধিকার বিষয়ক সিদ্ধান্তগুলোও যেন আমাদের সংবিধানে স্থান পায়। সংবিধানের খসড়া গণপরিষদে উপস্থাপনের আগের দিন বঙ্গবন্ধু উক্ত ৩৪ জনের সঙ্গে ভাওয়ালের এক রেস্ট হাউসে সমস্ত দিন বৈঠক করেছিলেন চূড়ান্তভাবে খসড়ার বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা এবং প্রয়োজনে পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা সংশোধনের জন্য, যে কথা আমি বিশিষ্ট রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ সাহেব থেকে শুনেছি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে তিনিও সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

তথাকথিত দ্বিজাতি তত্ত্বের স্লোগান গোটা উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে যে কৃত্রিম দূরত্ব এবং বৈরিতা সৃষ্টি করেছিল, বঙ্গবন্ধু তা কোনো দিনও মেনে নিতে পারেননি। ১৯৪৬ সালে সেই দ্বিজাতি তত্ত্বের ফেরিওয়ালাদের উসকানিতে গোটা উপমহাদেশ উভয় ধর্মের লাখ লাখ মানুষের রক্তে রঞ্জিত হওয়ার ঘটনা সচক্ষে প্রত্যক্ষ করার পর বঙ্গবন্ধু মারাত্মকভাবে ব্যথিত হয়ে পড়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী এবং মহাত্মা গান্ধীর দিকনির্দেশনায় সেদিনের তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব ছুটে গিয়েছিলেন সমস্ত উপদ্রুত এলাকায়, এমনকি বঙ্গভূমির বাইরেও। সেই দিনগুলোর রক্তপাতের করুণ দৃশ্য একদিকে যেমন তাঁকে বিচলিত করেছিল, অন্যদিকে তেমনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছিল সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবল চিরতরে নিঃশেষ করে দিতে। তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ সমাজই কুসংস্কার আচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে সমাজকে রক্ষা করতে পারে। সংবিধানের খসড়া উপস্থাপনকালে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর তিনি গণপরিষদে যে ভাষণ দিয়ে সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহের কথা উল্লেখ করেছিলেন, সে ভাষণও পৃথিবীর বহু মনীষীর শ্রেষ্ঠতম ভাষণসমূহের অন্যতম। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছিলেন, ধর্মের ভিত্তিতে কোনো রাজনীতির স্থান বাংলাদেশে হবে না। বলেছিলেন, সব ধর্মের মানুষ নির্বিঘ্নে, বিনা বাধায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবেন, তাতে কেউ বাধা দিতে পারবে না। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার, উৎসব সবার বলে যে তত্ত্ব আজ প্রচলিত রয়েছে, বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ থেকেই এই কথার জন্ম হয়েছে। অবিভক্ত ভারতেও অসাম্প্রদায়িকতায় তার সমকক্ষ ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র, যথা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা শওকত আলি, মোহাম্মদ আলি, খান আবদুল গাফফার খান।

১৯৭৫-এ তাঁকে হত্যা করে সাম্প্রদায়িকতার লালিত সন্তান জিয়াউর রহমান দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটানোর জন্য যে অপপ্রয়াস চালিয়েছিলেন, তারই বিষফল আজও আমরা দেখতে পাচ্ছি বিশেষ করে পূজাকালীন এবং নির্বাচনকালীন ধর্ম ব্যবসায়ীদের উন্মাদনার মাধ্যমে। পূজার সময়ে গত কয়েক বছর যেভাবে সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের ওপর এবং তাদের মন্দিরে আক্রমণ চালানো হয়েছে, বঙ্গবন্ধু সে ধরনের পরিস্থিতি কখনো ভাবতেও পারেননি। পঞ্চম এবং সপ্তম সংশোধনী রায়ের পরে দেশ বহুলাংশে ’৭২-এর আদি সংবিধানে ফিরে গেলেও এখনো কিছু করণীয় বাকি রয়েছে। বিশেষ করে যতদিন এরশাদ প্রণীত রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম কথাটি বিরাজ করবে, ততদিন বলা যাবে না যে আমরা পুরোপুরি ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে গেছি। সাম্প্রদায়িকতা চিরতরে নির্মূল করতেও অনেক পথ হাঁটতে হবে। এ ব্যাপারে ঘোষিত সংখ্যালঘু কমিশন গঠনও অপরিহার্য।

বঙ্গবন্ধু একদিকে যেমন ঘোড়া রেসের জুয়া খেলা বন্ধ করেছিলেন, অন্যদিকে তাঁর সময়ে ধর্মীয় উসকানিমূলক তথাকথিত ওয়াজও হতো না। গ্রামে গ্রামে নিষ্কলুষ যাত্রা, নাটক ছিল গণমানুষের নিত্যনৈমিত্তিক বিনোদনের ক্ষেত্র। তিনি ক্রীড়া এবং সংগীতেরও পূজারি ছিলেন এবং ছিলেন বিশিষ্ট রবীন্দ্র ভক্ত। “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে”, কবিগুরুর এই গানটিকে তিনি এমন সময় তাঁর পথের পাথেয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন যখন ভয়ে বা সংকোচে জর্জরিত হয়ে আওয়ামী লীগের বহু নেতা বাংলার মানুষের স্বাধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলনে নামতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তিনি কবিগুরুর কথা সেই লাইনটিও স্মরণ করতেন যেখানে লেখা হয়েছে, “সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান, সংকটের কল্পনাতে হইও না ম্রিয়মাণ”, আর তাই আওয়ামী লীগের সব নেতাকে পিছে ফেলে তিনিই হতে পেরেছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্ণধার, জনগণ তাঁকে বরণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু হিসেবে, হতে পেরেছিলেন বিশ্ব বন্ধুও। তিনি সারা বিশ্বের নেতা এবং মানুষের যে শ্রদ্ধা অর্জন করতে পেরেছিলেন, সেটি নিশ্চিতভাবে বিরল।

সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করা এই সৈনিকের আকাক্সক্ষা ছিল এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে জনগণের ইচ্ছায় দেশ চলবে। তবে তাঁর গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা আব্রাহাম লিংকনের, প্লেটো বা মেকিয়াভেলির থেকে আলাদা ছিল। গণতন্ত্র বলতে তিনি শোষিত মানুষের গণতন্ত্রকেই বোঝাতেন। তাই তিনি সংবিধানে নির্বাচনি নিয়মকানুন গণমুখী করার জন্য যে নির্বাচন কমিশনের সৃষ্টি করেছেন, তাতে খুঁত পাওয়া ভার। নির্বাচন কমিশনকে তিনি সাংবিধানিক মর্যাদা দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন যেন কারও দ্বারা প্রভাবিত না হতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য তিনি প্রধান এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের অপসারণ মূলত অসম্ভব করে দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের যে কঠিন পন্থায় অপসারণ করা যায়, নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণ করতেও একই পন্থার প্রয়োজন হয়। তাঁর সৃষ্ট বিধান মতেই নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার পর প্রায় সব প্রশাসনিক ক্ষমতা চলে যায় নির্বাচন কমিশনের হাতে, নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যার বিকল্প নেই।

১৩তম সংশোধনী মামলার (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) রায়ের মূল কথা ছিল এই যে, বাংলাদেশের সংবিধান একটি পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের রোজনামচা। এটিতে একমাত্র জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা শাসনের কথাই উল্লেখ রয়েছে বিধায় জনগণের নির্বাচিত ব্যক্তিদের ছাড়া অন্য কেউ দেশ শাসন করতে পারে না।

আজ ’৭১-এর পরাজিত অপশক্তির লোকেরা গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতাসহ বঙ্গবন্ধুর সব সৃষ্টিকে নস্যাৎ করার জন্য মাঠে নেমেছে। তাদের ইচ্ছা দেশকে ’৭১-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া, আবার পাকিস্তানে পরিণত করা, তালেবানি ব্যবস্থার প্রবর্তন। কিন্তু এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে গণধিক্কারে তাদের সেই অভিলাষের ভরাডুবি হবে।

বছর দুয়েক আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বঙ্গবন্ধুকে এক মহাঋষি বলে উল্লেখ করেছিলেন। ১৯৭১-এর নভেম্বরে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীও আমেরিকার বিখ্যাত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় বলেছিলেন, “শেখ মুজিব বাংলাদেশে তার চেয়েও (অর্থাৎ ইন্দিরার চেয়েও) বেশি জনপ্রিয় এবং গণহিতৈষী।” একই মত প্রকাশ করেছিলেন বিশ্বের অন্য নেতৃবৃন্দ, যেমন- ফিদেল ক্যাস্ট্রো, মার্শাল টিটো, নাইয়ারেয়ার, বুমেদিন, উইলি ব্রান্ট, শোন মেকব্রাইড, এডওয়ার্ড হিথ, হেরল্ড ম্যাকমিলন, স্যার এলেক ডগলাস হিউম, সাদ্দাম হোসেনসহ আরও অনেকে। বঙ্গবন্ধুর প্রণীত ’৭২-এর সংবিধান পর্যালোচনা করলে, বিভিন্ন সময়ে, দেশে-বিদেশে তাঁর দেওয়া ভাষণ বিশ্লেষণ করলে কারও উপলব্ধি করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে যে উচ্চতায় ধারণ করতেন, তা যথাযথই ছিল। পৃথিবীতে বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং গণহিতৈষী চেতনার জন্য তিনি মহাঋষি হিসেবেই চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন। তাঁর প্রণীত ’৭২-এর সংবিধানও বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচিত হবে ঠিক মেগনাকার্টা এবং বিল আর রাইটস-এর মতো। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় অসাম্প্রদায়িক চেতনার।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

সর্বশেষ খবর