শুক্রবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

সবল অর্থনীতির জন্য এ মুহূর্তের বিবেচনা

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

সবল অর্থনীতির জন্য এ মুহূর্তের বিবেচনা

বিষয়টি যতই করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সাম্প্রতিক ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের যুদ্ধ এবং নির্বাচন নিয়ে গোলযোগ বিশৃঙ্খলার পরিবেশ পরিস্থিতি উদ্ভূত বলে প্রচার পাক না কেন বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় অর্থনীতি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হওয়া শুরু হয়েছে, নানান কারণে, করোনার আগে থেকেই। এ মুহূর্তে যা দৃশ্যমান হচ্ছে তাতে প্রতীয়মান হয় সতর্ক না হলে ভবিষ্যতের রাজনীতি অর্থনীতির অগ্রযাত্রাকে আরও অনিশ্চিত করে তুলবে। অর্থনীতির অধোগতিকে এখন সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। অর্থনীতি সুস্থ সবল ও গতিশীল থাকার সূচকগুলোর ব্যারোমিটার যেভাবে ওঠানামা করছে তা ক্রমশ হিমাঙ্কের দিকেই চলে যাচ্ছে। এনবিআর (রাজস্ব আহরণ), বাংলাদেশ ব্যাংক (অর্থবাজার তথা ব্যাংকিং সেক্টর), সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন (পুঁজিবাজার), বাণিজ্য মন্ত্রণালয় (দ্রব্যমূল্য তদারকি), বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মতো নিয়ন্ত্রক ও পোষক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়শই তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা চালালেও কেন জানি বল ও ব্যাটের সমন্বয় হচ্ছে না। রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থবহ উন্নয়ন স্বব্যাখ্যাত ও স্বীকৃত হতে পারছে না। উন্নয়ন ভাবনায় স্বার্থবাদী লুটেরা উপাদানের বাহুল্যতায়, বল্গাহীন দুর্নীতির অনুপ্রবেশে, জাতীয় চেতনাকে দলীয় চিন্তা ও স্বার্থবাদিতার নিগড়ে নিক্ষেপের কারণে ‘যা কিছু হারায় কেস্টা বেটাই চোর’ ধরনের আস্থাহীন পরিবেশ সৃষ্টির সুযোগ মিলছে। উন্নয়নকে মন্দ বিনিয়োগ সাব্যস্ত করায় তাতে অর্থনীতিতে যে সক্ষমতা গড়ে ওঠার কথা তার হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। আয় বৈষম্য বৃদ্ধি এখন সবখানে বুমেরাং হিসেবে ফিরছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কিছু দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেকখানি পিছিয়ে পড়েছে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, সুদান, সোমালিয়া ও আফগানিস্তানের মতো পরিস্থিতি তৈরি হোক কোনো দেশই সেটি চায় না। এসব দেশে স্বৈরাচারী বা ফ্যাসিবাদী চেহারা উন্মোচিত হতে অনুঘটকের কাজ করছে সুশাসনের অভাব, জবাবদিহির দৈন্যতা এবং সর্বত্রগামী দুর্নীতি। এসব অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশ পরিস্থিতি উন্নয়নকে কঠিন চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। এখানে দুর্নীতিই এখন সবকিছুর উৎস হিসেবে সাব্যস্ত হচ্ছে। এ দুর্নীতি শুধু আর্থিক লেনদেনে সীমাবদ্ধ নেই, দুর্নীতি এখন ইতিহাস বিকৃতিতে, মুক্তবুদ্ধি ও মতপ্রকাশে বাধাদানে, চিন্তা-চেতনায় বিভক্তিকরণে, মৌলিক অধিকার হরণে, দুষ্টের পালনের দ্বারা শিষ্টকে কোণঠাসাকরণে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে সরকারি তথা দলীয় রাজনীতিকীকরণে, রাজনৈতিক উৎকোচের মাধ্যমে কোটারি পোষণ তোষণেও পরিব্যাপ্ত। এ মুহূর্তে এটা বিবেচনায় আনতে, মানতে ও স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলাদেশ ৫২ বছরে নানারকম বাধা-বিপত্তি, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মোটামুটি একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নটা, বিশেষ করে প্রবৃদ্ধি, গ্রোথ, সেটাই বেশি প্রচার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাকি যে সার্বিক উন্নয়ন তা লাগসই ও টেকসই হওয়া সম্পর্কে এখনো অনেক প্রশ্ন আছে। এটা এমন নয় যে, এক বা দুই দশকের মধ্যে এগুলো অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। গত পাঁচ দশকে কখনো কম অর্জন, কখনো বেশি অর্জন এভাবে বাংলাদেশ এ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখন বাংলাদেশের মূল চ্যালেঞ্জটা হলো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধরে রাখা এবং সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থায়ী, টেকসই উন্নয়নের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, এখনো সেটা বলার সময় আসেনি। এমতাবস্থায় যদি দেশ ও অর্থনীতির অবস্থা অস্থিতিশীল হয়, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যদি ধারাবাহিকভাবে হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচি দেয় বা দিতে বাধ্য হয়, তবে দেশের অর্থনীতি সমূহ-ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর। কারও বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় যে, অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি প্রকারান্তরে সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশে দুর্ভাগ্যক্রমে বিগত বেশ কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনের আগে একই ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকারের এবং বিরোধীদের মনোযোগটা বেশি বিচ্যুত হয়েছে। ২০০৬, ২০১৩, ২০১৮ এবং এবারও রাজনীতির দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে অর্থনীতিকে ঠিক করার জন্য যে ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজন সেদিকে সরকার ও বিরোধী পক্ষের মনোযোগ মর্মযাতনায় পরিণত হয়েছে।

এটা সর্বজনবিদিত যে, রাজনৈতিক সংঘাত এবং সহিংসতায় সম্পদের ক্ষতি হয়। মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ, প্রকল্প বাস্তবায়ন, পণ্য সরবরাহ এবং ব্যক্তি ও সামষ্টিক আয় ও ব্যয় ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ ক্ষতি শেষমেশ সামাজিক সংহতি এবং অর্র্থনীতির সহনশীল শক্তিকে বিনষ্ট করে। ক্ষমতায়নে অন্তর্ভুক্তির চেতনা কার্যকর না থাকলে, জনগণকে বাদ দিয়ে, উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে, বিচ্যুত করে ‘আমরাই সব দখল করব’ সেটি সঠিক নীতি নয়। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে নিবর্তনমূলক আইন না পড়ে পাস করার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা থেকেই নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, সেই আইন প্রয়োগযোগ্যতারও প্রশ্ন ওঠে। সব নাগরিকের সমঅধিকার বণ্টনের বিষয় রয়েছে, সবাইকে সমান অধিকার ও অবস্থান স্বীকার করাও সাংবিধানিক দায়িত্ব। বল প্রয়োগ করে টিকে থাকাটা অসাংবিধানিক। ন্যায়নীতি নির্ভরতার চিন্তা-চেতনায় মানসম্মত শিক্ষাদীক্ষায় দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে না পারলে সংবিধানের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা পাবে কীভাবে।

এ মুহূর্তে অর্থনীতির জন্য বড় বিবেচ্য বিষয় হলো- কোনো অবস্থাতেই সংঘাত যাতে দীর্ঘ না হয় সে চেষ্টা চালাতে হবে। সংঘাত এড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে সবকিছুর সমাধান সবার কাম্য। দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনীতি খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে, এখন নির্বাচনের নামে যা শুরু হয়েছে তা চলতে থাকলে অর্থনীতি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থনীতি খারাপ হলে সবার জীবনই অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে। হরতাল-অবরোধ ও সংঘাতের কারণে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বাধ্য হলে সেখানে উৎপাদন ব্যাহত হবে, এমনকি বেতন-ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে। মানুষের আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। আর চাহিদা ও সরবরাহ চেইনে বিশৃঙ্খলা ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। সব মিলে সমঝোতার রাস্তা তৈরি না হলে সামনের সময় আরও খারাপ হবে। এখানে সব পক্ষকে উদ্যোগী ভূমিকায় দেখা না গেলে অর্থনীতিকে চরম মাশুল দিতে হবে, যার থেকে উত্তরণে দেশকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার ঘেরাটোপে পড়তে হবে। বিজ্ঞজনের অভিমত, রাজনৈতিক সংঘাত একটি দেশকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যেতে পারে যেখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে এবং এর সহজ কোনো উপায় থাকে না। বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগে সব পক্ষকেই সমঝোতায় আসার বিকল্প নেই। ভূরাজনীতি ও সিন্ডিকেট সৃষ্ট সমস্যার সমাধান হতে হয় জাতীয় ঐকমত্যে, সংলাপে, সেখানে দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপার আছে, স্বচ্ছতার ব্যাপার আছে, আছে পারস্পরিক অধিকারের ব্যাপার। এ বিষয়গুলো বাদ দিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল করার চিন্তা করা সমীচীন হবে না। মানতে হবে রাজনীতি যদি স্থিতিশীল না হয় তাহলে অর্থনৈতিক অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটবে না। রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল কোনো দেশে স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ হবে না। বিদেশে বড় বড় রোডশো করে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। এ দেশের নাড়ি-নক্ষত্রের খবর সবার কাছে আছে। সমঝোতার মাধ্যমে স্থিতিশীলতা আনা বা আসা ছাড়া কোনো অর্থনৈতিক কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদন করা যাবে না এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান ব্যাহত বা ক্ষতিগ্রস্ততা ঠেকানো যাবে না।

সব পক্ষের সব মনোযোগ যখন রাজনীতির দিকে তখন গণমানুষের প্রতি কারও নজর থাকে না, তখন অসহায় মানুষ প্রতিকার দাবিতে দাঁড়ানোর জায়গাও পায় না। মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে অনেক কষ্টে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। দেশে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাড়ছে না বরং আরও সংকুচিত হচ্ছে। সবাই দেখছে বন্দরে জাহাজ কম, পণ্যবাহী ট্রাকের পরিমাণ কম, কোম্পানিগুলোর উৎপাদন কমে যাচ্ছে। নিজস্ব রেভিনিউ আর্নিং সক্ষমতা না বাড়িয়ে কঠিন শর্তের ধারকর্জ করে বড় বড় ব্যয়ে উৎসাহ বোধের মতো আত্মঘাতী প্রবণতা ইদানীং কোন দিকে যাবে সেটি ভাবতেও সবার মধ্যে ভয় ঢুকে যাচ্ছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামগ্রিক সংকটকে কতখানি নিচে নামিয়ে দিতে পারে সেটি নিয়ে সবাই শঙ্কিত।

দেশ সমাজ ও রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা ও আস্থার জায়গা না থাকলে এবং আলোচনা-সমঝোতার সুযোগ ব্যর্থ হলেই অস্থির পরিস্থিতির অবতারণা হয়। রাজনৈতিক চর্চা যে মূল্যবোধের ভিত্তিতে করতে হয় সেখানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে কিছু নেই। একটি দল ক্ষমতায় থাকবে, আরেকটি দল বিরোধী অবস্থানে থাকবে। সবার রাজনৈতিক চর্চাই হবে দেশের স্বার্থে কাজ করা। এটি ভুলে গেলেই দেশ কিছুদিন পরপর একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে নিপতিত হয়, যার খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষকে।

এ মুহূর্তে এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, দিন দিন আর্থিক বৈষম্য বেড়েই চলছে। আর্থিক বৈষম্য মানে আয়ের বৈষম্য ও সম্পদের বৈষম্য। এই যে আর্থিক ও সম্পদের বৈষম্য সাধারণ মানুষের বা যে কোনো মানুষের জীবনের ওপর নেতিবাচক সামাজিক প্রভাব ফেলছে। কারণ আয়ের সংস্থান যদি না থাকে এবং আয়ের বৈষম্য থাকে তাহলে যতই সার্বিকভাবে সামষ্টিক উন্নতি হোক, বিষয়টার ফল কিন্তু সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারে না। এখন জানতে হবে এর কারণ কী? মুখ্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে নীতির দুর্বলতা; অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব; দুর্বল নিয়ন্ত্রক ও নিয়ামক প্রতিষ্ঠান; রাজনীতি ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাবযুক্ত অদক্ষ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা এবং সব জায়গায় সুশাসন অর্থাৎ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব। নানারকম সরকারি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে, উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়ন, প্রশাসনসহ অন্যান্য ব্যাপারেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির যথেষ্ট অভাবের বিপরীতে প্রাইভেট সেক্টরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও খুব ভালোভাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আওতায় নেই। সেটার প্রতিফলন দেখা যায় বাজার অনিয়ন্ত্রিত। মূল্যস্ফীতি ঘটছে। লোকজনের আয়ের সংস্থান কমে যাচ্ছে দিন দিন। লোকজনের যে নানারকম সমস্যা সেগুলোর কিন্তু সমাধান হচ্ছে না। এমন নয় যে, সমস্যাগুলোর সমাধানের পথ কেউ জানে না যেখানে সদিচ্ছা, সচেতনতা ও সততার অভাব রয়েছে। রাতারাতি সব সমস্যার সমাধান হয়তো হবে না, তবে এসব থামানোর কাজ শুরু করতে হবে এ মুহূর্ত থেকে, যদি আমরা অর্থনীতিকে প্রকৃত উন্নয়ন অভিমুখী করতে চাই।

 

                লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক

 

সর্বশেষ খবর