বৃহস্পতিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
রৌদ্র ছায়া

পাল্টে যাচ্ছে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা

মাকিদ হায়দার

পাল্টে যাচ্ছে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা

শৈশব-কৈশোরের বৃষ্টি বহুদিন আগেই হারিয়ে গেছে এই দেশ থেকে। এবার আষাঢ়-শ্রাবণ, এমনকী ভাদ্র মাসেও তেমন বৃষ্টি হলো না। বৃষ্টি না হওয়ার কারণ আমার এক আবহাওয়াবিদ বন্ধুর কাছ থেকে জানতে চাইলে তিনি জানালেন, বৃক্ষ নিধন ছাড়াও রয়েছে অন্যান্য বিষয়। এবং শেষে জানালেন আমরা যদি বৃক্ষ বন্ধ করতে না পারি, দেশ একদিন মরুভূমিতে পরিণত হবে। বন্ধুর কথাটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো।

এবার শৈশব-কৈশোরের হারানো দিনগুলোর কথায় আসা যেতে পারে। গত কয়েক বছর ধরে আবহাওয়া বেসামাল হয়ে উঠছে। শীত গ্রীষ বর্ষা কোনো কিছুতেই ঠিক নেই। আমাদের ছোটবেলায়। আষাঢ়-শ্রাবণ এমনকী ভাদ্র মাসে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হতো। আষাঢ়ে শুরু হতো অল্প অল্প। স্কুলে যেতাম মানকচুর পাতাকে ছাতা বানিয়ে। বারদুয়েক দুটো ছাতা হারিয়ে ফেলায় পিতা আর ছাতা কিনে না দিয়ে রেগে বলেছিলেন মানকচুর পাতা মাথায় দিয়ে স্কুলে যাবি। আষাঢ় ফুরিয়ে শ্রাবণ এলে বৃষ্টি শুরুর দিন চার পাঁচেক একাধারে, আমাদের ভাইবোন মজা হতো বেশি। স্কুলও বন্ধ দিত। বাড়িতে লেখাপড়ার চেয়ে গুড়মুড়ি খাওয়া এবং ক্যারম খেলাই ছিল প্রধান খেলা। একদিন সেই শ্রাবণ মাস শেষ হলেই শুনতাম ভাদ্র মাসের কথা। ভাদ্র মাসে নাকি তাল পাকে। সত্যিই ভাদ্র মাসেই তাল পেকে আমাদের দোহারপাড়ার খোরশেদ আলীর মাথায় পড়েছিল, আলী রাতের অন্ধকারে প্রাকৃতিক কাজ করতে গিয়ে বসেছিল তালগাছের আড়ালে। আর ঠিক তখুনি একটি পাকা তাল পড়েছিল তার পিঠের ওপর। এসবই আমার শোনা কথা। তবে সে বছর নাকি ভীষণ গরম পড়েছিল। সেই গরমে রাতের অন্ধকারে হাঁটতে বেরিয়েছিল ইউসুফ আলী। সেই তার জীবনের শেষ হাঁটা। ওই রাতে গোখরা সাপ কামড়েছিল। ইউসুফ ছিল পিতা-মাতার একমাত্র ছেলে। পিতা ছিলেন কৃষক; ভাদ্র মাসের প্রথম দিকেই আমার হিন্দু সহপাঠীরা বলত ‘মা’ আসবে আগামী আশ্বিন মাসে। প্রথম দিনে রাহুল ও রবি ঘোষের কথা আমি ঠিকমতো বুঝতে না পারায় রাহুলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তোর মা স্কুলে আসবেন কেন? দুই বন্ধুই হেসে জানিয়ে ছিল আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব হলো শারদীয় দুর্গাপূজা। সে বছর দুর্গাপূজা শুরু হওয়ার আগেই হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। আরেক সহপাঠী কানাই জানাল, মা আসছেন কাঁদতে কাঁদতে। মনে হয় দশমীর দিনেও কাঁদতে কাঁদতেই যাবেন। সত্যি দশমীর দিনেও বেশ ভালোই বৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের স্কুল জীবনে দেখেছি পাবনা সদর গোরস্থান সংলগ্ন হিন্দুদের একটি পূজার গাছ ছিল। প্রতি শনিবার শহর থেকে নাপিত নিয়ে এসে বাচ্চাদের মাথার চুল কেটে সেই ‘পঞ্চনন্দ’ গাছের গোড়ায় ফেলে দিয়ে বেশ কয়েক বার দুধ ঢেলে দিত। গাছের গোড়ায় নাকি ছিল গোখরা সাপের ঘর-সংসার। অপরদিকে সদর গোরস্থানের দেয়াল ঘেঁষে আজও দাঁড়িয়ে আছে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের গোরস্থান। আমরা জনাকয়েক বন্ধু দোহারপাড়ার মুসলমান ছেলে প্রতি মাসের যে কোনো শনিবার স্কুলে না গিয়ে শুধু অপেক্ষায় থাকতাম শহর থেকে কয়েকটি হিন্দু পরিবার আসবে এবং তাদের ছেলেমেয়েদের মাথা ন্যাড়া করবে। ঢোল-ডগর বাজত এবং এক বাতাসা, নারিকেলের নাড়ু এবং দুই পয়সা, এক আনা ছিটিয়ে দিলে আমরা পয়সা কুড়িয়ে নোকোনদানা, চুরমুর খাস্তা, চিনে কিনে বিকাল ৪টা পর্যন্ত এদিক সেদিক ঘোরাফেরা শেষে যেতাম শীতলাই জমিদার বাড়িতে। বাড়িটি দেশভাগ হওয়ার অনেক আগে করেছিলেন শীতলাইয়ের জমিদার যোগেন্দ্রনাথ মৈত্র। জমিদার বাড়িটির দক্ষিণেই ইছামতী নদী। আরও দক্ষিণে পদ্মা। জমিদারের সেজোপুত্র জ্যোতিন্দ্রনাথ মৈত্র ছিলেন খুব নামকরা কবি। পাবনার ইতিহাস দেশভাগের আগে লিখেছিলেন রাধারমণ সাহা। দ্বিতীয় বারে বর্ধিত কলেবরে লিখেছেন পাবনা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. এম এ আলীস। তিনি বিস্তারিত জানিয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের সেই ৫০ দশকের পরে পাবনা শহরে আনুমানিক ১৫০ থেকে ১৮০টি দুর্গামণ্ডপের কথা। আমার স্কুল জীবনে দেখেছি সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ পূজা হতো কালাচাঁদ পাড়ায়। বেশির ভাগ লোকই ছিলেন শহরের বড় বাজারের ব্যবসায়ী। অনেকেই ছিলেন গেঞ্জির ব্যবসায়ী। ফলে কালাচাঁদ পাড়াকে প্রতি বছরই প্রাইজ দেখা হতো। অপরদিকে আরও পূজা হতো হরিশ ঘোষের বাড়িতে, শাল গাড়িয়ার গণেশ বশাকের বাড়িতে, রাধানগরের সাধন মুখার্জি এবং গদা মজুমদারের বাড়িতে। গদা বাবু ছিলেন প্রখ্যাত গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের নিকটাত্মীয়। কয়েকটি মোটর গাড়ি ছিল গদা বাবুর। থাকতেন পাবনা থানার পুবদিকের একটি দোতলা বাড়িতে। রাধানগরের বাড়িতে থাকতেন তার অনুজ। ১৯৬২ এবং ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই খুন হয়েছিলেন। সরকারের ইচ্ছায় সেই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর সাহেব এবং ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে অনেক হিন্দু পরিবার জন্মভূমি ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিল ভারতের বিভিন্ন জেলায়। এমনকী সুন্দরবন অঞ্চলে (ভারতীয় অংশে)। কয়েক লাখ লোককে পাঠিয়েছিল দণ্ডকারণ্যে। এ ছাড়াও ছিল আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ। ওই দ্বীপে খুনি ডাকাত ছাড়াও ব্রিটিশ সরকার পাঠাত স্বদেশি বিপ্লবীদের। যেমন তৎকালীন পূর্ববাংলার হিন্দু-মুসলমানসহ অনেককেই পাঠাত জেলখানায়। ১৯৪৮ সালে বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি প্রথম দিকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে থাকলেও পরে তার ভুল ভেঙেছিল। বুঝেছিলেন না-পাকদের সঙ্গে হাত মিলানো ঠিক হয়নি। ১৯৭১ সালের আগে একাধিকবার কারাবরণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

কথা বলছিলাম বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের পুজো নিয়ে। স্কুলের সহপাঠীদের অনেকেই হিন্দু ছিলেন। তবে তার মধ্যে প্রিয় বন্ধু ছিলেন আশীষ রাখাল রায় বাচ্চু। বাচ্চুর বাবা ছিলেন পাবনা শহরের প্রখ্যাত উকিল প্রভাত চন্দ্র রায়। অপরদিকে জগদীশ গুহ, দেবেন চন্দ্র রায় তারা প্রাধান্য বিস্তার করলেও মুসলমানদের ভিতরে তোরাব উকিল, ক্যাপটেন মুনসুর আলী মোখতার ছিলেন প্রভাবশালী। তবে কালাচাঁদ পাড়ার দুর্গাপূজা উৎসবে সবচেয়ে বেশি টাকা দিতেন বুধু বাবু। যার বাড়ির উত্তরে বিশাল পুকুর। বুধু বাবু ছিলেন জমিদার। সেই বুধু বাবুসহ আরও অনেকে নিজের বাড়িঘর স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে চলে গেলেন ভারতে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পরে। মাত্র ১৭ দিনের যুদ্ধে পাঞ্জাবিরা যতটা অংশ নেয়নি, তার চেয়ে অধিক বাঙালি সৈনিককে না-পাক সরকার ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠিয়েছিল। তবে ভারত তৎকালের পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করেনি। না করলেও না-পাক পাকিস্তানিরা ঢাকার কুর্মিটোলায় এক কিশোরকে হত্যা করে। ১৯৬৫ সালের রেডিও পাকিস্তান ঢাকার এবং করাচি থেকে রাত ৮টায় বাংলা সংবাদ পাঠ করতেন মুজিবর রহমান খাঁ, ইমরুল চৌধুরী, সরকার কবির উদ্দিনসহ আরও দু-একজন। এমনকী তখনকার দিনে একটি মাত্র সাদাকালো টেলিভিশন ছিল আজিমপুরে ৭৪/এ কলোনিতে। সে বাসায় থাকতেন একজন টাউন প্ল্যানার আবুল মনছুর। সম্পর্কে আমাদের ভগ্নিপতি। রাত ৮টার সংবাদ পাকিস্তান টেলিভিশন ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচার হওয়ার আগে প্রচুর লোক এসে জড়ো হতো মাঠে। সেই মাঠেই এনে রাখা হতো টেলিভিশন। যুদ্ধের আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র ১৭ দিন। রেডিও এবং টেলিভিশনে প্রচার করা হতো ভারতের বিভিন্ন জায়গা পাকিস্তান দখল করেছে। পরে জেনেছি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। সেই যুদ্ধে ভারত জয়ী হলেও পূর্ব পাকিস্তানের অনেক হিন্দু পরিবার জন্মভূমি ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছিল। সেই সুযোগে বুধু বাবুর পুকুর এবং কালাচাঁদপাড়ার কে পি ইউনিয়ন দখল করেছিল নিকেরী পাড়ার জনাকয়েক নিকেরী বা পাবনা বাজারের মাছ ব্যবসায়ীরা। দেখতে দেখতে আমার সহপাঠী গোপাল ঘোষ, হরিশ ঘোষসহ অনেকের পরিবার রাতের অন্ধকারে চলে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা, মালদাহ, মুর্শিদাবাদসহ অন্যান্য জেলায়। তবে দেশছাড়ার দুই দিন আগে আমার গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউশনের সহপাঠী করুণা প্রসাদ দে বাবলু আমাকে গোপনে জানিয়েছিল ‘আমরা পরশু রাতে কলকাতার কাছে ইছাপুরে চলে যাব’। দেখলাম বাবলুর চোখে পানি। শুধু বাবলুই নয়, বাচ্চুও আমাকে বলেছিল- ‘মা তোকে আজকেই যেতে বলেছে আমার সঙ্গে’। আমি স্কুল ছুটির পর গিয়েছিলাম বন্ধুর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। মাসি-মা অনেক কুশলাদি জানার পর আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন লেখাপড়া ভালো করে করবি। হঠাৎ খেয়াল করলাম কণ্ঠস্বর যেন ভেজা এবং এক ফাঁকে দেখলাম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে কাকে যেন বললেন বাচ্চু আর মাকিদকে মিষ্টি খেতে দে। আমাদের খাওয়া শেষে কোর্ট থেকে ফিরলেন প্রভাত কাকা। জানালেন আমাদের হাকিম ভাইকে বলেছি দু-চার দিনের ভিতরে ভারতে চলে যাব। (শেখ মোহাম্মদ হাকিম উদ্দিন আমাদের পিতা) দেখলাম তার কণ্ঠস্বর ভেজা।

১৯৬৫ সালের পরে অনেক হিন্দু পরিবারের পরিত্যক্ত বাড়িঘর পাকিস্তান সরকার ঘোষণা দিয়েছিল শত্রু সম্পত্তি। আইনটা বোধহয় এখনো বলবৎ আছে।

এবারের দুর্গাপূজার বিশাল মণ্ডপ হয়েছে উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাবের মাঠে। নাম দিয়েছে উত্তরা সর্বজনীন পূজামণ্ডপ। দেখলাম হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ উপভোগ করেছেন আনন্দ-উৎসব। এই আনন্দ-উৎসবের মাঝখানে তুমুল বৃষ্টি জানিয়ে দিল তার উপস্থিতি। মা যাওয়ার আগে এবং পরে ক্রন্দন করে থাকেন বলে শুনেছি হিন্দু বন্ধুদের কাছে।

লেখক : কবি

সর্বশেষ খবর